ভরদুপুরে কাজ ফেলে রাস্তায় নামল ধর্মতলার অফিসপাড়া!
পাতাল-পথ ছেড়ে হুড়মুড়িয়ে রাজপথে উঠলেন মেট্রোযাত্রীরা। মুহূর্তে ফাঁকা হয়ে গেল সল্টলেকের তথ্যপ্রযুক্তি তালুকের বহুতলগুলি। বিমানবন্দরের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে ‘ভয়ে’ নীচে নামলেন কেউ-কেউ। দুর্ঘটনার গুজবে ভাসল দমদম থেকে বেহালা, গড়িয়া থেকে শ্যামবাজার।
শহর জুড়ে তুমুল হুড়োহুড়ির মধ্যেই মোবাইলে এসএমএস পেলেন অনেকে ‘ফেল্ট আর্থকোয়েক ম্যান!’ |
অফিস ছেড়ে রাস্তায়, পার্ক স্ট্রিট উড়ালপুলের নীচে। |
ইন্দোনেশিয়ার ভূমিকম্পের ‘ছোঁয়ায়’ বুধবার দুপুরে এমনই আতঙ্ক ছড়াল কলকাতার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে।
ঘড়িতে প্রায় সওয়া ২টো। মৃদু কম্পন টের পাওয়া যায় তখনই। ধর্মতলা, পার্ক স্ট্রিট, সল্টলেকের বহুতল অফিস থেকে দ্রুত রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন কর্মীরা। তথ্যপ্রযুক্তি তালুকের একটি অফিসের আটতলায় ছিলেন অরিন্দম আড্ডি। তিনি বললেন, “হঠাৎ ঘরের মেঝেটা কেঁপে উঠল। অফিসের পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে ভূমিকম্পের ঘোষণা শুনলাম। সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে যেতে বলা হল সবাইকে।” ওই বহুতলে ছিলেন ইন্দ্রনীল সেনগুপ্তও। তিনিও বললেন, “প্রবল আতঙ্ক ছড়িয়েছিল। ঘোষণার পরেই সবাই একসঙ্গে হুড়মুড়িয়ে নীচে নামতে শুরু করে।”
পার্ক স্ট্রিট উড়ালপুলের নীচের রাস্তাতেও আশপাশের বহুতলে থাকা অফিস, বাড়ির লোকেদের ভিড় জমে যায়। তার জেরে যান চলাচল কিছুক্ষণের জন্য থমকে যায় জওহরলাল নেহরু রোডের ওই এলাকায়। ছবিটা একই রকম ছিল গণেশচন্দ্র অ্যাভিনিউ, বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট, ক্যামাক স্ট্রিটের মতো অন্য কয়েকটি রাস্তাতেও। ভূমিকম্পের পরপরই আনোয়ার শাহ রোড সংলগ্ন একটি বহুতলের আবাসিকদের নীচে নিয়ে যান সেখানকার নিরাপত্তাকর্মীরা। |
|
|
চাঙর খসে পড়ল দমদম
পার্কের একটি স্কুলে। |
বন্ধ মেট্রো, অপেক্ষা
যাত্রীদের। |
|
থিকথিকে জমায়েত হয় ওই বহুতলের সামনের চত্বরে। ‘নিউজ-চ্যানেলে’ কী দেখাচ্ছে, তা জানতে আত্মীয়-বন্ধুদের ফোন করছিলেন সেখানকার বাসিন্দারা। তথ্যপ্রযুক্তি তালুকের টেকনোপলিস, কলেজ মোড়, ইনফিনিটি মোড়েও তখন কাতারে-কাতারে লোক। প্রায় আধ ঘণ্টা জমে ছিল সেই ভিড়।
দমদম বিমানবন্দরের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল-এর (এটিসি) সাততলা ভবন থেকে কয়েক জন কর্মী ভূমিকম্পের পরে আতঙ্কে নীচে নেমে আসেন। তবে তার জেরে বিমান চলাচলে সমস্যা হয়নি বলে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন। যাত্রী-নিরাপত্তার কারণে মেট্রো পরিষেবাও পৌনে এক ঘণ্টার জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। মেট্রো কর্তৃপক্ষ জানান, সংস্থার জিএম-এর নির্দেশে দুপুর ২টো ৪২ মিনিট থেকে সাড়ে তিনটে পর্যন্ত ট্রেন চলেনি। স্টেশনে-স্টেশনে ঘোষণা করা হয়, ‘ভূমিকম্প হয়েছে। ট্রেন ফাঁকা করে দিন।’ প্ল্যাটফর্ম থেকেও যাত্রীদের সরিয়ে দেন সেখানে কতর্ব্যরত রেলরক্ষী বাহিনীর জওয়ানেরা। মেট্রোর ইঞ্জিনিয়ারেরা লাইন পরীক্ষার পরে ফের পরিষেবা শুরু হয়।
ভূকম্পনের আতঙ্ক-ঘেরা শহরে গুজবও ছড়ায় পাল্লা দিয়ে। কখনও শোনা যায়, ভূকম্পনে বাড়ি ভেঙেছে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ে। কখনও ‘জানা’ যায়, পার্ক স্ট্রিটের পিচরাস্তা ফেটে চৌচির! বঙ্গোপসাগরের সুনামি-ঢেউয়ে দিঘায় জলোচ্ছ্বাসের ‘কথা’ও ছড়াল শহরের উত্তর থেকে দক্ষিণে। কলকাতা, সল্টলেকের বেশ কিছু বহুতল ভূমিকম্পে হেলে গিয়েছে এবং কয়েকটিতে ফাটল ধরেছে বলে গুজব রটে। কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (সদর) জাভেদ শামিম জানান, বৌবাজার এলাকার মেটকাফে স্ট্রিটে একটি বহুতল সামান্য হেলে গিয়েছে। লিন্ডসে স্ট্রিটের এক বহুতলের লিফ্টের একটি অংশে ফাটল দেখা গিয়েছে। এ ছাড়া ভূমিকম্পের জেরে কলকাতা পুলিশ এলাকায় কোনও দুর্ঘটনা ঘটেনি। |
আতঙ্কের উৎস-সন্ধান, অফিসপাড়ার এক বহুতলের সামনে। |
নবদিগন্ত ইন্ডাস্ট্রিয়াল টাউনশিপ অথরিটির এগ্জিকিউটিভ অফিসার বদ্রীনারায়ণ কর অবশ্য সল্টলেকে এই ধরনের কোনও ঘটনার কথা মানতে চাননি। কলকাতা হাইকোর্টের পুরনো ভবনেও ভূমিকম্পে চিড় ধরেছে বলে রটে যায়। পরে অবশ্য জানা যায়, সেটি পুরনো ফাটল। পার্ক স্ট্রিটের একটি বহুতল অফিসের দেওয়ালে ভূকম্পনের জেরে ফাটল ধরেছে বলে খবর ছড়ায়। তবে, সেখানকার কর্তৃপক্ষও জানিয়ে দেন, ফাটলটি পুরনো। সেটির মেরামতির কাজও চলছে। আলিপুরের প্রশাসনিক ভবনেও ফাটল ধরেছে বলে দাবি ওঠে। দমদম পার্ক এলাকার কৃষ্ণপুর আদর্শ বিদ্যামন্দির স্কুলের তিনতলার একটি ক্লাসঘরের ছাদের চাঙর ভূমিকম্পে খসে পড়ে বলে স্কুল কর্তৃপক্ষের দাবি। ওই বাড়ির একটি ঘরে ফাটলও হয়েছে বলে জানানো হয়। এর পাশাপাশিই ভূমিকম্পের আতঙ্কে, ফাটলের গুজবের প্রভাব পড়ে কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও। ছুটি দিয়ে দেওয়া হয় একটি বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। কোথাও কোথাও সান্ধ্যকালীন ক্লাস ছুটি দিয়ে দেওয়া হয় বলেও জানা গিয়েছে।
অন্য দিকে, সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ শ্যামবাজার থেকে বেলগাছিয়া স্টেশনে যাওয়ার সময়ে একটি মেট্রোর চালকের কানে আসে ‘অস্বাভাবিক’ শব্দ। তড়িঘড়ি কন্ট্রোলকে বিষয়টি জানান তিনি। মেট্রো কর্তৃপক্ষ জানান, দুপুরের ঘটনার প্রেক্ষিতে আগাম ব্যবস্থা হিসেবে পরের ট্রেনটিকে শ্যামবাজারে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়। ইঞ্জিনিয়ারেরা লাইন পরীক্ষা করেন। মিনিট পাঁচেক পরে ট্রেন ছাড়ে।
|
বুধবার ছবিগুলি তুলেছেন রাজীব বসু, দেবাশিস রায় ও বিশ্বনাথ বণিক। |