রাজনৈতিক বাধা কাটিয়ে বিমান ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নিতে অনুমোদনের পথে এ বার কৌশলে পা ফেলতে চাইছে মনমোহন সিংহ সরকার। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার শীর্ষ সূত্রে বলা হচ্ছে, সেই কৌশলের মূল সূত্রই হল ভারসাম্য রক্ষা করা। তাই মন্ত্রিসভা প্রথমে আর্থিক সঙ্কটে ধুঁকতে থাকা এয়ার ইন্ডিয়ার পুনর্গঠনের প্রস্তাবটি মঞ্জুর করবে। রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান সংস্থাকে সঙ্কট থেকে বের করে এনে লাভজনক করতে যে তারা ঐকান্তিক, সেটা এই ভাবে বুঝিয়ে দেওয়ার পরেই সামগ্রিক ভাবে বিমান ক্ষেত্রে বিদেশি লগ্নির প্রস্তাবকে অনুমোদন দেওয়ার চেষ্টা করবে সরকার। রাজনৈতিক বাধা কাটিয়ে যা সম্ভব হলে আবার স্বস্তির শ্বাস ফেলবে কিংফিশারের মতো আর্থিক সঙ্কটে থাকা বেসরকারি সংস্থা।
সেই কৌশলের প্রথম ধাপটি আগামিকালই পেরোতে পারে সরকার। সরকারি সূত্রের খবর, এয়ার ইন্ডিয়াকে ফের লাভজনক করে তুলতে তার পুনর্গঠনের প্রস্তাবটিতে কাল কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার অর্থ বিষয়ক কমিটির বৈঠকে অনুমোদন দেওয়া হতে পারে। রাষ্ট্রায়ত্ত এই বিমান সংস্থার আর্থিক পুনর্গঠন ও ‘টার্নঅ্যারাউন্ড প্ল্যান’ নিয়ে স্টেট ব্যাঙ্কের নেতৃত্বে ১৮টি ব্যাঙ্কের একটি কনসর্টিয়াম গত মাসে কেন্দ্রের কাছে একটি রিপোর্ট পেশ করেছে। এয়ার ইন্ডিয়ার সঙ্গে তাদের একটি চুক্তি সইও হয়েছে। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে একটি মন্ত্রিগোষ্ঠী ওই প্রস্তাবে অনুমোদনও দিয়েছে।
আবার এরই পাশাপাশি বিমান ক্ষেত্রে ৪৯ শতাংশ পর্যন্ত প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নির প্রস্তাব নিয়ে ক্যাবিনেট নোটও চূড়ান্ত করে ফেলেছে বিমান মন্ত্রক। গোড়ায় ২৬ শতাংশ পর্যন্ত প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নির প্রস্তাব থাকলেও অজিত সিংহ মন্ত্রকের দায়িত্ব নেওয়ার পর তা বাড়িয়ে ৪৯ শতাংশ করার প্রস্তাব করেছেন। কেন্দ্রের শীর্ষ সূত্রে বলা হচ্ছে, শীঘ্রই তা মন্ত্রিসভার অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে।
ক্যাবিনেট নোট অনুযায়ী এয়ার ইন্ডিয়ার আর্থিক পুনর্গঠনের জন্য এই রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার ঋণ বাবদ সুদের বোঝা বছরে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা কমাতে চলেছে কেন্দ্র। এ ছাড়াও ৭৪০০ কোটি টাকার বন্ড ছাড়ার অনুমতি দেওয়া হতে পারে। কার্যকরী মূলধন খাতে এয়ার ইন্ডিয়ার ঋণের বোঝা ২২ হাজার কোটি টাকারও বেশি। যে জন্য সংস্থাটিকে প্রায় ১৪ শতাংশ হারে সুদ দিতে হয়। পুনর্গঠন প্রস্তাব অনুসারে এর মধ্যে ১১ হাজার কোটি টাকার ওপর থেকে সুদ ৪ শতাংশ কমিয়ে ১০ শতাংশ করে দিতে পারে কেন্দ্র। তা ছাড়া চলতি আর্থিক বছরে চার হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত ইক্যুইটি হিসাবে বিনিয়োগ করতে পারে সরকার। সেই সঙ্গে বায়ুদূতের মতো কিছু অলাভজনক পরিষেবা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে।
বিমান মন্ত্রক সূত্রে বলা হচ্ছে, এরই পাশাপাশি এয়ার ইন্ডিয়ার ‘টার্নঅ্যারাউন্ড’ পরিকল্পনার মধ্যে বোয়িং ড্রিমলাইনার-৭৮৭ বিমান কেনার বিষয়টিও রয়েছে। মোট ২৭টি বিমান কেনা হবে। কাল মন্ত্রিসভা পুনর্গঠন প্রস্তাবে অনুমোদন দিলে সম্ভবত আগামী মাস থেকে বিমানগুলি আসতে শুরু করবে।
কংগ্রেস নেতৃত্বের বক্তব্য, বিরোধী ও তৃণমূল-সহ সরকারের কিছু শরিক দলের অভিযোগ ছিল, বিমান ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নিতে সরকার ছাড় দিলে এয়ার ইন্ডিয়া আরও বিপদে পড়বে। রাষ্ট্রায়ত্ত এই বিমান সংস্থা এমনিতেই ধুঁকছে। বিদেশি লগ্নি এলে তা মুখ থুবড়ে পড়বে। সেই আশঙ্কা দূর করতেই সরকার প্রথমে এয়ার ইন্ডিয়ার আর্থিক পুনর্গঠন পরিকল্পনাটি মঞ্জুর করতে চলেছে। যার মধ্যে দিয়ে এই বার্তাও দিতে চাইছে যে, বিমান সংস্থায় প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নি এলেও এয়ার ইন্ডিয়াকে ফের লাভজনক করে তুলতে সরকার তৎপর এবং যত্নশীল। এয়ার ইন্ডিয়ার আর্থিক প্যাকেজ আগে অনুমোদন করে দিলে বিরোধীদের আক্রমণ ভোঁতা হয়ে যাবে। তার পর প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নিতে অনুমোদন দিতে সরকারের অসুবিধা হবে না।
রাজনৈতিক সূত্রে এ-ও বলা হচ্ছে, এয়ার ইন্ডিয়ার জন্য আর্থিক প্যাকেজ অনুমোদন করলেও বিমান ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নি নিয়ে বিরোধিতার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তৃণমূলের মতো ইউপিএ-র শরিকরা তখনও আপত্তি তুলতে পারে। তা ছাড়া এয়ার ইন্ডিয়ার পুনর্গঠনের জন্য সরকারে যে আর্থিক প্যাকেজ নিতে চলেছে, তা যথাযথ হবে না বলে এখন থেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করতে শুরু করে দিয়েছেন বামেরা।
তবে সন্দেহ নেই, বিমান ক্ষেত্রে ৪৯ শতাংশ প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নিতে কেন্দ্র ছাড়পত্র দিলে সব থেকে স্বস্তি পাবে বিজয় মাল্যর কিংফিশার বিমান সংস্থা। এই বিমান সংস্থাও তীব্র অর্থ সঙ্কটে ভুগছে। মাল্যর কথায়, কিংফিশারের পুনরুজ্জীবন নির্ভর করছে সরকারের নীতির ওপর। তবে দেশের সব বেসরকারি বিমান সংস্থাই যে প্রত্যক্ষ লগ্নির পক্ষে, তা নয়। এই অবস্থায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার এক শীর্ষ সারির নেতা আজ বলেন, দেশের বিমান ক্ষেত্র যে আর্থিক সমস্যার মধ্যে দিয়ে চলছে, তার সার্বিক সমাধান সূত্র খুঁজতে চাইছে সরকার। রাজনৈতিক বাধা অতিক্রম করে কেন্দ্র এ ব্যাপারে কতটা সফল হতে পারবে, এখন সেটাই দেখার। |