প্লেট ওঠেনি প্লেটে, তাই এল না সুনামি
সাড়ে সাত বছর আগে সুমাত্রায় ভারত মহাসাগরের নীচে রিখটার স্কেলে ৯.৩ মাত্রার ভূমিকম্পে সমুদ্রের জল ফুঁসে উঠে কয়েক হাজার কিলোমিটার জুড়ে ধ্বংসলীলা চালিয়েছিল। অন্তত ১৪টি দেশে দু’লক্ষেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল ভয়াবহ সুনামিতে।
বুধবার ভারত মহাসাগরের নীচে প্রায় একই জায়গায় আর একটি ভূমিকম্প হল। রিখটার স্কেলে যার মাত্রা ৮.৬। ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলিতে জারি হল সুনামির সতর্কতা। কলকাতা তো বটেই, ভূমিকম্পে কেঁপে উঠল উত্তর-পূর্ব ভারতের মিজোরামও। পাঁচ ঘণ্টা চরম উৎকণ্ঠায় থাকার পরে স্বস্তি পেলেন পৃথিবীর একটা বড় অংশের মানুষ। কারণ, সমুদ্রের নীচে অতি তীব্র মাত্রার ভূমিকম্প হলেও এ বার তার জেরে সুনামি হয়নি।
ভূ-বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভারত মহাসাগর এবং প্রশান্ত মহাসাগরের নীচে এমন কিছু এলাকা রয়েছে, যা বরাবরই ভূমিকম্পপ্রবণ। যেমন, ভারত মহাসাগরের ইন্দোনেশিয়া-জাভা-সুমাত্রা খাত (ট্রেঞ্চ)। অন্যটি প্রশান্ত মহাসাগরে জাপান খাত। ইন্দোনেশিয়া খাতে ভারতীয় প্লেট (পাত) এবং সুন্দা প্লেট-এর মধ্যে প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতা চলছে। কে কার নীচে চলে যেতে পারে বা উপরে উঠে যেতে পারে! আর জাপান খাতে একই ধরনের প্রতিযোগিতা চলছে প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্লেট এবং ইউরেশীয় প্লেটের মধ্যে। প্রতি বার ঘর্ষণের সময়ে প্রচুর শক্তি উদ্ভূত হচ্ছে। সেই শক্তি সঞ্চিত হচ্ছে সমুদ্রের নীচে। সেই শক্তি যখন সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখনই দু’টি প্লেটের একটি হয় অন্যটার উপরে আড়াআড়ি উঠে বা নেমে যায় (ভার্টিকাল শিফট), না হলে একে অপরের উপরে পিছলে যায় (হরাইজন্টাল শিফট)।
প্রাণ বাঁচাতে দৌড়। বুধবার ভূমিকম্পের পরে সুমাত্রায়। ছবি: এএফপি
২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর ৯.৩ মাত্রার ভূমিকম্পে ভারতীয় প্লেটটি সুন্দা প্লেটের অন্তত ১৫ মিটার আড়াআড়ি নীচে চলে গিয়েছিল। তার জেরে দু’টি প্লেটের মাঝখানে তৈরি হয়েছিল শূন্যস্থান। খড়্গপুর আইআইটি-র ভূবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শঙ্করকুমার নাথ বলেন, “প্রকৃতিতে শূন্যস্থান থাকে না। সমুদ্রের নীচে তৈরি হওয়া শূন্যস্থানে নানা দিক থেকে জল এসে ঢোকে। ভূমিকম্পের ফলে নির্গত শক্তি সেই জলরাশিকে ঠেলে দেয় উপরে। তৈরি হয় সুনামি। ২০০৪ সালে সেটাই হয়েছিল।”
কী কারণে এ বার রক্ষা পাওয়া গেল?
শঙ্করবাবু, জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার অবসরপ্রাপ্ত ভূবিজ্ঞানী জ্ঞানরঞ্জন কয়াল এবং প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূবিদ্যা বিভাগের প্রধান হরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের ব্যাখ্যা, “এ বার প্রায় একই জায়গায় তীব্র ভূমিকম্প হলেও একটি প্লেট অন্যটির উপরে আড়াআড়ি উঠে যায়নি। একটি অন্যটির উপরে পিছলে গিয়েছে মাত্র।
তাতেই সুনামি এড়ানো গিয়েছে।” শঙ্করবাবু বলেন, “এ বার ভারতীয় এবং সুন্দা প্লেট প্রায় পাশাপাশি থাকায় কোনও শূন্যস্থান তৈরি হয়নি। ফলে জলরাশির অবস্থানের কোনও পরিবর্তন হয়নি। তাই সুনামিও হয়নি। তবে যে মাত্রার ভূমিকম্প এ দিন হয়েছে, তা থেকে সুনামির আশঙ্কা ছিলই। তাই সতর্কতা জারি করা হয়েছিল সঙ্গে সঙ্গেই।”
এক ভূবিজ্ঞানীর ব্যাখ্যা, জলের মধ্যে দু’হাত দিয়ে যদি চাপড় মারা যায়, তা হলে জলে তরঙ্গ সৃষ্টি হয়। কিন্তু যদি দু’হাত দিয়ে জল সরানো যায়, তা হলে জল তেমন আন্দোলিত হয় না। প্রথমটা সুনামির ক্ষেত্রে হয়। দ্বিতীয়টা এ দিন যা হয়েছে।
এ দিনের ভূমিকম্পে (ইন্দোনেশিয়ার বান্দা আচে থেকে ৩৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে, সমুদ্রের ৩৩ কিলোমিটার নীচে) ঠিক কত শক্তি নির্গত হয়েছিল? জ্ঞানরঞ্জনবাবু বলেন, “৮.৬ মাত্রার ভূমিকম্পে নির্গত শক্তির মাত্রা কমপক্ষে ২ কোটি পরমাণু বোমা (হিরোশিমায় যা ফেলা হয়েছিল)-র শক্তির সমান।” এবং এত শক্তির ভূমিকম্পে সুমাত্রা থেকে পাপুয়া নিউগিনি কেঁপে উঠলেও, কলকাতা বা সুদূর মিজোরামে কম্পন হলেও ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো গিয়েছে। শঙ্করবাবুর ব্যাখ্যা, “ভূমিকম্পটা হয়েছে সমুদ্রের গভীরে। সুনামি হলে বা ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল স্থলভূমিতে হলে (যেমন সেপ্টেম্বরে সিকিমে হয়েছিল) পরিণতি অন্য রকম হত। তা না হওয়ায় স্থলভূমিতে তেমন কোনও প্রভাব পড়েনি। কম্পনের যে ধাক্কাটা স্থলভূমিতে এসে পড়েছে, তার ধ্বংসাত্মক শক্তিও তেমন ছিল না।” ভারত মহাসাগরের নীচে ইন্দোনেশিয়া খাতে প্রতি নিয়তই ভূমিকম্প হয়ে চলেছে। তার কোনও প্রভাবই স্থলভূমিতে পড়ে না বলে জানিয়েছেন শঙ্করবাবু।
প্রথম ভূমিকম্পের দু’ঘণ্টার মধ্যে (ভারতীয় সময় বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ) সুমাত্রায় ওই একই জায়গায় ফের একটি ৮.২ তীব্রতার কম্পন অনুভূত হয়েছে। শঙ্করবাবু জানাচ্ছেন, দ্বিতীয় কম্পনটি ভূকম্প-পরবর্তী কম্পন (আফটার শক)। আইআইটি খড়্গপুরের ওই ভূবিজ্ঞানী বলেন, “এত বড় একটা ভূমিকম্পের পরে এখন ঘন ঘন কয়েকটি ‘আফটার শক’ হবে গোটা অঞ্চল জুড়ে। এ দিনই ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে পর পর ৬, ৫.৪ এবং ৮.২ মাত্রার তিনটি ‘আফটার শক’ হয়েছে। কয়েক বছর ধরে এমনটা চলবে।” ২০০৪ সালে সুমাত্রার ৯.৩ ভূমিকম্পের জেরে ২০০৬ সালের জুলাই মাসেও ৭.৮ মাত্রার ‘আফটার শক’ রেকর্ড করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন শঙ্করবাবু। এ দিনের এই তীব্র ভূমিকম্প ভূ-বিজ্ঞানীদের গবেষণার নতুন রাস্তা খুলে দিচ্ছে। কী ভাবে? জাপান সংলগ্ন প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল এবং ইন্দোনেশিয়া-জাভা-সুমাত্রায় ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল ভূমিকম্পপ্রবণ হলেও সেখানে দু’টি অতি তীব্র ভূমিকম্পের মধ্যে সাধারণত ১০০-১৫০ বছরের ব্যবধান ছিল। কিন্তু সুমাত্রার প্রায় একই অঞ্চলে সাড়ে সাত বছরের মধ্যেই কী ভাবে আর একটি অতি তীব্র ভূমিকম্প তৈরি হল, তা অবাক করেছে ভূবিজ্ঞানীদের একাংশকে।
জ্ঞানরঞ্জনবাবু বলেন, “২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর সুমাত্রায় ভারত মহাসাগরের নীচে হওয়া ভূমিকম্পের পরে আমরা অনেকে ধরেই নিয়েছিলাম ১০০ বছরের মধ্যে ওই এলাকায় আর বড় ধরনের কোনও ভূমিকম্প হবে না। কিন্তু আমাদের সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত হল। আমরা ভেবেছিলাম, দু’টি প্লেটের মধ্যে ঘর্ষণে সমুদ্রের তলদেশে যে প্রচণ্ড শক্তি সঞ্চিত হচ্ছে, ২০০৪ সালে তার অধিকাংশই সুনামির সঙ্গে বেরিয়ে গিয়েছে। এখন দেখা গেল, তা হয়নি। অনেকটা শক্তি সেখানে সঞ্চিত থেকে গিয়েছিল।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.