লোকমুখে খবরটা ছড়িয়ে পড়েছিল। অনেকেই অবশ্য বিশ্বাস করতে পারেননি। নিশ্চিত হওয়ার জন্য তাঁরা পরিচিত তৃণমূল নেতা-কর্মীদের ফোন করেছিলেন। আর মনে মনে প্রার্থনা করছিলেন, খবরটা যেন মিথ্যা হয়। তা অবশ্য হয়নি। মঙ্গলবার বেলা বাড়তেই সকলে জানতে পারলেন, কাশীনাথ মিশ্র আর নেই।
বাঁকুড়ার পাঁচ বারের বিধায়ক, নির্বিরোধী মানুষটির মৃত্যুর খবরে শোকের ছায়া নেমে এসেছে বাঁকুড়ায়। এ দিন সকাল থেকে জনবহুল থাকা বাঁকুড়া শহরের রাস্তা-বাজার দুপুরের পর থেকে কেমন নিস্তেজ হয়ে পড়ে। চায়ের দোকান থেকে অফিসের টেবিল--সর্বত্রই এ দিন একটা বিষয়েই আলোচনা হয়েছে-কাশীনাথবাবুর মৃত্যু। |
পেশায় আইনজীবী কাশীনাথবাবু দীর্ঘদিন বাঁকুড়া আদালতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এক বছর আগে তাঁর খাদ্যনালীতে ক্যান্সার ধরা পড়ে। কিন্তু সেই অবস্থাতেই তাঁকে নিয়মিত আদালত চত্বরে তাঁর সেরেস্তায় দেখা গিয়েছে লোকজন পরিবৃত অবস্থায়। দূরদূরান্ত থেকে আসা লোকজনদের সমস্যার কথা মন দিয়ে শুনেছেন। তাঁদের সমস্যা মেটাতে কখনওকোনও থানায় ফোন করেছেন। কখনও বা দরিদ্র ব্যক্তিকে কাপড় কিংবা সামান্য চাল দেওয়ার জন্য নিজেই জেলাশাসকের দফতরে গিয়েছেন। তাঁর ঘনিষ্ঠজনেরাই বলতেন, কাশীবাবুর সেরেস্তায় বিচারপ্রার্থীদের থেকে তাঁর সাহায্যপ্রার্থীর সংখ্যাই বেশি। কাশীনাথবাবুর মৃত্যুর খব৬র আসার পরে এ দিন বাঁকুড়া আদালতের আইনজীবীরা কাজে যোগ দেননি। তাঁর মৃত্যুর খবর পেয়ে দলের কয়েকজন জেলা নেতা ও কর্মীরা কলকাতায় রওনা দেন। দলের বাকি কর্মীরা সারা দিন ধরে প্রিয় নেতার দেহ আসার অপেক্ষায় ছিলেন। |
কাশীনাথবাবুর ঘনিষ্ঠজন ও পরিবার সূত্রে জানা যায়, তাঁর রাজনীতির প্রথমপাঠ বাঁকুড়া খ্রিস্টান কলেজে ছাত্রপরিষদের হাত ধরে। তারপরে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে রাজনীতির কাজে আরও জড়িয়ে পড়েন। তৎকালীন কংগ্রেসি ছাত্রনেতা প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সির সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। এরপর ধাপে ধাপে তাঁর রাজনৈতিক কেরিয়ারের উত্থান শুরু হয়। ঘনিষ্ঠতা বাড়ে সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেও। ১৯৭২-২০০৯ সাল পর্যন্ত তিনি আইএনটিইউসি’র জেলা সভাপতি ছিলেন। ১৯৭১-’৭৪ সাল পর্যন্ত তিনি যুব কংগ্রেসের জেলা সভাপতি ও রাজ্য সহ সভাপতি ছিলেন। প্রথমবার ১৯৭১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে লড়াই করে তিনি বিধায়ক হন। পরে ১৯৭২ ও ১৯৮২ সালেও তিনি বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন। ২০০০ সালে তিনি তৃণমূলে যোগদান করেন। ২০০১-২০০৯ সাল পর্যন্ত তৃণমূলের জেলা সভাপতির পদে ছিলেন। সেই সময় সিপিএমের শক্তঘাঁটি বাঁকুড়া জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে তিনি কার্যত চষে বেড়িয়েছেন। দলীয় সংগঠন মজবুত করার জন্য সমস্যাপীড়িত কর্মীদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। ২০০১ ও ২০১১-তে কাশীবাবু এই কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের বিধায়ক হন। রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী পার্থ দে’র সঙ্গে তাঁর কয়েক বার নির্বাচনী লড়াই হয়। ২০১১ সালে কাশীনাথবাবু তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী সিপিএমের প্রতীপ মুখোপাধ্যায়কে প্রায় ২৯ হাজার ভোটে হারান। জেলার ১২টি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে তিনিই সবোর্চ্চ ব্যবধানে জয়ী হন। |
তবে পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির কাশীনাথবাবুর সঙ্গে অন্য রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের সুসম্পর্ক ছিল। সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর কমিটির সদস্য প্রতীপ মুখোপাধ্যায় বলেন, “এই দিনটি আমার কাছে অত্যন্ত শোকের দিন। কাশীনাথবাবুকে ব্যক্তিগত ভাবে খুব শ্রদ্ধা করতাম। তিনি একজন জননেতা ছিলেন।” জেলা কংগ্রেস সভাপতি ব্রজবাসী বিশ্বাস কয়েকবার কাশীনাথবাবুর বিধানসভা নির্বাচনী এজেন্ট ছিলেন। এ দিন তিনি বলেন, “আমরা অভিভাবকহীন হয়ে পড়লাম। কাশীনাথবাবু শুধু কোনও একটি দলের নেতা ছিলেন না, জেলার অন্যান্য রাজনীতিকদের কাছেও অভিভাবকের মতো ছিলেন।” এ দিন রাতে বাঁকুড়া শহরের নতুনগঞ্জে দলীয় অফিসের সামনে তাঁর মরদেহ নিয়ে আসা হয়। তিনি যে সত্যি জননেতা ছিলেন, সেখানে ফের সেই দৃশ্য দেখা গেল। কংগ্রেস, তৃণমূল, সিপিএম-সহ বিভিন্ন দলের নেতা-কর্মীরা তাঁকে শ্রদ্ধা জানালেন। তৃণমূলের জেলা সভাপতি অরূপ খাঁ বলেন, “এক বর্ষিয়ান নেতাকে আমরা হারালাম। কাশীনাথবাবু মৃত্যুতে আমাদের দলের প্রচণ্ড ক্ষতি হল।” |
মনে পড়ে |
কাশীনাথবাবুকে ব্যক্তিগত ভাবে খুব শ্রদ্ধা করতাম। তিনি একজন জননেতা ছিলেন।
প্রতীপ মুখোপাধ্যায়
সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য |
এক দক্ষ সংগঠককে আমরা হারালাম। তাঁর মৃত্যুতে দলের প্রচণ্ড ক্ষতি হল।
অরূপ খাঁ
জেলা তৃণমূল সভাপতি |
আমরা অভিভাবকহীন হয়ে পড়লাম। সব দলের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক ছিল।
ব্রজবাসী বিশ্বাস
জেলা কংগ্রেস সভাপতি |
—নিজস্ব চিত্র। |
|
বাঁকুড়া শহরের রবীন্দ্র সরণিতে কাশীনাথবাবুর পড়শিরাও শোকাতুর। হাসপাতালে কাশীনাথবাবুর কাছে ছিলেন তাঁর স্ত্রী অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষিকা মিনতি মিশ্র। তাঁদের মেয়ে সাখী ভট্টাচার্য ও জামাই রূপক ভট্টাচার্য বাঁকুড়ায় ছিলেন। জামাই জানান, এক বছর কাশীনাথবাবুর খাদ্যনালীতে ক্যান্সার ধরা পড়ে। দিল্লির এইমস-এ অস্ত্রোপচার করার পরে সুস্থ হয়ে ওঠেন। নির্বাচনী প্রচারে প্রচণ্ড পরিশ্রম করায় ফের অসুস্থ হয়ে পড়েন। চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি তাঁকে এসএসকেএমে ভর্তি করানো হয়। কিছুটা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার দু’দিন পরে আবার তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। দুর্গাপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতাল ও পরে এসএসকেএমে তাঁকে ভর্তি করানো হয়।” তিনি বলেন, “কিছুটা সুস্থ হওয়ায় এমএলএ হস্টেলে তাঁকে রাখা হয়। কিন্তু শনিবার তাঁর অবস্থার অবনতি হওয়ায় এসএসকেএমে ভর্তি করানো হয়। কিন্তু এ বার তিনি যে আর সুস্থ হয়ে ফিরবেন না, আমরা ভাবতে পারিনি।” পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে কাশীনাথবাবু সেজ ছিলেন। তাঁর ছোট ভাই রামপ্রসাদ মিশ্রের আক্ষেপ, “দাদা সারা জীবন রাজনীতি করলেও প্রাপ্য মর্যাদা পেলেন না।”
আক্ষেপটা জেলার অনেকেরও! |