জরাজীর্ণ বাড়িটির দেওয়ালের ইট বেরিয়ে কদর্য চেহারা নিয়েছে। দেওয়ালে দেওয়ালে আগাছা। ঝোপ-জঙ্গলে ঢেকে গিয়েছে ধ্বংসস্তূপের আকার নেওয়া বাড়িটি। সাপখোপের আড্ডা সর্বত্র। উত্তর ২৪ পরগনার গোপালনগরের চৌবেড়িয়া গ্রামে এই বাড়িতেই জন্মেছিলেন ‘নীলদর্পণ’-এর স্রষ্টা দীনবন্ধু মিত্র। সেটা ১৮২৯ সালের ১০ এপ্রিলের কথা। মঙ্গলবার ছিল তাঁর জন্মদিন। পরিবারের তরফে বাড়ির সামনে বসানো লেখকের আবক্ষ মূর্তিতে মালা দেন। এমন অনাদরেই প্রতি বছর পালিত হয়ে আসছে দীনবন্ধুর জন্মদিনটি।
কয়েক বছর আগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয় সেবা প্রকল্পে কঙ্কালসার বাড়িটির সামনে একফালি জমিতে দীনবন্ধুর মূর্তিটি স্থাপিত হয়েছিল। এ বাদে বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ কিংবা জন্মভিটেয় তাঁর জন্মদিন পালনের কোনও উদ্যোগ সরকারি ভাবে চোখে পড়েনি। বাড়ি মেরামতের ‘ক্ষমতা’ নেই লেখকের বংশধরদের। পরিবার সূত্রে জানা গেল, ১০১০ সালে রাজ্য সরকার বাড়িটিকে ‘হেরিটেজ’ ঘোষণা করে। তারপর কাজ কিছু এগোয়নি। সম্প্রতি অবশ্য সরকারের তরফে কিছু উদ্যোগ চোখে পড়ছে বলে জানালেন দীনবন্ধুর বংশধর সঞ্জিত মিত্র। তিনি বলেন, “কিছু দিন আগে হেরিটেজ কমিশনের তরফে বাড়িটি মাপজোক হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীও বাড়িটি সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছেন।” সঞ্জিতবাবু জানান, স্থানীয় বিধায়ক সুরজিৎ বিশ্বাসের মাধ্যমে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে সম্প্রতি কিছু প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। বাড়ি সংস্কার করে পুরনো আদলে ফিরিয়ে আনা ছাড়াও একটি সংগ্রহশালা এবং গবেষণাগার তৈরির আবেদন আছে সেখানে। বনগাঁ দক্ষিণ কেন্দ্রের বিধায়ক সুরজিৎবাবু বলেন, “মার্চ মাসে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখে বাড়িটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করা হয়েছে। তথ্যসংস্কৃতি দফতরের মাধ্যমে লেখকের জন্ম ও মৃত্যুদিনটি মর্যাদার সঙ্গে পালনেরও আবেদন করা হয়েছে। পাশাপাশি তাঁর পরিবারের দাবিগুলিও মুখ্যমন্ত্রীকে জানিয়েছি।”
চৌবেড়িয়ায় এই বাড়িতেই ছেলেবেলা কেটেছে দীনবন্ধুর। এই বাড়িতে এসেছেন ঈশ্বর গুপ্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-সহ বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। এখানে বসেই নীলদর্পণ নাটকের কিছু অংশ লিখেছিলেন দীনবন্ধু। যে ঘরটিতে তিনি জন্মেছিলেন, সেটি আজ আর নেই। দীনবন্ধুর প্রাথমিক শিক্ষাও এই গ্রামের পাঠশালায়। বাল্য শিক্ষা শেষ করে বাবা কালাচাঁদ মিত্রের সঙ্গে তিনি চলে গিয়েছিলেন কলকাতায়। যদিও গ্রামের সঙ্গে ছিল তাঁর নাড়ির টান। বার বার ফিরে এসেছেন এই পৈতৃক ভিটেয়। এই এলাকাতেই তিনি দেখেছেন চাষিদের উপরে নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের দৃশ্য।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেল, অতীতে রাজ্যের বহু নেতা-মন্ত্রী এসেছেন এখানে। তাঁদের কাছে আবেদন জানিয়েও কোনও সুরাহা হয়নি। পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম দীনবন্ধুর নামে রাখার দাবি ওঠে পরিবারের তরফে। সেই দাবিও রাখা হয়নি। বাড়িতে এখন লেখকের একটি বড় ছবি ছাড়া আর কিছুই নেই। বছরভর দূরদূরান্ত থেকে অনেকে আসেন এই বাড়ি দেখতে। গ্রামে অবশ্য দীনবন্ধুর নামে একটি উচ্চ বিদ্যালয় ও তাঁর স্ত্রী অন্নদাসুন্দরীর নামে একটি বালিকা বিদ্যালয় তৈরি হয়েছে। বনগাঁয় দীনবন্ধুর নামে একটি কলেজ তৈরি হয়েছে। সঞ্জিতবাবু জানান, বাড়ি ও সংশ্লিষ্ট জমি তাঁরা সরকারের হাতে তুলে দিতে রাজি। |