|
|
|
|
‘সূর্যোদয়ে’ ম্লান দীপক, নানা জল্পনা জেলা-দলে |
বরুণ দে • মেদিনীপুর |
দলের পলিটব্যুরোয় তাঁদের ‘সূর্যদা’ সদস্য হওয়ায় স্বভাবতই খুশি পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সিপিএমে তাঁর ঘনিষ্ঠরা। আর এই ‘সূর্যোদয়ে’ই কিছুটা যেন ম্লান জেলা সিপিএমের ‘দোর্দণ্ডপ্রতাপ’ সম্পাদক দীপক সরকার। কয়েক বছর আগে রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর পরবর্তী পার্টি কংগ্রেসে দীপকবাবুর কেন্দ্রীয় কমিটিতে যাওয়া নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছিল। সে তো হলই না, উপরন্তু প্রচার ও নানা মহলের চেষ্টা সত্ত্বেও রাজ্য সম্মেলনে রাজ্য কমিটিতেও অন্তর্ভুক্ত হতে পারেননি দীপক-ঘনিষ্ঠ সুশান্ত ঘোষ। দীপকবাবুর এই অবস্থাতেই মেদিনীপুর-সিপিএমে তাঁর বিপরীত শিবিরের নেতা হিসাবে পরিচিত সূর্যবাবুর ক্রমান্বয়ে উত্থান চোখে পড়ার মতোই।
প্রথমে বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা। এবং সেই ভূমিকায় ‘সাফল্য’। তার পর পলিটব্যুরোয় অন্তর্ভুক্তি। মাত্রই এগারো মাসের মধ্যে সংসদীয় রাজনীতি এবং দলীয় সংগঠনে গুরুত্ব বহু গুণ বেড়েছে মিতভাষী অথচ সুচিন্তিত বক্তব্যে দড় সূর্যবাবুর। ইতিমধ্যে আবার পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় দলের কাজকর্মের তদারকিও শুরু করেছেন তিনি। যা রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীয় সদস্য হিসাবে গত কয়েক বছর ধরে করছিলেন দীপকবাবুই। দীপকবাবুর ‘ভূমিকা’ নিয়ে দলের অভ্যন্তরেই নানা প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছিল। বিশেষত, রাজ্যে দল ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরে। এমনকী পশ্চিম মেদিনীপুরেও বিধানসভা ভোটে বিপর্যয় রুখতে পারেননি তিনি। জঙ্গলমহল-সহ সার্বিক প্রেক্ষিতেই ‘সক্রিয় প্রতিরোধ’-এর যে তত্ত্ব দীপকবাবুরা গত কয়েক বছর ধরে পেশ করছিলেন, তা সমালোচিত হয়েছে এমনকী জেলা সম্মেলনেও। অথচ এই তত্ত্ব এক সময়ে রাজ্য-দলেও গতি পাচ্ছিল। যে কারণে দীপকবাবুকে দিল্লিতে নিয়ে গিয়েও বক্তৃতা করানো হয়েছিল। জনতার ভোটে সেই তত্ত্ব খারিজ হয়ে গিয়েছে। উল্টে নেতাইয়ের মতো ‘কাঁটা’ তৈরি হয়েছে গোটা দলের জন্যই।
এই অবস্থায় জেলা-পার্টিতে দীপকবাবুর বিরোধী-শিবিরের নেতা-কর্মীরা সূর্যবাবুর পলিটব্যুরোয় অন্তর্ভুক্তিতে উৎসাহিত হবেন বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল। নিজের বিরোধীদের এক-ঘরে রাখার অভিযোগ দীপকবাবুর বিরুদ্ধে অনেক দিনের। বিশেষত সূর্যবাবু ১৯৯১-এ বিধায়ক ও মন্ত্রী হয়ে জেলা ছেড়ে রাজ্য-রাজনীতিতে পা রাখার পর থেকেই জেলা-পার্টিতে দীপকবাবুর একচ্ছত্র আধিপত্য। এক সময়ে সূর্যবাবুর ঘনিষ্ঠ তরুণ রায় জেলা সম্পাদক হওয়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে ছিলেন। সেই তরুণবাবুদেরও জেলায় কিছুটা গুরুত্বহীন করে দিয়ে দলের মধ্যেও ‘দোর্দণ্ডপ্রতাপ’ তৈরির অভিযোগ বারে বারেই উঠেছে দীপকবাবুর বিরুদ্ধে। সেই একচেটিয়া কর্তৃত্বের অবসানের আশাতেই এখন দলের মধ্যে গণতন্ত্রের দাবিদারেরা।
সূর্যকান্ত মিশ্রের রাজনীতির হাতেখড়ি সেই ছাত্রাবস্থায়। নারায়ণগড়ের খাকুড়দায় বাড়ি। পড়াশোনা খাকুড়দা বড়মোহনপুর হাইস্কুলেই। স্কুলের পাঠ শেষ করে ডাক্তারি পড়তে যান ওড়িশার মেডিক্যাল কলেজে। চিকিৎসক হিসেবেও এলাকায় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। ভাল বক্তব্য রাখতেন। মানুষের সঙ্গেও সহজে মিশে যেতেন। তাই, রাজনীতিতে আসার কিছু দিনের মধ্যেই নেতৃত্বের নজরে পড়েন। ১৯৭৭ সালের বিধানসভা ভোটে নারায়ণগড় থেকেই প্রথম প্রার্থী হন। সে বার অবশ্য কংগ্রেসের প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন। পরের বছরই অর্থাৎ ’৭৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটে জেলা পরিষদের আসনে তাঁকে ফের প্রার্থী করা হয়। প্রথম বার জেলা পরিষদের আসনে জিতেই অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার সভাধিপতি হন। টানা ১৩ বছর ছিলেন জেলা সভাধিপতি। তার পর ’৯১ সালে রাজ্য মন্ত্রিসভায় গিয়ে ক্রমান্বয়ে ভূমি ও ভূমি সংস্কার, পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন এবং পরবর্তীতে স্বাস্থ্য দফতরেরও দায়িত্ব সামলান। স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসাবে অবশ্য অনেক বারই তাঁকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। কিন্তু বিনয় চৌধুরীর উত্তরসূরি হিসাবে ভূমি দফতর এবং পরে পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতরের গুরু-দায়িত্ব সামলানোর জন্য তাঁকেই যোগ্য মনে করেছিল পার্টি। তাঁর জেলা সভাধিপতিত্ব কালীনই মেদিনীপুরে শুরু হয়েছিল সাক্ষরতা অভিযান।
একটা সময় দাঁতন, নারায়ণগড়, কেশপুর, মেদিনীপুর-সহ বিস্তীণর্র্ এলাকায় সিপিএমের নেতৃত্বে ছিলেন সূর্যবাবুর ঘনিষ্ঠরাই। বিশেষ করে, ২০০৪ সাল থেকে দীপকবাবু তাঁদের গুরুত্বহীন করতে শুরু করেন বলে অভিযোগ। নিজের অনুগামীদের নিয়েই তিনি দল চালাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। বিগত জেলা সম্মেলনেও গোষ্ঠী-রাজনীতি এবং অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের অভাব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ বার দলের মধ্যে প্রশ্নগুলো আরও গতি পাবে বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল। |
|
|
|
|
|