প্রবন্ধ ২...
কান ধরে ওঠবোস শৃঙ্খলা আসবে তো
শোভাবাজার থেকে উল্টোডাঙাগামী যানটির চালক উঠবার সময়েই যাত্রীকে বলে দিচ্ছে ‘দশ টাকা, দশ টাকা’। বিনাবাক্যব্যয়ে উঠলেন তিন জন। চতুর্থ জন ওঠবার মুখে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেন? দশ টাকা কেন? ভাড়া তো আট টাকা।’ ‘হেঁটে যান’, নির্বিকার মুখে জবাব দিল চালক। অপমানিত যাত্রীটি একটু সরে দাঁড়াতেই ফাঁক পেয়ে উঠে পড়লেন অন্য এক জন। যান চলতে শুরু করল। শব্দবিধির তোয়াক্কা না করে উচ্চগ্রামে গান চালিয়ে দিল ছেলেটি। হাতিবাগান থেকে চালকের ডান পাশে বসে গেল তার কোনও ভাইবেরাদর। ‘স’-কার ‘ম’-কার সহযোগে গল্প জুড়ে দিল। গৌরীবাড়ি পেরোতেই সামনের আসনে বসা যাত্রীটির মোবাইল বেজে উঠল। তিনি মুঠোফোনটি কানে চেপে ধরলেন। তাঁর কথা নিশ্চয় অন্য প্রান্তে শোনা যাচ্ছিল না। তিনি এক বার হাত নেড়ে গানের গুঁতো কমানোর অনুরোধ জানালেন চালককে। সে নির্বিকার মুখে পান পরাগ চিবিয়ে যাচ্ছে। শেষে কান থেকে মোবাইল সরিয়ে অতীব বিনীত ভঙ্গিতে অনুরোধ জানালেন প্রবীণ মানুষটি, ভাই একটু কমাবে ভাই, খুব দরকারি ফোন। আওয়াজ একটু কমল। কোনও রকমে কথা সারলেন ভদ্রলোক। আবার শুরু হয়ে গেল গাঁকগাঁক। এমন ধাতব আওয়াজ, মনে মনে চিন্তাভাবনা করাও দায়। শোভাবাজার থেকে উল্টোডাঙাগামী অটোর নিত্যযাত্রীদের এই অভিজ্ঞতা দৈনন্দিন। শুধু শোভাবাজার-উল্টোডাঙা কেন? শহরের উত্তর থেকে দক্ষিণে চালকদের এই ‘অটোক্র্যাসি’ এমনই সমসত্ত্ব ভাবে কদর্য এবং অপমানকর। যে কোনও সুস্থ মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে, শান্ত অশান্ত হয়ে ওঠে, নিরীহ মানুষেরও রক্তে খুন চেপে যায়। সে জন্যই এই অরাজক চালকদের ‘শায়েস্তা’ করতে আইনসভার সদস্য, বিধায়ক পরেশ পাল চড়-থাপ্পড় চালালে তার সমর্থনে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে ‘মন্তব্যের ঝড় ওঠে’। নিত্যযাত্রীরা তো বটেই, যাঁরা মুখে বলেন এক জন বিধায়কের এই ভাবে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া ঠিক নয়, তাঁদের অধিকাংশই হয়তো মনে মনে বলেছেন, বেশ করেছে।
নিজেদের দাবি, ক্ষোভ জানাতে অটোচালকরা শহর-শহরতলির বিস্তীর্ণ এলাকা অবরুদ্ধ করলেও, বাস ভাঙচুর করলেও যাত্রীদের ভয় দেখিয়ে বাস থেকে নামিয়ে দিলেও, প্রত্যাশিত ভাবে তাঁদের পক্ষ এবং বিপক্ষের মতামতে আলোড়িত পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি। শাসক দলের নেতা যখন নৈরাজ্য ছুড়ে দেওয়া চালকদের ‘অন্যায় অবরোধ’ তুলতে কান ধরে ওঠবোস করাচ্ছেন, বিরোধী সিটু নেতা ভাঙচুর চালানো ২৮ জন অটোচালকের পক্ষে দাঁড়িয়ে বলেছেন, ‘...বিক্ষোভ দেখাতে গিয়ে, তারা একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। কিন্তু তাদের জেলে পাঠানো অন্যায় হবে।’
এ ছবি পুরনো। কয়েক বছর আগে তেলে চলা অটো-কে গ্যাস-যানে রূপান্তরিত করার সময়ে চালকদের থেকে নানান অজুহাতে বাধা আসে। সে সময়কার বিরোধী দল তৃণমূল কংগ্রেস তখন এমনই সহানুভূতি, সমর্থন নিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল চালকদের পাশে। চালকরাও তাই জেনে গেছে, কখন পতাকা পাল্টাতে হবে। আগে যে সব অটো মাথায় লাল পতাকা গুঁজে চলত, ভোটের পরে পরেই তারা প্রায় সবাই পরে নিল তেরঙা-তৃমমূল। এখন যদি এরা আবার বিরোধী সমর্থন পেতে থাকে, ক’দিন পরেই তারা আবার পরে নেবে ছেড়ে রাখা আভরণ! যেহেতু এদের সংখ্যাটা ষাট-সত্তর হাজার, সে জন্য ভোট ময়দানের লাল-তেরঙা কেউ এদের উপেক্ষা করতে পারে না।
অথচ সমস্যাটা একটু তলিয়ে ভাবা দরকার। ভারত সরকারের নগর উন্নয়ন মন্ত্রকের ২০০৮-এর হিসেব অনুযায়ী মুম্বইতে চলে ১,৬০,০০০ অটো, দিল্লিতে ৬৫,০০০, হায়দরাবাদে ৫০,০০০, বেঙ্গালুরুতে ৮০,০০০ এবং কলকাতায় ৬০,০০০। মুম্বইয়ে এক লক্ষ জনসংখ্যা পিছু ১২০০ অটো, দিল্লিতে লাখ পিছু ৫০০, হায়দরাবাদে ৪০০, বেঙ্গালুরুতে ৬০০ এবং কলকাতায় লাখ পিছু ৩০০। মুম্বই অটো এক-একটি ‘ট্রিপে’ গড়ে ১৫-১৬ কি.মি. অতিক্রম করে, দিল্লিতে তা ৬ কি.মি., হায়দরাবাদে ১০ কি.মি., বেঙ্গালুরুতে ৯ কি.মি. এবং কলকাতায় ৯ কি.মি.। এই শহরগুলির মধ্যে একমাত্র কলকাতার অটো রিকশাই প্রায় প্রথম থেকেই মিটারে চলে না। আইন ভেঙেই এর যাত্রা শুরু। ক্রমশ দেখা গেল যেন তেন প্রকারেণ ছাড়পত্র পাওয়া অথবা না পাওয়া কিছু কদর্য বাচনভঙ্গি এবং শরীরভাষা লুম্পেন অটো-চালক হয়ে উঠেছে। যাত্রীরা তো বটেই, তাদের ভয় পায় বড় বাস, ট্যাক্সি, এমনকী, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বলে, পুলিশও। কারণ এদের নেপথ্যে আছেন লালরঙা, তেরঙা ইউনিয়নের দাদারা। ইউনিয়নের অসীম ক্ষমতা তারাই ভাড়া ঠিক করে, রুট ঠিক করে এবং চালক নির্বাচন করে। দাদার কথার অবাধ্য হলে চালককে দু’পাঁচ দিন ‘বসিয়ে’ দেওয়া হয়। চালকদের ঠিক রাজনীতি না শিখিয়ে ক্রমাগত প্রশ্রয় দেওয়া হয় লুম্পেন রাজনীতির। ক্রমশ দেখা গেল, একই নম্বরের একাধিক বেআইনি অটো রাস্তায় নেমে পড়েছে। চালক হতে ইচ্ছুক কোনও গরিব বেকার যুবক ‘দাদার দয়া’য় কী ভাবে সহজেই লাইসেন্স জুটিয়ে নেয়, তা জানতে আণবিক গবেষণার দরকার হয় না। আধবেলা অটো-ইউনিয়ন অফিসে বসলেই চলে। পরিবর্তে যুবকটিকে দিতে হয় আনুগত্য।
রোজগার কমে যাওয়া অটোচালকরা পাঁচ জন যাত্রী নেওয়ার দাবি জানিয়েছে। তুলনা টানা হচ্ছে ভিড় বাস, ট্রামের সঙ্গে। তিন চাকার অটোর দোদুল্যমান নিরাপত্তার সঙ্গে অন্য দু’টি সুদৃঢ় চাকার যানের তুলনা টানাটাই কুযুক্তি। সেই বিচারে মনে হয়, ভাড়া বাড়ানোটাই আপাতত অটো চালকের ক্ষোভ প্রশমনের এক মাত্র উপায়। যেখানে আট টাকার জায়গায় এখনই দশ টাকা নিয়ে থাকে বহু চালক। যাত্রীরা দেনও। বাড়তি নেওয়ার কারণে কোনও অটো-ই খালি পড়ে থাকে না। সুতরাং গ্যাসের দাম বাড়ার কারণে ‘আইনসিদ্ধ ভাবে’ সে রুটের ভাড়া দশ টাকা করলে নিত্যযাত্রীদের খুব কিছু গায়ে লাগবে না। কারণ এই বাহনে আসনে বসে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছনো যাচ্ছে। যা বাসে সব সময় সম্ভব নয়। এ জন্য বাসের থেকে বেশি ভাড়া দিয়ে অটোয় চাপতে রাজি অনেকেই। কিন্তু তৃণমূল-ইউনিয়ন কোনও এক ব্রাহ্ম মুহূর্তে, কী এক শপথ নিয়ে ফেলেছেন ভাড়া বাড়াবেন না, অতএব তাঁদের অনড় অবস্থার মুখোমুখি ক্ষুব্ধ অটো-চালক। সমস্যা গুরুতর হতে এগিয়ে এসেছেন পরিবহণমন্ত্রী। তিনি জানিয়েছেন, এদের যাত্রী-সংখ্যা ঠিক করে দেবে রাজ্য সরকার। বেআইনি ঠিকানা এবং লাইসেন্স লিখে রাখার ব্যবস্থার কথাও ভাবা হচ্ছে। কিন্তু সমস্যা এমন বহিরঙ্গের নয়, ভেতরের। আটাশ টাকা ভাড়া হলে মুম্বইয়ের অটোচালক আটাশ টাকাই ভাড়া নেবেন। কোনও বাড়তি যাত্রী নেওয়ার প্রশ্নই নেই। দিল্লি-বেঙ্গালুরুতেও একই চিত্র। হায়দরাবাদের অন্তত আশি শতাংশ অটো বাড়তি যাত্রী তোলে না। যে কুড়ি শতাংশ তোলার চেষ্টা করে, তারা পুলিশকে ভয় পায়। কারণ, দেখলেই পুলিশ বাড়তি যাত্রী নামিয়ে দেয়, সাজা পায় চালক। কলকাতার চালকরাই কেবল কোনও অনুশাসনের বশবর্তী নয়। যারা ২৩৫-৩০-এর সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে রাজ্যশাসন করতে এসেছিল সেই বামফ্রন্টও সমস্যার মূল উপড়ে ফেলার কোনও চেষ্টা করেনি, পরিবর্তে আসা বর্তমান সরকারও আসল রোগটি নিরাময়ের কোনও ব্যবস্থাই করছে না। আজ কোনও রাজনৈতিক নেতা বুকে হাত রেখে বলতে পারেন জামাকাপড় পাল্টালে অথবা শুধুমাত্র অটোর ভাড়া বাড়ালেই চালকরা সুশৃঙ্খল হবে? যাত্রীদের সঙ্গে অন্যায় আচরণ করবে না? আইনরক্ষকরা অবাধ্য, অশ্লীল অটোচালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে, তারা ‘রাজনীতি খেলবে না’? দিনের পর দিন বিশৃঙ্খলা প্রশ্রয় পেয়ে পেয়ে আজ এমন বিকট আকার ধারণ করেছে যে এই সব ‘অবাধ্য’ অটোচালক বাস ভাঙচুর করে যাত্রীদের ঘাড় ধরে নামাবার ‘সাহস’ দেখাচ্ছে। এ সমস্যা কান ধরে ওঠবোস করালে মিটবে না, থুতনি নেড়ে আদর করলেও নয়। প্রয়োজন শৃঙ্খলার। রাজনৈতিক দলগুলি ভোট-রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে কালোকে কালো, সাদাকে সাদা বলার অবস্থায় থাকলেই সমাধানের লক্ষ্যে এগোনো যায়। নচেৎ যাত্রী নিগ্রহ চলছে চলবে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.