প্রবন্ধ ১...
দেওয়ালে ছবি টাঙানোরও তো একটা শেষ আছে
জ থেকে একশো পঞ্চাশ বছর আগে বাংলায় নবজাগরণের প্লাবন এসেছিল। তিন বছরের মধ্যেই তিন মনীষীর আবির্ভাব। জগদীশচন্দ্র বসু ১৮৫৮, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১, আবার ওই বছরেই প্রফুল্লচন্দ্র রায়। ইদানীং কালে বহু সভা-সমিতি হল ওই তিন জনকে নিয়ে, বিশেষত রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। এখনও হচ্ছে। শুধু গম্ভীর আলোচনা, নিখুঁত বিশ্লেষণ নয়, এই মহাপুরুষের বহুমুখী ব্যক্তিত্বের পরিচিতি করিয়ে দেওয়া থেকে আরম্ভ করে, তাঁর প্রতিভার যে জ্যোতি, সেই জ্যোতির তীব্র আকর্ষণে আমরা ডুব দিয়েছি। জগদীশচন্দ্র ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে রেডিয়ো-তরঙ্গ আবিষ্কার করলেন। নির্ঘাত নোবেল প্রাইজ। কিন্তু মার্কনি পেছন থেকে ছুরি মারলেন। অত কাছে এসেও জগদীশচন্দ্র নোবেল থেকে বঞ্চিত হলেন।
কবির সম্বন্ধে কিছু বলা বাহুল্য। প্রফুল্লচন্দ্র বিদগ্ধ মানুষ, সে কালের সমাজের উঁচু মাপের রসায়নের অধ্যাপক, আবার সাহিত্যের সেবক, রবীন্দ্রনাথের অনুরাগী। কবি প্রফুল্লচন্দ্রকে স্নেহ এবং শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। আর প্রফুল্লচন্দ্র কেবল অনুরাগী নন, কবিকে প্রচণ্ড শ্রদ্ধা করতেন। সব থেকে বড় কথা, বাংলায় রসায়ন শিল্পের প্রথম স্থাপনা প্রফুল্লচন্দ্রই করেছিলেন বেঙ্গল কেমিক্যালস সে কালের তুলনায় এখন নেহাতই ম্লান। তো সে যা-ই হোক, দেখা যাচ্ছে যে, গত দু’বছর ধরে, কাঁপা-কাঁপা গলায়, আপ্লুত আবেগে এই মহাপুরুষদের স্মরণসভা করেই চলেছি। একশো পঞ্চাশ বছর আগেকার ইতিহাসকে প্রাণপণ আঁকড়ে ধরেছি, বর্তমানের ঝড় থেকে বাঁচবার জন্যে। অসহায় বাঙালির মাথার উপর কেউ নেই যে তাকে চালিয়ে যাবে। অতীতের হাতছানিই তার একমাত্র সম্বল।
স্বাধীনতা সংগ্রামেও বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সারা ভারতবর্ষের শিল্পের রানি ছিল কলকাতা। দমদম এয়ারপোর্ট এশিয়ার মধ্যে অন্যতম। কলা-কৃষ্টি-শিল্প-সাহিত্য-বিজ্ঞান সব ব্যাপারেই বাংলা প্রথম। আমাদের যখন মোটামুটি জ্ঞান হয়েছে ১৯৪০ সালের শেষের দিকে, কিন্তু বোধগম্য বিশেষ কিছুই হয়নি কলকাতা বলতে বুক ভরে যেত। সাহেবরা তখনও বেশ ছড়ি ঘোরাচ্ছে, যদিও আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। ছড়ি ঘোরানো অভ্যাস কি অত তাড়াতাড়ি যায়!
পরিবর্তনের রং নীল। এখন কলকাতা।
বাঙালি, মানে যাঁরা উচ্চ-মধ্যবিত্ত, উঁচু পেশাধারী, ব্যারিস্টার ইত্যাদি। কোনও কোনও জমিদার, বিশেষত যাঁরা শহরবাসী, তাঁদের সাহেব-ঘেঁষা হতেই হবে। তাঁরা ক্লাবে যাবেন, সাহেবদের মতন ভঙ্গি করে সিগারেট ধরাবেন এবং হুইস্কি খাবেন, বৈশাখ মাসের গরমেও সুতির থ্রি-পিস স্যুট পরবেন, কিন্তু বাড়িতে, সংসারের মধ্যে এক্কেবারে মান্ধাতার বরপুত্র। কোথায় যেন একটা খটকা, অদ্ভুত এক গোঁজামিল, অসামঞ্জস্য। অঙ্কে মিলছে না। সাহেব সেজে কমার্শিয়াল শিল্প স্থাপনে সাহেবদেরই মতন রাজত্ব চালিয়ে গেলেন বেশ কয়েক বছর। বাইরের জগতে খটকা নেই ওই সাহেবদেরই মতন। ‘বুঝলেন তো, এক্কেবারে পাকা সাহেব।’... ‘কী বললেন? রংটা একটু কালো? না না, ও তো উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ সাহেবদের মতনই বলতে গেলে।’
১৯৫০ সালেও দেখতাম, দার্জিলিঙে ওই ষাঁড়ের দল (স্যর এক্স, স্যর ওয়াই) মাথায় টুপি পরে ‘হাউডু ইউ ডি’ করতে করতে বাহারি জামা পরে স্টাইলে হাঁটতেন, ওই সাহেবি নকল করে। যত কম বয়সই হোক, হাতে একটা ছড়ি, কিছু বলেছ কি ছড়ি উঠবে।
এই ভাবে আদেশ মেনে বাঙালি বাংলাকে কিছু দিনের জন্যে বেশ ভালই চালিয়ে গেল। তখনও পর্যন্ত, মানে পঞ্চাশের শেষ পর্যন্ত দেশভাগের বিপর্যয় বাংলায় অতটা ভয়ঙ্কর রূপ নেয়নি। মাথার উপরে রাজা না থাকলেও রাজার মতন তো আছেন, তাতেই চলে যাবে। দেশ মোটামুটি স্বচ্ছন্দেই চলছিল। মাথার উপরে যিনি আছেন, তিনিই অন্নদাতা। তখনও বাঙালি বেমালুম মেনে নিয়েছিল। চোখা-চোখা বাঙালি আই সি এস অফিসার যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে কয়েকটি উচ্চ মধ্যবিত্ত এবং সম্ভ্রান্ত পরিবার থেকে শিক্ষিত মানুষরা ডা. রায়ের ক্যাবিনেটে এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে কারও কারও প্রতাপও কম ছিল না।
কিন্তু বাঙালির ‘এত ভাল’ হজম হল না। বদহজমের চোঁয়া ঢেকুর বেশ শোনা যেতে লাগল। বিধান রায় বাংলার জন্য যা করেছিলেন, এখন কিংবদন্তির মতন শোনায়। যেমন দূরদৃষ্টি, তেমনই দক্ষতা। সেটা বাঙালির পছন্দ হল না। কোনও রকমে কুঁতিয়ে কুঁতিয়ে সাতশো ভোটে (তাও পোস্টাল) জিতেছিলেন এক ইলেকশনে।
ব্যস্, তার পর থেকেই রাজার রাজত্ব টলমল, প্রফুল্ল সেনের সময়েই খাদ্য আন্দোলনের বিভীষিকা এখনও মনে আছে। রাজা সাধারণ মানুষ হলেন, খুবই আনন্দের কথা। কিন্তু বাঙালি স্বভাববশতই সে সব মানুষকে মেনে নেয় না, নেতাকে গালিগালাজ টিটকিরি মারতে বাকি রাখল না। প্রথম বাজনা বেজে উঠল ‘আমরা সবাই সমান, ভাই আমরা সবাই সমান’। শাসনব্যবস্থায় নেমে এল শ্লথ, স্বাধীনতার নতুন রূপ হল আমরা সবাই স্বাধীন। শৃঙ্খলা চুরমার হলে বিশৃঙ্খলাই রোজকার খোরাক জোগাতে আরম্ভ করল।
এক নতুন যুগ এল, যখন বাঙালি নিজেকেই ধ্বংসের দিকে এগিয়ে ঠেলে দিতে লাগল। এক কালে বাঙালির যে প্রতাপ বা ঐশ্বর্য ছিল, সে যেন ম্যাজিকের মতন রাতারাতি উবে গেল। বাংলা মানেই পৃথিবী, এ রকম একটা চিন্তাধারা প্রকট হয়ে উঠল। বাঙালি ঘরমুখী হল, বাইরের জগতের বিভীষিকা তাকে ভাবিয়ে তুলল। ‘আরে মশাই যান যান, ও ব্যাটা তো ম্যাড্রাসি, ও ব্যাটা খোট্টা। ও! আরে ও তো উড়ে, ও ব্যাটা বেহারি’, এক অলীক জগতে উটপাখির মতন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠল।
বাঙালি বাংলাকে শাসন করতে নাকানিচোবানি। সাহেব পর্যন্ত ঠিক ছিল, তাঁদের হুকুমই শুনে গেছে, কিন্তু নিজেরা হুকুম দেওয়া কোনও দিনই শেখেনি। রাজ্য চলবে কী করে? আর যা হুকুম, সেগুলি রাজনীতির অলিগলির বাসিন্দাদের জন্যে, শাসনব্যবস্থায় কেউ কোনও কান দেবে না। নিজেকে অজান্তে ধ্বংস করার স্পৃহা উর্বর হয়ে উঠল।
সেই যে ভাঙন ধরল, মানসিকতায় এক অসম্ভব কূপমণ্ডূকতা এনে দিল। ভাঙনের যেন শেষ নেই। পরিবর্তনের হাওয়া এসে কোন খবরের কাগজ পড়তে পারবেন, তা-ও সরকার ঠিক করে দেবে। কী খাবেন তার তালিকা এল বলে। দূর বা অদূর ভবিষ্যতেও ঝরঝরে উষাও তো কেউ দেখছি না।
রানি আছেন, কিন্তু রাজত্বের কী দশা! কেবল বক্তৃতা আর তর্ক, তর্ক আর তর্ক। কাজের সময় কোথায় গো। পঞ্চাশ হাজার জিনিস করতে গিয়ে নীল সাদা রঙে মজে গেছি, কয়েকটি বিরাট কাজ করলেই ভাল হত না কি প্রথমেই? সেই খোট্টারা, সেই মাদ্রাজিরা, সেই বাঁধাকপিরাও আবার উড়েরাও, এমনকী ব্যাটা বেহারিরাও তরতরিয়ে আমাদেরকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে, আমরা খালি ফ্যালফ্যাল করি। দেশবিদেশে পড়াশুনা করে, মুম্বইয়ের পরে বাংলায় ফিরেছিলাম বুকভরা আশ্বাস নিয়ে। কেমব্রিজ-লন্ডনের সব গ্ল্যামারকে জলাঞ্জলি দিয়ে। কারণ, আমি মনেপ্রাণে বাঙালি। আমি নিজে বাঙালি, তাতে গর্বিত। কিন্তু এ কী হল? অন্ধকার যেন আর কাটে না। গভীর অন্ধকারে হোঁচট খেতে খেতে জীবনের বৈকালে পৌঁছেছি। হে বঙ্গভূমি, একটু আশা দাও, একটু আলো দাও। এত হীন দশা তো আর সহ্য হয় না গো! বাঙালি কি সত্যিই আত্মঘাতী?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.