মারিয়ম, সুমিত্রা, কিরণদের
মিলিয়ে দিল কোঝিকোড়

টানা ছ’দিনের কার্যসূচির পরে শেষ লগ্ন। নতুন কমিটি নির্বাচন শেষ। সভাপতিমণ্ডলীর ধন্যবাদ জ্ঞাপন শেষ। প্রথা মেনে ‘ইন্টারন্যাশনাল’ গেয়ে যবনিকা টানা হবে অধিবেশনে। মঞ্চে উঠলেন রেখা গোস্বামী। দু’পাশে দুই সঙ্গী। বললেন, “আমি বাংলায় গাইব। আপনারা যে যাঁর নিজের মাতৃভাষায় গলা মেলান।” রেখাদেবী শুরু করলেন ‘জাগো জাগো সর্বহারা’। উঠে দাঁড়াল টেগোর সেন্টিনারি হল। এক সপ্তাহ ধরে যা আসলে আসমুদ্র হিমাচলের সিপিএম!
বিংশতিতম পার্টি কংগ্রেসের শেষতম দৃশ্যটা প্রতীকী। সারা বিশ্বের কমিউনিস্টদের যা অভিন্ন বক্তব্য, নিজের মাতৃভাষায় তা-ই পেশ করার জন্য উঠে দাঁড়ালেন এক মহিলা। যোগ দিলেন দেশের বাকি প্রতিনিধিরা। অদূর ভবিষ্যতের ভারতীয় রাজনীতিতে সিপিএম তাদের ‘প্রাসঙ্গিকতা’ বাড়াতে পারবে কি না, রাজনৈতিক অভিমুখ আদৌ কিছু বেরোল কি না এই কূট প্রশ্ন পরের কথা ও তকর্সাপেক্ষ। কিন্তু এই পার্টি কংগ্রেস সিপিএম রাজনীতিতে মহিলাদের লড়াইয়ের কিছু খণ্ডচিত্র এক ছাদের তলায় রেখে গেল। যেখান থেকে বেরিয়ে এই কাহিনির কুশীলবেরা ফিরে চললেন নিজের নিজের ক্ষেত্রে লড়াই জারি রাখতে। সিপিএমের এ বারের কেন্দ্রীয় কমিটিতে মহিলার সংখ্যা বেড়েছে। আগে ৮৭ জনের কমিটিতে মহিলা ছিলেন ১০ জন। এ বার ১৩ জন। কমিটির সদস্যসংখ্যা বেড়ে ৮৯ হওয়ায় আরও দু’টি স্থান বিহার ও ত্রিপুরার জন্য ফাঁকা। পলিটব্যুরোয় একমাত্র মহিলা সদস্য বৃন্দা কারাট। কয়েক জন সদস্য বাড়লেই মহিলাদের ‘গুরুত্ব’ যে বাড়ে না, সিপিএম নেতৃত্বও তা মানছেন। কিন্তু আলাদা ক্ষেত্রে মহিলাদের ‘সাহসী লড়াই’ যে দলকে ‘উৎসাহ’ জোগাচ্ছে, তা-ও বলছেন।
যেমন গত এক সপ্তাহ ধরে কোঝিকোড়ে সব চেয়ে বেশি আবেগ আবর্তিত হল দুই বন্ধু লায়লা ও রাধাকে ঘিরে। দু’জনেই কেরলে মহিলা আন্দোলনে আছেন। দু’জনেই প্রবাদপ্রতিম পিতার সন্তান। প্রথম জন এ কে গোপালনের এবং দ্বিতীয় জন ইএমএস নাম্বুদিরিপাদের। সিপিএমের যে সব নেতা-কর্মী দেশের নানা প্রান্ত থেকে এসেছেন, তাঁরা এই দু’জনের সঙ্গে নিজেদের ছবি তুলে রাখলেন। প্রেক্ষাগৃহের বাইরে বেরোলেই একটা বৃত্ত জুটে যেত এঁদের পাশে। পার্টি কংগ্রেসের মিডিয়া সেন্টারে দাঁড়িয়ে রাধা এক দিন বলছিলেন, “আমরা এখানে মহিলা আন্দোলনের মধ্যে আছি। কিন্তু অন্য রাজ্যের লোকজনের সঙ্গে তো সচরাচর দেখা হয় না। এটাই তার সেরা মঞ্চ।”
পার্টি কংগ্রেসের এই মঞ্চই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-থাকা ‘বন্ধু’দের মিলনও ঘটিয়েছে। মহারাষ্ট্রের মারিয়ম ধওয়ালে যেমন খুঁজে পেয়েছেন হরিয়ানার জাগমতী সঙ্গওয়ানকে। মহারাষ্ট্রে দলিত-হত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয়েছিল মারিয়মের। এখন মহারাষ্ট্রে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক অশোক ধওয়ালের স্ত্রী, মহিলা সংগঠনের নেত্রী এবং কেন্দ্রীয় কমিটির মুখপত্রে নিয়মিত লেখক। আর জাগমতী একদা ভলিবলে জাতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। হরিয়ানায় ‘ইজ্জত-হত্যা’র (পারিবারিক সম্ভ্রম রক্ষায় খুন) বিরুদ্ধে একা লড়াই শুরু করে লোক জুটিয়ে ফেলেছেন। মারিয়মের কথায়, “যখনই এই ধরনের বড় সম্মেলনে যাই, বেশ কিছু মহিলার লড়াইয়ের কথা জানতে পারি। ওঁদের কথা শুনে ভরসা পাই।” বিদর্ভের কিরণ মোঘে লাল পতাকা তুলে নিয়েছেন কৃষক আত্মহত্যা এবং কৃষি সঙ্কটের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য। কোঝিকোড়ে এসে পাশে পেয়েছেন রাজস্থানের সুমিত্রা চোপড়াকে। জল ও বিদ্যুতের মতো মানুষের মৌলিক চাহিদার জন্য সে রাজ্যে সিপিএমের আন্দোলনে সুমিত্রা অগ্রণী সৈনিক। আবার উত্তর প্রদেশের মেধা গর্গ হিন্দি বলয়ের পরিচিত ‘সামাজিক নিপীড়নে’র প্রশ্নে ময়দানে নেমেছেন। এই রাজ্যগুলিতে কিন্তু সিপিএম প্রথম সারির রাজনৈতিক শক্তিই নয়। সামাজিক সমস্যার বিরুদ্ধে প্রায় একলাই লড়াই করছেন এঁরা।
স্বভাবতই পার্টি কংগ্রেসে এসে তাঁরা শুনে গিয়েছেন সিপিএমের সংগঠনে জায়গা করে-নেওয়া নেত্রীদের অভিজ্ঞতার কথা। তামিলনাড়ুতে অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে ইউ বাসুকী বা অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের জন্য সিন্ধুর আন্দোলনের অভিজ্ঞতা তাঁদের কাজে লাগবে, এমন আশা নিয়েই ফেরার ট্রেন ধরছেন সুমিত্রারা। কেন্দ্রীয় কমিটির আর এক সদস্য, চিকিৎসক কে হেমলতার গোটা পরিবারটাই প্রায় ৭ দিন কোঝিকোড়ে থাকল, দেখে গেলেন মারিয়ম, জাগমতীরা! কেরল রাজনীতিতে ‘কঠোর প্রতিবাদী’ বলে পরিচিত, সিপিএম সাংসদ টি এন সীমা এঁদের ‘উৎসাহ’ জুগিয়ে বলেছেন, লাল ঝান্ডার নীচে থাকলে কোথাও না কোথাও দেখা হবেই! পশ্চিমবঙ্গ থেকে এ বারই কেন্দ্রীয় কমিটিতে নির্বাচিত, রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী রেখাদেবী বলছেন, “মহিলা সংগঠনের সম্মেলনে গেলেও এমনই অভিজ্ঞতা হয়। বাঁকুড়ার দেবলীনা হেমব্রম বা সুদীপা বন্দ্যোপাধ্যায় কি কম মাওবাদী হুমকির মধ্যে রাজনীতি করেছে? ওদের লড়াইয়ের তুলনা নেই!”
কেরলের প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী পি কে শ্রীমতিই সম্ভবত সার কথা বলেছেন “রাজনীতি বা সামাজিক দায়িত্ব নিতে মহিলাদের এগিয়ে আসার অনেক সীমাবদ্ধতা আমাদের দেশে এখনও আছে। এখানে আমরা যা দেখলাম, সেটা রুপোলি রেখা মাত্র! কিন্তু সেটাই ভরসা!”


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.