ক্ষমতায় থাকলেও বেনজির সমালোচনার মুখে কারাট
টাই কি প্রত্যাশিত ছিল?
প্রশ্নটা ভাসছিল হরকিষেণ সিংহ সুরজিৎ-জ্যোতি বসু নগরের ভাঙা হাটে। গত ছ’দিন এই নামই ছিল কোঝিকোড়ের টেগোর হলের। সেখানেই গত কাল সিপিএমের বিশতম পার্টি কংগ্রেসের সমাপ্তি ঘোষণা হয়েছে। সেখানেই গত কাল তৃতীয় বারের জন্য দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন প্রকাশ কারাট। কোনও অপ্রত্যাশিত ঘটনা নয়। কিন্তু কেন ‘অপ্রত্যাশিত’ নয়, তা নিয়েই চলছিল সেই আলোচনা।
সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দলের দায়িত্ব পুরোদস্তুর হাতে নেওয়ার পরে গত চার বছরে প্রকাশ কারাটের প্রায় সব রাজনৈতিক চালই ব্যর্থ হয়েছে। তাঁর আমলে দলের শক্তিও কমেছে উল্লেখযোগ্য ভাবে। দুই বাম-দুর্গে সিপিএম ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। হিন্দি-বলয়ে এক মাত্র রাজস্থানই মরুদ্যান! বাকি রাজ্যগুলির অবস্থা কহতব্য নয়! তার মধ্যে কারাট নিজেই উত্তরপ্রদেশের দায়িত্বে। দলে তাঁর সমালোচকেরা বারেবারে সে কথা মনেও করিয়ে দিচ্ছেন।
একাধিক পার্টি কংগ্রেসে যোগ দেওয়ার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সিপিএম নেতারা একটা বিষয়ে একমত। অতীতে কখনও কোনও পার্টি কংগ্রেসে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব এই ভাবে সমালোচনার মুখে পড়েনি। রাজনৈতিক প্রস্তাব হোক বা সাংগাঠনিক দুর্বলতা, সমর্থন প্রত্যাহার হোক বা হিন্দিবলয়ে মুছে যাওয়া, এমনকী মতাদর্শগত বিষয়েও প্রবল সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে কারাটকে। পার্টি কংগ্রেসের কোনও দলিলই এ বার সম্পূর্ণ ঐকমত্যের ভিত্তিতে পাশ হয়নি। কারাটের অবশ্য দাবি, “যে ভাবে বিতর্কের মধ্যে দিয়ে সমস্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে, তা দলের মধ্যে গণতন্ত্রের পরিচায়ক।”
কাসারগোড়ে চোখে পড়ছে এমনই সব প্ল্যাকার্ড। ছবি: পিটিআই।
অভিযোগের আঙুল যে শুধু সাধারণ সম্পাদকের দিকেই উঠেছে এমন অবশ্য নয়। গোটা শীর্ষ নেতৃত্বকেই কাঠগড়ায় তুলে পার্টি কংগ্রেসের প্রতিনিধিরা জানতে চেয়েছেন, কেন দল কিছুই করে উঠতে পারছে না। কেন্দ্র বা রাজ্য স্তরের পার্টি কেন্দ্রে বসে থাকা নেতারা কেন ক্রমশ ‘অচল’ হয়ে পড়ছেন। দাবি উঠেছে, পার্টি কেন্দ্রে বসে থাকা নেতারা রাজ্যে রাজ্যে গিয়ে বাস্তব পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করুন। তবে মূল দায়িত্ব যে কারাটেরই সে কথাও অনুচ্চারিত থাকেনি। সিপিএম নেতারা বলছেন, সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দলের এমন হালের দায় কারাট এড়িয়ে যেতে পারেন না।
তা সত্ত্বেও নেতৃত্ব বদল হল না কেন? কেন ফের সেই কারাটই সাধারণ সম্পাদক পদে? কারাটের সমালোচকরা বলেছেন, সব ভুল স্বীকার করে নিয়ে, সামগ্রিক দায়িত্বের কথা বলে এক বিচিত্র স্থিতাবস্থার কৌশল খুঁজে বের করেছেন সাধারণ সম্পাদক। তিনি কাউকে গদি ছাড়তে বলছেন না, নিজেও গদি ছাড়ছেন না! উল্টো দিকে কারাট-শিবির বলছে, গত ৪ বছরে তাঁর সব সিদ্ধান্তেই দল সিলমোহর লাগিয়েছে। কারাটের মতাদর্শগত অবস্থান এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়েও গোটা দল নিঃসন্দেহ।
কিন্তু রাজনীতিতে সেটাই কি সব? সাংগঠনিক রিপোর্টই বলছে, হিন্দিবলয়ে দলের সংগঠন ছড়াতে কারাট চূড়ান্ত ব্যর্থ। উপদলীয় ঝোঁক বেড়েছে। পশ্চিমবঙ্গ-কেরলের মতো রাজ্যগুলি নিজের ইচ্ছামতো কাজ করছে। অন্য রাজ্যগুলিও হামেশাই পার্টি কেন্দ্র বা দিল্লির এ কে জি ভবনকে থোড়াই কেয়ার করে। পার্টি কেন্দ্রের মধ্যেও সমন্বয়ের অভাব ফুটে উঠছে। সব মিলিয়ে দলের কেন্দ্র দুর্বল হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে দলে একটা ঐকমত্যের বাতাবরণ তৈরি করার চেষ্টা করেছেন কারাট। পার্টি কংগ্রেসের শেষ দিনেও ফের পশ্চিমবঙ্গের পাশে দাঁড়ানোর কথাই বলেছেন। কোঝিকোড়ের সমুদ্রসৈকতে বিশাল জনসভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম করে আক্রমণ করেছেন তিনি। তৃণমূলের ‘হামলা’-র মুখে ‘লড়াই চালিয়ে যাওয়া’-র জন্য পশ্চিমবঙ্গের পার্টির প্রশংসা করেছেন খোলা গলায়। এক দিকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে পলিটব্যুরোয় রেখে দিয়ে ‘ইতিবাচক বার্তা’ পাঠাতে চেয়েছেন। অন্য দিকে ভি এস অচ্যুতানন্দনকে পলিটব্যুরোয় না-ফেরালেও কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে বাদ দিয়ে দলে একেবারে গুরুত্বহীন করে ফেলার যে দাবি পিনারাই বিজয়ন তুলেছেন, তা খারিজ করে দিয়েছেন।
কিন্তু এতেই কি গোটা দলকে নিজের পাশে পাবেন কারাট? কাটাতে পারবেন দলের রাহুগ্রস্ত দশা? দলের নতুন পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির তালিকা দেখে সিপিএমের নেতারা বলছেন, শীর্ষনেতৃত্বে কারাটের হাতই আরও শক্ত হয়েছে। দুই জায়গাতেই কারাটের পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন থাকবে। কাজেই কারাট দলকে যে দিকে নিয়ে যেতে চান, তাঁকে কোনও বাধার মুখে পড়তে হবে না। কিন্তু তাতে লাভ কতটা? দলের দাবি মেনে কতটা আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবেন কারাট? হারানো প্রাসঙ্গিকতা কি ফিরে পাবে পার্টি? হিন্দিবলয়ে কতটা ঢেউ তুলতে পারবে সিপিএম? হিন্দিবলয়ের বিপর্যয় নিয়ে সাংগঠনিক বিষয়ে বিশেষ প্লেনাম ডাকার দাবি উঠলেও এখনই তা হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন এস আর পিল্লাই। পার্টি কংগ্রেসে তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক প্রস্তাবে যে সব কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে, সেই অনুযায়ীই হিন্দিবলয়ে কাজ হবে। কিন্তু যে ওষুধে এত দিন রোগ সারেনি, তাতে এখন কাজ হবে? শুধু হিন্দিবলয়ের নেতারা নন, এই প্রশ্ন তুলছেন অন্য রাজ্যের নেতারাও।
সিপিএমের এক নেতা করিয়ে দিয়েছেন, পরের পার্টি কংগ্রেস হবে ২০১৫ সালে। তার আগের বছরই লোকসভা নির্বাচন হওয়ার কথা। কারাটের সামনে আর এক ‘অগ্নিপরীক্ষা’। যদিও কারাট-পিল্লাইরা বারবার বোঝাতে চাইছেন, নির্বাচনী সাফল্যটাই দলের একমাত্র লক্ষ্য নয়, কিন্তু তাই বলে লোকসভা নির্বাচনে ফের ভরাডুবি হলে তার কি দায় এড়াতে পারবেন সিপিএম সাধারণ সম্পাদক?
তাই প্রশ্ন উঠেছে, প্রকাশ কারাটের জমানার এটাই কি শেষ পর্ব? পলিটব্যুরোর এক সদস্যের কথায়, “সাধারণ সম্পাদক পদে তিন দফার মেয়াদ বেঁধে দেওয়া হয়েছে। সেই হিসেবে কারাটের এটাই শেষ বার। কিন্তু মনে রাখতে হবে, তিন-চতুর্থাংশের সমর্থন থাকলে চতুর্থ বারের জন্যও সমস্ত স্তরে সম্পাদক পদে ফিরে আসার রাস্তা খোলা রয়েছে।”
কিন্তু এই মেয়াদ বেঁধে দেওয়ার জন্যই আগামী পার্টি কংগ্রেসে দলের নিচুতলা থেকে উপর পর্যন্ত সমস্ত স্তরের নেতৃত্বে আমূল পরিবর্তন আসতে চলেছে। লোকাল কমিটি, জোনাল কমিটি, জেলা কমিটির সম্পাদকদের অনেককেই আগামিবার সরে যেতে হবে। ফলে রাজ্য নেতৃত্বেও বিরাট পরিবর্তন আসবে। তার ধাক্কা এসে লাগবে দিল্লির এ কে গোপালন ভবনে। প্রভাব পড়বে কেন্দ্রীয় কমিটিতেও। তখনও কি ‘স্থিতাবস্থা’ বজায় রাখতে পারবেন কারাট? না কি তার আগেই খাদের ধার থেকে দলকে টেনে এনে শক্ত করে নিতে পারবেন নিজের পায়ের তলার মাটি?
প্রশ্নটা কঠিন! আর উত্তরটাও ভবিষ্যতের গর্ভে!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.