গুলবার্গ সোসাইটি হত্যাকাণ্ডে সুপ্রিম কোর্ট গঠিত বিশেষ তদন্তকারী দলের (সিট) রিপোর্টে ‘ক্লিনচিট’ পেলেন নরেন্দ্র মোদী। আর তার ফলে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী দলে দাপট বাড়ানোরও সুযোগ পেলেন বলে বিজেপির একটা বড় অংশ মনে করছে।
‘সিট’-এর সিলবন্দি রিপোর্ট খুলে আমদাবাদের মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এম বি ভট্ট আজ জানিয়ে দেন, ২০০২ সালে গোধরা-পরবর্তী দাঙ্গার ওই ঘটনায় মোদী-সহ অন্য রাজনৈতিক নেতা ও আমলাদের কোনও হাত নেই বলে ‘সিট’ জানিয়েছে। দাঙ্গার সময়ে আমদাবাদের গুলবার্গ সোসাইটি আবাসনে হামলায় প্রাণ হারান কংগ্রেসের প্রাক্তন সাংসদ এহসান জাফরি-সহ ৬৯ জন। এই হত্যার পিছনে মোদী-সহ আরও অনেকের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ করেন নিহত নেতার স্ত্রী জাকিয়া। অভিযোগ খতিয়ে দেখতে সুপ্রিম কোর্ট সিট-কে তদন্তের দায়িত্ব দেয়।
সিট রিপোর্টে জানিয়েছে, তদন্তে মোদী-সহ ৫৮ জনের বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ মেলেনি। সে জন্য মামলাটি বন্ধ করারও সুপারিশ করেছে সিট। রিপোর্টটি জানার পরে নরেন্দ্র মোদী আজ আনন্দবাজারকে বলেন, “নিজেকে ভারমুক্ত মনে হচ্ছে। ঘটা করে কোনও প্রতিক্রিয়া দিইনি, কারণ আমি বিবেকের কাছে গোড়া থেকেই পরিষ্কার ছিলাম। তবে নিন্দুকেরা এটাকে প্রচারের হাতিয়ার করেছে, নিরন্তর প্রচার চালিয়েছে। সে জন্য মাঝেমধ্যে কুণ্ঠিতও হয়ে পড়তাম। আর সে জন্যই সিট-এর রিপোর্ট আসার পরে আজ নিজেকে ভারমুক্ত মনে হচ্ছে।”
তবে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত সিট-এর এই রিপোর্ট গ্রহণ করে মামলাটি গুটিয়ে ফেলবে কি না, তা আদালতের উপরই নির্ভর করছে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অভিযোগকারীর বক্তব্য শুনতে হবে আদালতকে। এ ছাড়া, এক মাসের মধ্যে জাকিয়াকে সিট রিপোর্ট-সহ এই ঘটনার সংশ্লিষ্ট সব নথি দিতে হবে। সেই নথির মধ্যে সুপ্রিম কোর্ট
নিযুক্ত আদালত-বান্ধব রাজু রামচন্দ্রনের রিপোর্টও থাকবে। সিট-এর রিপোর্ট দেখে এবং নিজে তদন্ত করে আলাদা রিপোর্ট জমা দিয়েছিলেন রাজু। সংবাদমাধ্যমে ফাঁস হওয়া তথ্য অনুযায়ী, রাজুর মতে, এই ঘটনায় মোদীর বিরুদ্ধে প্রমাণ আছে। রাজু নিজেও আজ সেই ইঙ্গিত দিয়েছেন।
সিট-এর প্রধান আর কে রাঘবনও কার্যত মেনে নেন, রামচন্দ্রনের রিপোর্ট তাঁদের রিপোর্টের থেকে আলাদা। তবে সেই রিপোর্ট তাঁরা খতিয়ে দেখেছেন। তাঁদের রিপোর্টের অর্থ কি এই যে মোদী এই মামলায় পুরোপুরি ছাড় পেয়ে গেলেন? রাঘবন বলেন, “মোদীদের ছাড় দেওয়া হবে কি না, তা আদালতই ঠিক করবে। আমরা কিছু সুপারিশ করেছি। আর জাকিয়ারা আমাদের রিপোর্টকে চ্যালেঞ্জ জানাতেই পারেন।” তবে তিনি এ-ও জানিয়ে দেন, মোদীর বিরুদ্ধে প্রমাণ নেই বলায় তাঁদের সততা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অর্থ নেই।
সিট-এর রিপোর্টে জাকিয়া বা এই মামলায় সহ-আবেদনকারী তিস্তা শেতলওয়াড় ব্যথিত হলেও পুরোপুরি হতাশ হতে রাজি নন। এহসান জাফরির পুত্র তনভিরের বক্তব্য, সিট মোদীকে ছাড় দিয়েছে, আদালত নয়। এবং সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশানুযায়ী, মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটকে তাঁর মায়ের বক্তব্য শুনতে হবে, অন্য তথ্যও বিবেচনা করতে হবে। তা-ই হতাশ হওয়ার প্রশ্নই নেই।
তবে সিট-এর রিপোর্ট জনসমক্ষে আসার পরেই উল্লসিত মোদী শিবির সর্বশক্তি দিয়ে প্রচারে নেমে পড়ে। বিভিন্ন সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং ওয়েবসাইটেও মোদী-সমর্থকদের তরফে বিরোধীদের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করা শুরু হয়। রাহুল গাঁধী এবং তিস্তাকে কটাক্ষ করা হয়। কেউ বলেন, “মোদী ‘ক্লিনচিট’ পাওয়ার পরেই দিল্লিতে ঝড় উঠেছে, এটি কি ভবিষ্যতের কোনও ইঙ্গিত?” সুষমা স্বরাজ ট্যুইট করেন, “মোদীর ক্লিনচিট পাওয়া আমাদের কাছে স্বস্তির। দশ বছরের অপপ্রচার এ বার বন্ধ হওয়া উচিত।”
গত কয়েক মাস ধরেই বিজেপি সভাপতি নিতিন গডকড়ীর সঙ্গে সম্পর্ক ভাল যাচ্ছে না মোদীর। সঞ্জয় জোশীকে উত্তরপ্রদেশের দায়িত্বে আনা থেকে শুরু করে উত্তরপ্রদেশের কৌশল বিভিন্ন বিষয়ে মোদীর সঙ্গে গডকড়ীর বিবাদ এখন অজানা নয়। এই বিবাদের জেরে উত্তরপ্রদেশ-সহ পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনে এক দিনের জন্যও প্রচারে যাননি গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু ‘ক্লিনচিট’ পাওয়ার পরে মোদী যখন ফের ‘ক্ষমতাবান’ হয়ে উঠলেন বলে দলের একটা বড় অংশ মনে করছে, সেই সময় তাঁকে পূর্ণশক্তি দিয়ে সমর্থন করার নির্দেশ দেন গডকড়ী। আজ সকালেই সাধারণ সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠকে বসে গডকড়ী নির্দেশ দেন, সিট-এর রিপোর্টের পর মোদীর বিরুদ্ধে লাগাতার ‘অপপ্রচার’-এর যে অবসান হল, তা ফলাও করে প্রচার করতে হবে।
যদিও এর মধ্যে গডকড়ীর অন্য কৌশলও রয়েছে। ছত্তীসগঢ়ে তাঁর ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী অজয় সঞ্চেতির বিরুদ্ধে দুর্নীতির যে অভিযোগের জেরে তাঁর দিকেও আঙুল উঠেছে, মোদীর বিষয়টি প্রচার করে তা ঢেকে দিতে চান বিজেপি সভাপতি। কংগ্রেস অবশ্য এখনও হাল ছাড়তে চাইছে না। দলের নেতা বি কে হরিপ্রসাদ বলেন, “গুজরাতের দাঙ্গা জ্বলন্ত সত্য। সিট-এর রিপোর্ট যা-ই হোক, কেউ ভুলতে পারবে না, সেই সময় প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীই মোদীকে ‘রাজধর্ম’ পালন করার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন।”
তবে আজকের পর বিজেপি নেতৃত্ব বুঝতে পারছেন, মোদীকে বশে রাখার জন্য দাঙ্গার কলঙ্কই সব থেকে বড় অস্ত্র ছিল। সেই কলঙ্কই যদি এখন তাঁর ঘাড় থেকে নেমে যায়, তা হলে মোদীর দাপটও ধীরে ধীরে বাড়বে। সে কারণে গত কয়েক মাসে দলের নেতা ও সঙ্ঘকে রুষ্ট করলেও মোদী-বন্দনায় আজ সকলেই শরিক হন। দলের এক নেতার কথায়, “জাতীয় রাজনীতিতে বড় ভূমিকা পালনের পথ এ বার প্রশস্ত করলেন মোদী। এ বছরের শেষেই গুজরাতে বিধানসভা নির্বাচন। কিন্তু তার আগে থেকেই দলে আরও বড় দায়িত্বের জন্য আরও চাপ বাড়াবেন মোদী। দলকে তার জন্য এখন থেকে প্রস্তুত থাকতে হবে।”
|