টু-জি স্পেকট্রাম নিলাম করার নির্দেশ সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের ব্যাখ্যা চাইবে কেন্দ্রীয় সরকার। তাদের মতে, শীর্ষ আদালতের এই রায় বেশ কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সরকারের নীতিও যার অন্তর্গত। সেই কারণেই আজ কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে এই সব প্রশ্নে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের ‘পরামর্শ’ চাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
টু-জি প্রসঙ্গে সংবিধানের ১৪৩তম অনুচ্ছেদ অনুসারে শীর্ষ আদালতের কাছে ‘প্রেসিডেন্সিয়াল রেফারেন্স’ পাঠাবে কেন্দ্রীয় সরকার। যার অর্থ, ওই রায়ের ফলে জনস্বার্থ সম্পর্কিত কিছু প্রশ্ন তৈরি হয়েছে বলে সরকার মনে করছে। এবং সেই সব প্রশ্ন সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির মতামত জানতে চাইবেন রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাটিল।
টু-জি স্পেকট্রাম বণ্টন নিয়ে গত ২ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ রায়ে বলেছিল, আন্দিমুথু রাজার আমলে যে ৯টি সংস্থাকে ‘আগে এলে আগে পাবে’ ভিত্তিতে ১২২টি লাইসেন্স বণ্টন করা হয়েছিল তা ‘একতরফা’ ও ‘সংবিধান বহির্ভূত’। তাই ওই ১২২টি লাইসেন্স বাতিল করতে হবে। আদালত বলেছিল, একমাত্র নিলাম করে স্পেকট্রাম বণ্টন করলেই স্বচ্ছতার সঙ্গে যথাযথ মূল্য নির্ধারণ সম্ভব। সেই কারণে ওই ১২২টি লাইসেন্স বাতিল করে চার মাসের মধ্যে নিলাম করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল সরকারকে।
এই রায় পুনর্বিবেচনার জন্য টেলিকম সংস্থাগুলি ইতিমধ্যেই সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানিয়েছে। সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বেরও বক্তব্য, নিলামের পক্ষে সওয়াল করে আদালত কিছু মৌলিক প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। সেই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই ‘প্রেসিডেন্সিয়াল রেফারেন্স’-এর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সূত্রের খবর, সরকারের মূল প্রশ্ন হচ্ছে, সব ধরনের প্রাকৃতিক সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রেই কি নিলাম করা অপরিহার্য? যদি তা না হয়, তা হলে সর্বোচ্চ আদালতের এই রায় সরকারের নীতি নির্ধারণের এক্তিয়ারে হস্তক্ষেপ নয় কি?
প্রসঙ্গত সরকারের বক্তব্য, স্পেকট্রাম বা রেডিও তরঙ্গ একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে আবদ্ধ। ফলে এই সম্পদ সীমিত। এটা কোনও ব্যক্তির সম্পত্তি নয়। সরকারই এর মালিক। রেডিও সম্প্রচার থেকে শুরু করে উপগ্রহ পরিচালনা বিভিন্ন জাতীয় স্বার্থে এই স্পেকট্রামের ব্যবহার হয়। ফলে খনিজ বা বনজ সম্পদের মতো স্পেকট্রামও প্রাকৃতিক সম্পদ। যার একটা অংশ বেসরকারি সংস্থাকে ব্যবহার করতে দেওয়া হচ্ছে। উল্লেখ্য, সুপ্রিম কোর্টও তার রায়ে টেলিকম স্পেকট্রামকে প্রাকৃতিক সম্পদ হিসেবে মেনে নিয়েছে।
|
সংবিধানের ১৪৩তম অনুচ্ছেদ |
রাষ্ট্রপতি যদি মনে করেন* যে, জনস্বার্থ সম্পর্কিত কোনও আইনি প্রশ্ন উত্থাপিত
হয়েছে
বা হতে পারে,
যার জন্য সুপ্রিম কোর্টের মতামত গ্রহণ করা প্রয়োজন, তা হলে
তিনি
সেই
প্রশ্নটি
শীর্ষ আদালতের বিবেচনার
জন্য পাঠাতে পারেন। আদালত তার
বিবেচনামাফিক
শুনানির
পরে রাষ্ট্রপতির কাছে তার পরামর্শ পেশ করবে। |
*এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির মনে করার অর্থ অবশ্যই কেন্দ্রীয় সরকারের মনে করা।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে প্রশ্নাবলি শীর্ষ আদালতের কাছে তার পরামর্শের জন্য পাঠায়। |
|
লগ্নিকারী, বিশেষ করে বিদেশি লগ্নিকারীদের উপরে শীর্ষ আদালতের রায়ের যে প্রভাব পড়বে সে সম্পর্কেও ব্যাখ্যা চাইবে কেন্দ্র। এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বলেন, একাধিক বিদেশি সংস্থা ইতিমধ্যেই সরকারকে নোটিস পাঠিয়েছে। কারণ, সুপ্রিম কোর্ট সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত খারিজ করে দেওয়ার ফলে এ দেশে তাদের বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। লগ্নির শর্ত উল্লেখ করে এ ব্যাপারে সরকারের কাছ থেকে ব্যাখ্যা চেয়েছে তারা।
সরকারের আরও প্রশ্ন, যে সময়কালের জন্য স্পেকট্রাম বণ্টন বাতিল করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তার আগে থেকেই যাদের কাছে স্পেকট্রাম রয়েছে তাদেরও কি নতুন নিলামের ভিত্তিতে স্পেকট্রামের দাম দিতে হবে? যে সব সংস্থার স্পেকট্রাম বাতিলের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে, তারা নিলামে ওঠা সর্বোচ্চ দাম দিতে চাইলে স্পেকট্রাম পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পেতে পারে কি না, তা-ও জানতে চাওয়া হবে শীর্ষ আদালতে।
‘প্রেসিডেন্সিয়াল রেফারেন্স’ পাঠানোর প্রশ্নে অবশ্য সরকারের মধ্যে ভিন্নমত ছিল। তবে বেশির ভাগ নেতাই এর পক্ষে সওয়াল করেন। সূত্রের খবর, আজ কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে রেলমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেতা মুকুল রায় বলেন, প্রাকৃতিক সম্পদ বণ্টনের জন্য সর্বদা নিলামের পথে হাঁটা যুক্তিসম্মত নয়। কারণ, প্রাকৃতিক সম্পদ বণ্টনের সময় সরকারকে তার সামাজিক দায়িত্বের কথা সর্বাগ্রে মাথায় রাখতে হয়। খনিজ বা বনজ সম্পদ যদি নিলামে বেসরকারি হাতে চলে যায়, তা হলে সাধারণ মানুষের উপর চাপ বাড়বে। মুকুলের প্রশ্ন, জলও তো প্রাকৃতিক সম্পদ। কিন্তু সরকার কি তা নিলাম করতে পারে?
বস্তুত টু-জি স্পেকট্রাম নিলাম না-করার পিছনে সরকার এই যুক্তিই দিচ্ছিল। টেলিকমমন্ত্রী কপিল সিব্বলের মতে, টু-জি স্পেকট্রাম নিলাম করলে মুষ্টিমেয় কিছু সংস্থা তা মোটা টাকায় কিনে নিয়ে একচেটিয়া কারবার করত। ফলে টেলিকম ক্ষেত্রে নতুন প্রতিযোগীরা ঢুকতে পারত না। কিন্তু নিলাম না-করায় নতুন প্রতিযোগীরা এসেছে। তার সুফল পেয়েছেন উপভোক্তারা। কারণ, প্রতিযোগিতার ফলে কল রেট কমেছে। সুতরাং স্পেকট্রাম বণ্টন করতে গিয়ে ব্যক্তিগত স্তরে দুর্নীতি হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু নীতিগত ভাবে কোনও ভ্রান্তি ছিল না।
আর এক শীর্ষ কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর কথায়, শুধু স্পেকট্রাম নয়, সম্প্রতি কয়লার ব্লক নিলাম না-করা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিল ক্যাগ। কিন্তু এ কথাটা ভেবে দেখা হচ্ছে না যে, কয়লার ব্লক নিলাম করলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ বাড়বে। সে ক্ষেত্রে মানুষকে আরও চড়া হারে বিদ্যুতের মাসুল গুনতে হবে।
প্রাকৃতিক সম্পদ বণ্টনের নীতি নিয়ে এই বৃহত্তর প্রশ্নটাই শীর্ষ আদালতের কাছে রাখতে চলেছে সরকার। রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির কাছে শীঘ্রই পরামর্শ চেয়ে পাঠাবেন। তার পর এ ব্যাপারে বিশদ বিতর্ক ও উত্তর সন্ধানের জন্য সম্ভবত শীর্ষ আদালতের সাংবিধানিক বেঞ্চের কাছে বিষয়টি পাঠাবেন প্রধান বিচারপতি। |