মোল্লা নাসিরুদ্দিনের দর্শনে রাজনীতিকদের বিশ্বাস অগাধ এবং অচল। ফলে, বাস্তবের চাবি যেখানেই হারাক না কেন, তাঁহারা খুঁজিবেন জনমনোরঞ্জনের বাগানেই। যেমন, সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সরকার খুঁজিল। অটোরিকশা লইয়া অব্যবস্থা চরমে উঠিবার পর রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র নড়িয়া বসিয়াছিলেন। তিনি অটোরিকশাচালকদের বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিদের সহিত বৈঠকে বসিয়া সমস্যার সমাধান করিতে সচেষ্ট হইয়াছিলেন। অন্তত, তাঁহাকে দেখিয়া মনে হইয়াছিল, বুঝি কোনও সমাধানসূত্র মিলিতেও পারে। মন্ত্রিবরের বহুবিজ্ঞাপিত বৈঠক সেই আশাকে সমূল উচ্ছেদ করিয়াছে। মদনবাবু জানাইয়াছেন, অটোরিকশার ভাড়া বাড়িবে না। ইহাই অবশ্য বৈঠকের একমাত্র সিদ্ধান্ত নহে। মন্ত্রিমহোদয় জানাইয়াছেন, অতঃপর অটোচালকদের নির্দিষ্ট উর্দি পরিতে হইবে, নূতন নম্বর প্লেট লাগাইতে হইবে ইত্যাদি। যে আয় হ্রাস পাওয়ার ফলে অটোচালকদের ক্ষোভের সূত্রপাত, তাহার কী হইল? মন্ত্রী জানাইয়াছেন, অটোয় বিজ্ঞাপন লাগাইয়া আয় বৃদ্ধি করা হইবে।
শ্রীমিত্র অটোচালকদের উর্দি, শৃঙ্খলা ইত্যাদির ক্ষেত্রে যে কথাগুলি বলিয়াছেন, তাহা ভুল নহে। বস্তুত, কলিকাতার সম্পূর্ণ নিয়মহীন অটো-রাজত্বে লাগাম পরাইবার যে কোনও প্রচেষ্টাই জরুরি। কিন্তু, পরিবহণমন্ত্রী যে প্রশ্নের উত্তর খুঁজিতে বৈঠকে বসিয়াছিলেন, তাহার কী হইল? শুধু অটোরিকশা নহে, বাসসহ সমস্ত গণপরিবহণের ভাড়া অবিলম্বে না বাড়াইলে সমস্যা যে মিটিবে না, এত দিনে তাহা স্পষ্ট। শ্রীমিত্র তাঁহার দলের নীতির প্রতি বিশ্বস্ত থাকিয়াছেন, বাস্তবের পথে হাঁটিবার চেষ্টামাত্র করেন নাই। বিজ্ঞাপন যে এই সমস্যার সমাধান করিতে পারিবে না, তাহা অটোচালকরা যেমন জানেন, মন্ত্রীও তেমনই জানেন। তবু তিনি সেই কথাটিই আউড়াইয়াছেন, কারণ জনমোহনের চেনা পথের বাহিরে হাঁটিবার স্পর্ধা তাঁহার নাই। তাঁহারা রাজনীতির পুজারি। কিন্তু, সে রাজনীতি ক্ষুদ্র রাজনীতি তাহা মানুষকে ভুলাইতে চাহে, বুঝাইতে চাহে না। অথচ, এখনই তাহার প্রকৃষ্ট সময়। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস এখন কার্যত অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ফলে, প্রাত্যহিক রাজনৈতিক সমীকরণ কষিবার দায় আপাতত দলের নাই। এখনই তো মানুষকে বাস্তবের সহিত মিলাইয়া দেওয়ার সময়। কেন অটোরিকশা বা বাসের ভাড়া না বাড়াইয়া উপায় নাই, এই কথাটি মানুষকে বুঝাইয়া বলা প্রয়োজন। কথায় যুক্তি থাকিলে মানুষ তাহা বিলক্ষণ বোঝেন। কিন্তু, এই বুঝাইবার চেষ্টার মধ্যে যে ‘ঝুঁকি’ রহিয়াছে, ক্ষুদ্র রাজনীতিই মোক্ষ হইলে সেইটুকুও লওয়া কঠিন। পশ্চিমবঙ্গবাসী সম্যক বুঝিবেন।
মন্ত্রিবরের বৈঠকে শুধু তাঁহার দলের শ্রমিক সংগঠনের সদস্যরাই উপস্থিত ছিলেন। মন্ত্রী বলিয়াছেন, তিনি ডাকিলেও অন্যরা যোগ দেন নাই; বিরোধীরা বলিয়াছেন, মন্ত্রী ডাকেন নাই। কারণ যাহাই হউক, ভিন্ন মতের প্রতিনিধিত্বহীন বৈঠক গণতন্ত্রের বিপ্রতীপ। তবে, এখন অধিকাংশ অটোচালকই তৃণমূল কংগ্রেসের শ্রমিক সংগঠনের সদস্য। বামফ্রন্টের আমলে যখন সিটু-র একাধিপত্য ছিল, তখন শাসকরা তাহার ‘যথার্থ’ ব্যবহার করিয়াছিলেন অন্তত, শাসক দলের বিরুদ্ধে সেই দলের শ্রমিক সংগঠনকে রাস্তায় আন্দোলনে নামিতে হয় নাই। তাহার পূর্বেই রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরি হইয়া যাইত। তৃণমূল নেতৃত্ব এই রাজনৈতিক ম্যানেজমেন্টেও ব্যর্থ হইয়াছেন। অটোচালকদেরও স্বার্থরক্ষা হইবে, আবার দলের ঘোষিত অবস্থানেরও খুব একটা নড়চড় হইবে না এমন পরিস্থিতি তৈরি হইল না। তৃণমূল নেতৃত্ব আপাতত পরিস্থিতিটি ধামাচাপা দিল। কোনও সমস্যারই সমাধান হইল না প্রতিটিই ভবিষ্যতের জন্য গচ্ছিত রহিল। ইহাই ক্ষুদ্র রাজনীতির চারিত্রিক অভিজ্ঞান। মোল্লা নাসিরুদ্দিনের দর্শন ইহার অধিক অগ্রসর হইতে পারে না। |