|
|
|
|
প্রবন্ধ... |
অথচ খেলাটা পালটে দেওয়ার সুযোগ ছিল |
সম্ভাবনাও ছিল। কিন্তু সুযোগ কাজে লাগল না। সম্ভাবনা ব্যর্থ হল। সি পি আই এম
বিদায় নিয়েছে,
কিন্তু তার তৈরি
করে দেওয়া খেলাটা বদলায়নি। অস্মিতা
এবং হিংসা-র খেলা।
পশ্চিমবঙ্গের অপরিবর্তনের রহস্য সন্ধানে অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় |
কিছু মানুষের মতোই, কিছু বই থাকে, যাদের কাছে বার বার ফিরে যেতে হয়। সংশয়ে, অস্থিরতায়, অশান্তিতে যারা একটু শান্তি দেয়, পথ দেখায়, আলো জ্বালে। সব প্রশ্নের উত্তর মেলে তাদের কাছে, এমন নয়। মিলবেই বা কেন? কিন্তু অন্তত উত্তর খোঁজার কাজে কিছুটা এগোনো যায়। সে তো কম কথা নয়।
অমর্ত্য সেনের ‘আইডেন্টিটি অ্যান্ড ভায়োলেন্স’ এমনই এক বই। ২০০৬ সালে প্রকাশিত এ গ্রন্থের মূল ধারণাটি অবশ্য তিনি পেশ করেছিলেন আরও কয়েক বছর আগে। ১৯৯৮ সালের নভেম্বরে, অর্থাৎ তাঁর নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির কয়েক সপ্তাহ পরেই অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘রিজ্ন বিফোর আইডেন্টিটি’ নামে একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন অধ্যাপক সেন, তার অল্পকাল পরেই সেই বক্তৃতা ছোট্ট এক বইয়ের আকারে মুদ্রিত হয়। সেই থেকে অস্মিতা আর হিংসার পারস্পরিক সম্পর্কের ধারণাটি ভাবনার সঙ্গী হয়েই আছে। (আইডেন্টিটি শব্দটির একাধিক বাংলা হতে পারে সত্তা, পরিচিতি, স্বরূপত্ব ইত্যাদি, কিন্তু শ্রীযুক্ত নরেন্দ্র মোদী নিজেকে গুজরাতি ‘অস্মিতা’র ধারক এবং বাহক হিসাবে তুলে ধরে আপন রাজ্যে অসামান্য নির্বাচনী সাফল্য অর্জনের পরে, কেন জানি না, ‘আইডেন্টিটি অ্যান্ড ভায়োলেন্স’-এর বাংলা হিসেবে ‘অস্মিতা ও হিংসা’ ছাড়া অন্য কিছু লিখতে কলম সরে না।) |
|
আর কি কখনও কবে। শপথ নেওয়ার পরে। ২০ মে, ২০১১। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী। |
ধারণাটি সংক্ষেপে এই রকম। আমাদের প্রত্যেকের অনেক পরিচিতি, অনেক সত্তা। কেমন সেই বহুত্ব? সেটা বোঝানোর জন্য অমর্ত্য সেন একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত ব্যবহার করেছিলেন ‘‘এক জন ব্যক্তি অনায়াসে একই সঙ্গে হতে পারেন ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ থেকে উদ্ভূত মার্কিন নাগরিক, আফ্রিকান পূর্বপুরষের বংশধর (এক অর্থে আমরা সবাই অবশ্য তথা এব চ), খ্রিস্টান, উদারপন্থী, নারী, নিরামিষাশী, দূরপাল্লার দৌড়ে দক্ষ, ইতিহাসবিদ, শিক্ষক, ঔপন্যাসিক, নারীবাদী, বিষমকামী, সমকামীদের অধিকারের প্রতি মর্যাদাশীল, নাট্যমোদী, পরিবেশকর্মী, টেনিসভক্ত, জ্যাজ গানে পারদর্শী, এবং এ সবের পাশাপাশি এই ধারণায় প্রবল ভাবে বিশ্বাসী যে, ব্রহ্মাণ্ডের অন্যত্রও বুদ্ধিমান প্রাণীরা আছে এবং তাদের সঙ্গে কথা বলা অত্যন্ত জরুরি, আর হ্যাঁ, কথাটা ইংরেজিতে বলতে পারলেই ভাল হয়।”
যতগুলো পরিচিতির কথা এখানে বলা হল, ওই ব্যক্তির আইডেন্টিটি তার কোনওটিকেই বাদ দিয়ে নয়, এবং আরও অনেক পরিচয় তাঁর থাকতে পারে। কিন্তু তিনি যদি মনে করেন বা তাঁকে মনে করানো হয়, যে কোনও একটি পরিচিতিই তাঁর একমাত্র বা ‘আসল’ আইডেন্টিটি, তাঁর অস্মিতা? যদি তিনি নিজের সত্তা বলতে কেবল তাঁর খ্রিস্টানত্বকে বোঝেন? কিংবা নারীত্ব? অথবা বিষমকামিতা? তখনই ঈশান কোণে মেঘ ঘনায়, কারণ ওই ‘এক এবং অদ্বিতীয়’ অস্মিতার ধারণা থেকেই অন্যের প্রতি, ভিন্নের প্রতি, বিপরীতের প্রতি একটা অসহিষ্ণুতা জন্মায়, যা সহজেই বিরূপতা, বিদ্বেষ, ঘৃণায় পর্যবসিত হয়, এবং সেখান থেকে আর এক পা এগোলেই হিংসা। এ পাপ আমরা হাড়ে হাড়ে চিনি। আমি হিন্দু/মুসলমান, ও মুসলমান/হিন্দু, তাই ও আমার শত্রু এই সহজ হিসেবের ছিন্নমস্তা ইতিহাস বালকেও জানে। ১৯৪৪ সালে ঢাকা শহরে এগারো বছরের বালক অমর্ত্য দাঙ্গার শিকার দরিদ্র মুসলমান শ্রমিককে চোখের সামনে মারা যেতে দেখেছিলেন। হিন্দু অস্মিতা বনাম মুসলমান অস্মিতার সেই হিংস্র মূর্তি তিনি কখনও ভোলেননি। সে মূর্তি ভোলার নয়।
চল্লিশের দশকে ভারতবর্ষের নানা অঞ্চলে দরিদ্র হিন্দু শ্রমিক এবং দরিদ্র মুসলমান শ্রমিক পরস্পরের বুকে ছুরি বসিয়েছিল, নব্বইয়ের দশকে আফ্রিকার রোয়ান্ডায় হুটু জনজাতির দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষ এবং টুটসি জনজাতির দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষ পরস্পরের ধড় থেকে মাথা নামিয়ে দিয়েছিল। মাত্র দুটি উদাহরণ। এ রকম তো কতই হয়। হয়ে এসেছে। কেন হয়? কী করে হয়? বহু কাল ধরে পাশাপাশি, কাছাকাছি বাস করে আসছে, অনুরাগ এবং বিরাগ, গলাগলি এবং চুলোচুলি, আত্মীয়তা এবং মামলা, সব নিয়েই, সেই মানুষগুলোই কোনও এক সময় কোনও একটা বিশেষ অস্মিতার খোপে নিজেদের বন্দি করে ফেলে এবং পরস্পরকে সংহার করতে মুখোমুখি রথ সংস্থাপন করে সমবেত হয়, কাল অবধি যারা পরস্পরের ভাই ছিল আজ তারা কৌরব বনাম পাণ্ডব হয়ে ওঠে, অন্য সব পরিচয় অবান্তর হয়ে পড়ে। কেন? কোন মন্ত্রে?
|
চিন্তার স্বক্ষমতা |
অমর্ত্য সেনের গ্রন্থে একটি অধ্যায়ের শিরোনাম ‘ফ্রিডম টু থিংক’। তাঁর বক্তব্য, অনেক পরিচিতির স্বাভাবিক বহুত্ব যখন কোনও একটি পরিচিতির দাপটে পর্যুদস্ত হয়, তখন বুঝতে হয়, মানুষ তার চিন্তার স্বক্ষমতা হারিয়েছে। অধ্যাপক সেন ‘ফ্রিডম’ শব্দটির অর্থ করেছেন স্বক্ষমতা। এখানে শব্দটি বিশেষ ভাবে যথাযথ। যে মানুষের নিজের চিন্তার ক্ষমতা আছে, সে নিজেকে একটা পরিচিতির খোপে পুরে ফেলার আগে অন্য পরিচিতিগুলোর কথা দশ বার চিন্তা করবে, সুতরাং অনিবার্য ভাবে যাকে সে শত্রু মনে করছে তাকেও বেমালুম কোনও একটা খোপে পুরে ফেলতে পারবে না, ট্রিগারে আঙুল দিয়ে ভাববে, ‘কিন্তু ওরও তো আমার মতোই একটা মেয়ে আছে, সে-ও রোজ বেণি দুলিয়ে স্কুলে যায়, যে দিন মিড ডে মিলে ডিমের ঝোল থাকে সে দিন তারও মুখটা খুব হাসিখুশি থাকে।’ এ রকম ভাবলে তো ট্রিগারে চাপ দেওয়াই কঠিন। তাই ওই মানুষটার চিন্তার স্বক্ষমতা কেড়ে নেওয়া দরকার। তার মগজে কারফিউ জারি করা দরকার। সে যেন আর সব কিছু ভুলে গিয়ে, এমনকী নিজের কিশোরী মেয়ের মুখটিও ভুলে গিয়ে একটা কথাই ভাবতে পারে আমি সিপিএম/তৃণমূল, ও তৃণমূল/সিপিএম। এই নির্বিকল্প অস্মিতার মন্ত্রে আমাকে, আপনাকে, একে, ওকে, তাকে দীক্ষিত করতে পারলে আর ভাবতে হবে না, ট্রিগারে আঙুলে একেবারে রাজযোটক।
১৯৭৭ থেকে ২০১১ চৌত্রিশ বছর ধরে যাঁরা পশ্চিমবঙ্গ শাসন করেছেন, তাঁদের কেতাবে ব্যক্তিমানুষের চিন্তার স্বক্ষমতার কোনও স্বীকৃতি নেই, কারণ পার্টি স্বর্গ, পার্টি ধর্ম, হৃদিস্থিত পার্টি যে চিন্তায় নিযুক্ত করবে সেটাই ভাবতে হবে, বাকি সবই অ-চিন্তনীয়। আর ‘পার্টি সর্বশক্তিমান, কারণ তাহা সত্য’ এই মহাবাক্য যে মানবে না? সে আমাদের লোক নয়, সে শত্রুপক্ষ। চৌত্রিশ বছর ধরে জেনে এসেছি, মানুষ দুই প্রকার আমরা এবং ওরা। অন্য সব পরিচিতিকে এই মহান দ্বান্দ্বিকতার পায়ে বিসর্জন দেওয়ার পরিণাম কী দাঁড়িয়েছে, হিংসা এবং হিংস্রতা কী ভাবে সমাজমানসে দৃঢ়মূল হয়েছে, সেই কাসুন্দি আজ আর নতুন করে ঘাঁটবার প্রয়োজন নেই।
চৌত্রিশ বছরের শাসন যখন শেষ হল, মনের কোণে ক্ষীণ আশা হয়েছিল, এই হিংসার অবসান না হোক, প্রশমন ঘটবে। অন্তত সব কিছুতে ‘আগে বলো তুমি কোন দলে’ বলে অস্মিতা দেগে দেওয়ার রীতিটা বদলাবে। নতুন জমানার শুরুর দিকে সেই আশা ঈষৎ উৎসাহিতও হয়েছিল। নতুন শাসকদের কথায় এবং কাজে সবাইকে, এমনকী বিরোধীদেরও, সঙ্গে নিয়ে চলার একটা অভিলাষ যেন প্রতিফলিত হচ্ছিল, নানা বিষয়ে ‘সর্বদলীয় সভা’ আয়োজনের উদ্যোগ দেখে কিঞ্চিৎ ভরসা হয়েছিল, সত্যিই বুঝি পরিবর্তন এল। বিবিধ উপলক্ষে মুখ্যমন্ত্রীর আবেগ এবং উৎসাহের প্রাবল্য কিঞ্চিৎ দৃষ্টিকটু ঠেকলেও নিজেকে আশ্বাস দিয়েছিলাম এই অ-স্বাভাবিক উচ্ছ্বাস দিয়েই হয়তো এত দিনের অচলায়তনকে ভাঙতে হবে, এই সর্বগ্রাসী এবং সর্বপ্লাবী আবেগ হয়তো পশ্চিমবঙ্গের মজ্জাগত দলতন্ত্রকেও কিছুটা দুর্বল করবে, বহু মত, বহু রুচি, বহু স্বর সম্মান পাবে, অন্তত একটু হাঁফ ছাড়তে পারবে।
ভুল ভেবেছিলাম। নির্বোধ ভ্রান্তি। বছর না ঘুরতেই দেখা গেল, সবার উপরে অস্মিতা সত্য। দেখতে দেখতে দল এবং সরকার এক হয়ে গেল, সেই দল/সরকারই হয়ে উঠল অস্মিতার কষ্টিপাথর। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও তাঁর সঙ্গীরা যখন ‘আমরা’ বলতেন, তখন প্রায়শই বোঝা যেত না, মহাকরণের কথা বলছেন না আলিমুদ্দিনের। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর অনুগামীদের কথাতেও দ্রুত, অতি দ্রুত, সরকার এবং দল এক দেহে হল লীন।
|
একটি সম্ভাবনার অপমৃত্যু |
এ দলের সেই দাপট নেই, কারণ এ পার্টি সে পার্টি নয়, পলিটব্যুরো থেকে হেঁশেল অবধি বিশ্বব্রহ্মাণ্ড নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা তার নেই, কিন্তু তার স্থান নিয়েছে ব্যক্তির দাপট। সেই দাপটে গোটা দল তৎসহ প্রশাসন সর্বদা তটস্থ হয়ে আছে। এবং এই ব্যক্তিতন্ত্র, হয়তো অনিবার্য ভাবেই, উত্তরোত্তর অসহিষ্ণু, সন্দেহতাড়িত, সমালোচনা মানতে, এমনকী শুনতেও, নারাজ। শাসকদের কণ্ঠে সেই এক জর্জ বুশ রচিত মন্ত্র: হয় তুমি আমাদের দিকে, নয়তো তুমি আমাদের শত্রু।
দুর্ভাগ্য পশ্চিমবঙ্গের, দুর্ভাগ্য তার মুখ্যমন্ত্রীর। একটা খুব বড় সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। খেলাটা পালটে দেওয়ার সুযোগ। মানুষকে একটা সঙ্কীর্ণ অস্মিতার খোপে পুরে না দিয়ে তার বহুত্বকে স্বীকার করে নেওয়ার সুযোগ। বহু রুচি, বহু স্বর, বহু মতকে প্রাপ্য মর্যাদা দেওয়ার সুযোগ। এক দিক থেকে দেখলে, এই সুযোগ কাজে লাগানোর সম্ভাবনাও তাঁর মধ্যে ছিল। তিনি আক্ষরিক অর্থেই আপন দলের সর্বময়ী নেত্রী, অন্তত মহাকরণ-পর্বের প্রথম কিছু কাল তিনি যা বলতেন, তাঁর দল বিনা প্রশ্নে তা-ই শুনত। সেটা শ্লাঘার ব্যাপার নয়, কিন্তু সেটাই ঘটনা। এই স্বক্ষমতা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের তো ছিলই না, এমনকী সনিয়া গাঁধীরও নেই। তাঁরা পরিবর্তন চেয়েছেন কি না সেটা অন্য ব্যাপার, কিন্তু চাইলেও পুরোপুরি পারতেন না। বস্তুত, অনেকটাই পারতেন না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পারতেন।
শুধু তা-ই নয়, তিনি নিজেই নিজের রাজনীতির পথ কেটে উঠে এসেছেন, সুতরাং রাজনীতির একটা নতুন দৃষ্টি এবং নতুন ভাষার নির্মাণ তাঁর কাছে প্রত্যাশিত ছিল। প্রত্যাশিত ছিল যে, জগৎ এবং জীবনকে অন্য ভাবে দেখার একটা পথ খুঁজে দিতে পারবেন নেত্রী। খুঁজে নিতেও। বুঝতে পারবেন, একটা প্রশ্নে যে তাঁর পাশে আছে, আর একটা প্রশ্নে সে-ই তাঁর বিপরীতে থাকতে পারে, এটাই গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য, এখানেই তার শক্তি, এই নিতান্ত স্বাভাবিক ঘটনাবলি থেকে শত্রুমিত্রবিনিশ্চয়ের কোনও মানেই নেই। নতুন জমানার সর্বাধিনায়িকা এই সহজ সত্যটি বুঝতে পারলে, বুঝতে চাইলে, পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতির একটা নতুন ধারা তৈরি হত। বস্তুত, একটা নতুন ইতিহাসের সৃষ্টি হত।
হল না। সি পি আই এম বিদায় নিল, কিন্তু তার তৈরি করে দেওয়া খেলাটা বদলাল না। অস্মিতা এবং হিংসা-র খেলা। |
|
|
|
|
|