টিপু সুলতানের কেল্লায় ভেঁপু বাজল। আদুর গায়ে বাদ্যকার বাহিনীর চার ধারে দ্রুত লোক জমে গেল। গোটা চত্বরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নানা মাপের সিপিএম নেতারা এক বার করে দেখে গেলেন। কিন্তু কেল্লার বাইরে কাক ভোর থেকে জড়ো-হওয়া জনতা তাঁদের দেখতে চায় না! তাদের জিজ্ঞাস্য একটাই। তাদের ‘সুলতান’ কোথায়?
পার্টি কংগ্রেস উপলক্ষে কোঝিকোড়ে অধুনা লুপ্ত টিপু সুলতানের অস্থায়ী কেল্লার আদলে সজ্জিত টেগোর সেন্টিনারি হলের বাইরে ‘সুলতান’ যখন পা দিচ্ছেন, তখনও ভেঁপু-বাদ্য চলছে। সহর্ষ জনতা ঘিরে ধরেছে তাঁর রথ। এর পর কী করবেন? একটু হেসে ‘সুলতান’ বললেন, “পার্টি করব। পার্টির কাজ যেমন করছি, করে যাব।” দলের সিদ্ধান্ত মেনে নিচ্ছেন? জবাব “পার্টি কংগ্রেস ১৫ সদস্যের নতুন পলিটব্যুরো বেছে নিয়েছে। তারা পার্টির কাজ আরও উন্নত করার জন্য সচেষ্ট হবে।”
ভিড়ের মধ্যে রাস্তা করে জনসভা নয়, তিরুঅনন্তপুরমের উদ্দেশে রওনা হয়ে গেল কেরল সিপিএমের অশীতিপর ‘সুলতানে’র রথ। পার্টি কংগ্রেসের জন্য আপাদমস্তক রঙীন কোঝিকোড়েও ‘ট্র্যাজিক নায়ক’ হয়ে থেকে গেলেন ভেলিক্কাথু শঙ্করন অচ্যুতানন্দন! দলের শেষ জীবিত প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, এই পড়তি বয়সেও গত বছর প্রায় একার কাঁধে জোয়াল টেনে রাজ্যে সিপিএম তথা এলডিএফ-কে সরকার গড়ার একেবারে চৌকাঠে এনে ফেলেছিলেন। তবু পলিটব্যুরোর দরজা তাঁর জন্য আর খুলল না।
পার্টি কংগ্রেস শেষ হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরে সন্ধ্যায় কোঝিকোড়ে আরব সাগরের তীরে দলীয় সমাবেশে দেখা গেল না কেরলের বিরোধী দলনেতাকে। ভি এস শুধু বলে গিয়েছেন, তিরুঅনন্তপুরম ফিরতে হবে বলে সমাবেশে থাকতে পারলেন না। জনতা অবশ্য একে ‘বয়কট’ই বলছে।
ভি এসের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী, কেরল সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক পিনারাই বিজয়ন কিন্তু পার্টি কংগ্রেস ‘সফল’ করতে চেষ্টার কোনও কসুর করেননি। এক সপ্তাহ ধরে রাস্তায় সাড়ে পাঁচশো স্বেচ্ছাসেবক নামিয়ে রেখেছেন পার্টি কংগ্রেস অভিমুখী যান চলাচল মসৃণ করার জন্য। দলের হাতে-থাকা কোঝিকোড় পুরসভাকে ধরে অধিবেশন স্থলের নিকাশি ব্যবস্থা নতুন করে গড়িয়েছেন। সমাবেশের গোটা বিকাল জুড়ে শহরের তিন প্রান্ত থেকে এনে বিচ রোডে ২৫ হাজার ‘রেড গার্ড্স’-এর কুচকাওয়াজ করিয়েছেন। তবু অদৃষ্ট এমনই! সমাবেশে বিজয়ন বক্তৃতা করতে ওঠা মাত্র ভি এসের নামে স্লোগান শুরু! কারাট ভি এসের অবদানের কথা উল্লেখ করতেই চিৎকার আরও প্রবল! ভিন্ রাজ্যের অতিথিরা জেনে গেলেন, আয়োজন যা-ই থাক। সিপিএম জনতা এক বৃদ্ধকেই চায়!
এই জনতাই সোমবার সকাল থেকে কোঝিকোড় শহরের দখল নিয়ে রেখেছিল। জেলার নানা প্রান্ত থেকে আসা এক একটা জটলা যাবতীয় ছোট-বড় রেস্তোরাঁর দরজা আগলে দাঁড়িয়ে আছে! পার্টি কংগ্রেসের মিডিয়া কভারেজের জন্য কার্ডধারী সাংবাদিক দেখে “দেখি তো কেন্দ্রীয় কমিটির তালিকাটা” বলে ঝটাপট গুটিকতক ফোটোকপি করে আবার হাতে ধরিয়ে দিয়ে যাচ্ছে! কোনও অটো বিচ রোডের দিকে যাওয়ার প্রশ্নই নেই দিনভর। এই উৎসাহী জনতার পায়ের চাপে গোটা সৈকত সকাল থেকেই কেঁপেছে! কারাট থেকে ইয়েচুরি সবার মুখ থেকেই আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির ব্যাখ্যা ধৈর্য ধরে শুনেছে জনতা। কিন্তু দিনের শেষে দেশজ নায়কের কথা তাদের শোনা হল না! রাতে এই জনতার মুখ দেখেই দলের এক তরুণ নেতা বললেন, “এই দায়ের মাসুল দিতেই হবে!”
অথচ কী না করেননি বিজয়নেরা? পার্টি কংগ্রেসের মতো একটা দলীয় ইভেন্টকে বাণিজ্যিক ভাবে বিপণন করে দেখিয়েছেন। ‘সমাজতন্ত্রই ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক একটা ইতিহাস-প্রদর্শনী করেছেন, যেখানে ভর দুপুরেও আম আদমির ভিড় উপচে পড়েছে এ দিন পর্যন্ত। একের পর এক ‘স্যুভেনির’ বেরিয়েছে, যে কোনও বড় প্রকাশনা সংস্থাকে লজ্জায় ফেলে দেওয়ার মতো! পলিটব্যুরোর সদ্য নির্বাচিত সদস্য এম এ বেবির কথায়, “সারা রাজ্য নয়, শুধু কোঝিকোড় জেলা কমিটিই ৫ কোটি ৬০ লক্ষ টাকা তুলে দিয়েছে পার্টি কংগ্রেসের জন্য। সমাবেশেও অন্য জেলাকে লোক দিতে বারণ করেছিলাম আমরা।” পশ্চিমবঙ্গ সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু সসম্ভ্রম স্মরণ করছেন, “আমাদের রাজ্যে সন্ত্রাস-কবলিতদের পাশে দাঁড়ানো জন্য কেরল রাজ্য কমিটি অল্প দিনে প্রায় পৌনে চার কোটি টাকা তুলে দিয়েছিল আমাদের রাজ্য কমিটির হাতে। কেরলের মানুষের এই হৃদয়কে আমি সেলাম করি!”
কেরল সিপিএমের ‘সুলতান’ অবশ্য রয়ে গেলেন এই সমারোহের ভেঁপুর অনেক দূরেই! |