শীর্ষনেতৃত্বে বিরাট কোনও পরিবর্তন নেই। নতুন পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটিতে কার্যত কোনও ‘চমক’ ছাড়াই কোঝিকোড় পার্টি কংগ্রেসে ইতি টানলেন সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট। এরই মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের প্রাপ্তি রাজ্য থেকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে তিন নতুন মুখ। হাওড়া জেলার শ্রমিক নেতা দীপক দাশগুপ্ত, মুর্শিদাবাদের নৃপেন চৌধুরী এবং উত্তর ২৪ পরগনা থেকে রেখা গোস্বামী। কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে বাদ বিনয় কোঙার।
এ বারও রবীন দেবের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হল না। কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে বাদ পড়লেও বিনয়বাবুকে কেন্দ্রীয় কন্ট্রোল কমিশনের চেয়ারম্যান পদে বসানো হয়েছে। বয়সজনিত অসুস্থতার কারণে সরে দাঁড়ালেও মহম্মদ আমিনকে ‘বিশেষ আমন্ত্রিত’ হিসেবে কেন্দ্রীয় কমিটিতে রেখে দেওয়া হয়েছে।
আজ পার্টি কংগ্রেসের মঞ্চ থেকে যে নতুন পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা হল, তা নিয়ে অবশ্য দলের মধ্যেই ‘প্রশ্ন’ রয়েছে। রয়েছে ‘ক্ষোভ’ও। দলের শীর্ষকমিটিতে যথেষ্ট পরিমাণে সংখ্যালঘু, তফসিলি জাতি-উপজাতি ও হিন্দি বলয়ের নেতাদের প্রতিনিধিত্ব নেই বলেই মনে করছেন পার্টি কংগ্রেসের অধিকাংশ প্রতিনিধি। পলিটব্যুরোয় এতদিন একমাত্র মুসলিম নেতা ছিলেন মহম্মদ আমিন। আমিনের অনুপস্থিতিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে থাকছেন এম এ বেবি। তবে তিনি খ্রিস্টান। সিপিএমের নেতাদের একাংশের বক্তব্য, ‘স্খ্যালঘু’ বলতেই যে ‘মুসলিম’ বোঝানো হয়, সেই ‘সঙ্কীর্ণতা’ থেকে তাঁরা বেরিয়ে আসতে চান। এমনকী, যে হিন্দি বলয়ে সিপিএম পা ফেলতে মরিয়া, সেই উত্তর ভারত থেকে গত পলিটব্যুরোয় কেউ ছিলেন না। এবারও নেই। জাতপাতের রাজনীতির ফাঁসে আটক সিপিএমের পলিটব্যুরোয় দলিত বা আদিবাসী নেতাও জায়গা পাননি।
তবে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ব্যাখ্যা, সম্প্রদায় বা এলাকা ভিত্তিক নেতৃত্ব বাছাইয়ের দিকে না গিয়ে ‘গুণগত’ মানের উপরই বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। সঙ্কটের সময় সেটাই প্রয়োজন। দলের অধিকাংশের মতে, উত্তর ভারত থেকে পলিটব্যুরোয় আসার মতো নতুন কোনও হিন্দিভাষী নেতাও সে ভাবে উঠে আসেননি। কেন্দ্রীয় কমিটিতে যে নতুন ১৩ জন সদস্য এসেছেন, তার মধ্যে হিন্দিভাষী রাজ্যের একমাত্র প্রতিনিধি ঝাড়খণ্ডের। তবে দলের হিন্দি মুখপত্রের সম্পাদক রাজেন্দ্র শর্মাকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে আনা হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গ থেকে অনেকেই মনে করেছিলেন, এবার রবীনবাবুর কেন্দ্রীয় কমিটিতে আসা পাকা। কিন্তু তা হয়নি। এ কে গোপালন ভবনের এক পলিটব্যুরো নেতার বক্তব্য, এ বিষয়ে রাজ্য সম্পাদকই নাম প্রস্তাব করেন। কিন্তু আলোচনায় সময় তিনি (বিমান বসু) রবীনবাবুর নাম তেমন ‘জোর’ দিয়ে বলেননি। তবে মুর্শিদাবাদের নৃপেন চৌধুরীকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে নিয়ে আসার বিষয়ে তিনি ‘জোর’ দিয়েছেন। মূলত কংগ্রেস প্রভাবিত জেলায় সংগঠন তৈরি করার ‘সাফল্যে’ ভর করে ২০১০ সালে ‘মিতভাষী’ নৃপেনবাবু রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীতে আসেন। বর্তমানে রাজ্যে কৃষক সভার কার্যনির্বাহী সম্পাদক যাবতীয় বিতর্ক এড়িয়ে চলেন।
রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী থেকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে এসেছেন সিটু নেতা দীপকবাবু। রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী রেখাদেবী মহিলা সমিতির ‘বলিয়ে-কইয়ে’ নেত্রী বলে পরিচিত। সিপিএমের রাজ্য নেতৃত্বে মহিলাদের আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়ে তিনি বরাবরই সরব ছিলেন। উত্তর ২৪ পরগনার গোষ্ঠী রাজনীতিতেও তিনি গৌতম দেবের ‘কাছের লোক’ বলেই পরিচিত। গৌতমবাবু নিজেও কেন্দ্রীয় কমিটিতে রয়েছেন। উত্তর ২৪ পরগনার গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব সামলাতে রাজ্য সম্মেলনের আগে তাঁকে জেলা সম্পাদকের ভার দেওয়া হয়। আবার তিনি রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীরও সদস্য। তাই এবার তিনি কেন্দ্রীয় কমিটিতে থাকবেন কি না, তা নিয়ে জল্পনা ছিল। পার্টি কংগ্রেস শেষে তিনি তিনটি পদেই বিদ্যমান।
সাধারণ সম্পাদক কারাটের সামনে এখন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হল, দলের পার্টি কেন্দ্র বা এ কে গোপালন ভবনকে আরও ‘শক্তিশালী’ করা। এবার পার্টি কংগ্রেসের সাংগঠনিক রিপোর্টে অভিযোগ উঠেছে, বিভিন্ন রাজ্যের গণ সংগঠনগুলির রিপোর্ট খতিয়ে দেখতে দিল্লির পার্টি কেন্দ্রে বা এ কে গোপালন ভবনে কর্মরত পলিটব্যুরো সদস্যরা ‘ব্যর্থ’ হয়েছেন। এ নিয়ে বিতর্কের জবাবে এস আর পিল্লাই যুক্তি দিয়েছেন, আগে দিল্লিতে সাতজন পলিটব্যুরো সদস্য কাজ করতেন। এঁদের মধ্যে এম কে পান্ধের মৃত্যু হয়। আমিনও পরের দিকে রাজ্যেই বেশি থাকতেন। ফলে সংগঠনের নানা কাজে ‘গাফিলতি’ হয়েছে। এখন কারাট, এস আর পিল্লাই, সীতারাম ইয়েচুরি, বৃন্দা কারাট ও কে বরদারাজন দিল্লিতে কাজ করেন। এবার পলিটব্যুরোর নতুন সদস্য, সিটু-র সর্বভারতীয় সভাপতি এ কে পদ্মনাভনকেও পার্টি কেন্দ্রের কাজে অনেক বেশি সময় দিতে হবে। পাশাপাশি কেরল থেকে পলিটব্যুরোয় আসা বেবিকেও আস্তে আস্তে দিল্লিতে নিয়ে আসা হবে।
এ বার কেন্দ্রীয় কমিটির নতুন ১৩ জন সদস্যের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ ও তামিলনাড়ু থেকে তিনজন করে এবং কেরল, অন্ধ্র, মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, ঝাড়খণ্ড, অসম থেকে এক জন করে নেতা এসেছেন। কমিটির সদস্য সংখ্যা ৮৭ থেকে বাড়িয়ে ৮৯ করা হলেও দু’টি আসন শূন্য রয়েছে। ওই দু’টি আসনে বিহার ও ত্রিপুরার একজন করে প্রতিনিধিকে পরে নিয়ে আসা হবে। গত পার্টি কংগ্রেসে জ্যোতি বসুকে পলিটব্যুরোর ‘স্থায়ী আমন্ত্রিত’ সদস্য করা হয়েছিল। এ বার পলিটব্যুরোয় তেমন কোনও পদ রাখা হয়নি। তবে কেন্দ্রীয় কমিটিতে দু’জন স্থায়ী আমন্ত্রিত রয়েছেন। চারজন ‘বিশেষ আমন্ত্রিত’র মধ্যে রয়েছেন সমর মুখোপাধ্যায় ও মহম্মদ আমিন। বিনয়বাবুর নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের কন্ট্রোল কমিশনে পশ্চিমবঙ্গ থেকে স্থান পেয়েছেন প্রাক্তন সাংসদ মিনতি ঘোষ। |