কলকাতা থেকে কোঝিকোড় ‘হটলাইন’ খোলাই ছিল! পার্টি কংগ্রেস শেষ হওয়ার আগের রাতে সেই যোগাযোগেই পলিটব্যুরোর তরফে সীতারাম ইয়েচুরি তাঁকে শেষ বারের মতো অনুরোধ করেছিলেন শেষ দিন সকালে দলের সাধারণ সম্পাদকের ফোনটা যখন আসবে, তিনি যেন ‘না’ না-বলেন! দলের স্বার্থে, সকলের স্বার্থে।
অন্য জন ব্যক্তিগত ‘প্রোফাইলে’ বিশ্বাসই করেন না। দশ মাস আগে দল যখন বিরোধী দলনেতার দায়িত্ব দিয়েছে, রাজি হয়েছেন। পরে বলেছেন, আর কোনও ‘বিকল্প’ ছিল না বলেই তাঁকে ওই পদের জন্য বাছা হয়েছে। কোঝিকোড়ের টেগোর সেন্টিনারি হলে আজ দুপুরে যখন ভিন্ রাজ্যের একের পর প্রতিনিধি তাঁকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন, কমিউনিস্ট-সুলভ নিষ্পৃহতা ভেঙে কেউ কেউ জড়িয়েও ধরছেন, হাসিমুখেও তাঁর সেই এক কথা “আমি দলের অনুগত সৈনিক। দলের নির্দেশ পালন করাই আমার কাজ।”
প্রথম জন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। পার্টি কংগ্রেসে অনুপস্থিতির ‘ছুটি’ মঞ্জুর হয়েছিল। কিন্তু পলিটব্যুরো থেকে যাঁর এ যাত্রায় ‘ছুটি’ পাওয়া হল না।
দ্বিতীয় জন সূর্যকান্ত মিশ্র। দলে যাঁর ‘পদোন্নতি’ হল।
সিপিএমের বিংশতিতম পার্টি কংগ্রেস থেকে নবনির্বাচিত পলিটব্যুরোয় পাশাপাশি স্থান রইল পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও বর্তমান বিরোধী দলনেতার। ফলে শেষ বেলায় যথেষ্টই ‘স্বস্তি’তে আলিমুদ্দিন। দলে বুদ্ধবাবুর ভূমিকা যে এখনও ‘অপরিহার্য’, সেই ‘বাস্তব’ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পাশাপাশিই বঙ্গ সিপিএমে ‘সূর্যোদয়’ও ঘটল! বিধানসভা ভোটে বিপর্যয়ের ধাক্কা কাটিয়ে উঠে পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম-কে আগামী দিনে এগিয়ে নিয়ে যেতে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গেই অধুনা বিরোধী দলনেতা দলের ‘বাজি’ হতে চলেছেন এই রোডম্যাপের উপর পার্টি কংগ্রেসের সিলমোহর পড়ল।
পাশাপাশিই, ‘কাব্যে উপেক্ষিত’ থেকে গেলেন শ্যামল চক্রবর্তী। গত বারও পলিটব্যুরোয় যাওয়ার জন্য প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেনের সঙ্গেই তাঁর নাম বিবেচিত হয়েছিল। কিন্তু শ্যামলবাবুকে পিছনে ফেলে পলিটব্যুরোয় ঢুকে পড়েন নিরুপমবাবু। ঘটনাচক্রে, এ বার সিটুর ‘কোটা’য় (মহম্মদ আমিনের পরিবর্তে। বয়সের কারণে পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন রাজ্যের শ্রমিক নেতা আমিন) পলিটব্যুরোয় গেলেন সূর্যবাবু। ঠাঁই হল না শ্যামলবাবুর। যা থেকে এটাও স্পষ্ট যে, দলের অন্যতম নীতিনির্ধারক কমিটিতে সিটুর গুরুত্ব ক্রমশই ‘খর্ব’ হচ্ছে।
বুদ্ধবাবু ‘অভিমানী’। তিনি অসুস্থ। কলকাতার বাইরে যাওয়ার বিষয়ে প্রবল ‘অনীহা’। বিভিন্ন জেলা বা আচমকা ঘটনা ঘটলে ঘটনাস্থলে দ্রুত পৌঁছতে অনিচ্ছুক। তবুও বুদ্ধবাবুকে পলিটব্যুরোয় রেখে দেওয়ার কারণ এখনও রাজ্যে তিনিই ‘সিপিএমের মুখ’। যে কোনও বড় সমাবেশে তিনিই ‘তারকা বক্তা’। তাঁকে কেন্দ্র করেই দল অবর্তিত হয়। ছাত্র-যুবদের কাছেও সর্বাধিক ‘গ্রহণযোগ্যতা’ এখনও তাঁরই। ফলে তাঁর পলিটব্যুরোয় থাকা জরুরি। |
পলিটব্যুরোয় নতুন মুখ। (বাঁ দিক থেকে) সূর্যকান্ত মিশ্র, এম এ বেবি
এবং এ কে পদ্মনাভন। সোমবার কোঝিকোড়ে। ছবি: পি টি আই |
কোঝিকোড় থেকে আজ সকালে নতুন পলিটব্যুরোর রাখার জন্য ‘সম্মতি’ চেয়ে যথারীতি কলকাতায় বুদ্ধবাবুকে ফোন করেছিলেন প্রকাশ কারাট। ‘না’ বলেননি পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর বঙ্গীয় সতীর্থদের পাশাপাশিই আশ্বস্ত হয়েছেন ইয়েচুরি! যিনি বুদ্ধবাবুকে পলিটব্যুরোয় রাখার জন্য গত কয়েক মাস টানা লড়ে গিয়েছেন। বুদ্ধবাবু নিয়মিত সদস্য হিসেবেই থেকে যাওয়ায় এবং সূর্যবাবুর অন্তর্ভুক্তির ফলে ১৫ সদস্যের পলিটব্যুরোয় এখন পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধির সংখ্যা দাঁড়াল চার। বাকি দু’জন রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু ও প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেন।
সূর্যবাবুর অন্তর্ভুক্তি নতুন ‘উচ্ছ্বাসে’র সঞ্চার করেছে রাজ্য সিপিএমে। বিরোধী দলনেতার দায়িত্ব পাওয়ার পরে (বিধানসভা ভোটের আগে গৌতম দেব ছিলেন সিপিএমের ‘পোস্টার-বয়’। বামেরা ক্ষমতাচ্যুত হলে তিনিই বিরোধী দলনেতা হবেন, তা এক প্রকার ঠিক ছিল। কিন্তু গৌতমবাবু হেরে যাওয়ায় দল সূর্যবাবুকে সেই দায়িত্ব দেয়) গত কয়েক মাসে দ্রুত সর্ব স্তরে নিজের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে ফেলেছেন সূর্যবাবু। দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের কথায়, “সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সূর্যদার কথা বলার ধরন শিক্ষণীয়। যে ভাবে বিভিন্ন বিষয়ে তিনি সরকারকে বিঁধেছেন, তা-ও বুদ্ধদা-বিমানদার নজর এড়ায়নি। ওঁরা দু’জনেই বিরোধী দলনেতার ভূমিকায় খুশি ছিলেন।” বহু দিন আগে থেকেই নেতা হিসেবে সূর্যবাবু দলের নজরে ছিলেন। পেশায় চিকিৎসক এবং একদা মেদিনীপুর জেলা পরিষদের সভাধিপতি সূর্যবাবুর রাজনীতিতে আগমন সাতের দশকে, বিমানবাবুরই নজরে পড়ে। কিন্তু মন্ত্রী হিসেবে তিনি সরকারে এতটাই ‘ব্যর্থ’ ছিলেন, যে তাঁকে নেতা হিসেবে তুলে ধরার ঝুঁকি দল নিতে চায়নি। কিন্তু গত ১০ মাসে প্রশাসক ও রাজনীতিকের মিশেলে দায়িত্বশীল বিরোধী দলনেতা হিসেবে তিনি ‘অপ্রত্যাশিত’ রকমের সার্থক। চরিত্রগত ভাবে মিতবাক, পশ্চিম মেদিনীপুরের নারায়ণগড় থেকে বিধানসভায় নির্বাচিত ৬৩ বছরের নেতা তাঁর নতুন সংসদীয় ভূমিকায় এমন কোনও অত্যুক্তি করেননি, যাতে মনে হয়, ক্ষমতা হারিয়ে সিপিএম অধৈর্য হয়ে উঠেছে। দলীয় নেতৃত্বের মতে, দ্রুত সিপিএমের নাগরিক মুখ হয়ে উঠতে পেরেছেন সূর্যবাবু। জঙ্গি বিবৃতি দিয়ে বাজার গরম করার রাজনীতিতে যাঁর উৎসাহ নেই। বরং তথ্য সংবলিত কথা বলতেই তিনি বেশি অভ্যস্ত।
পলিটব্যুরোর নেতা হিসেবে রাজ্যে বাকিদের মধ্যে নিরুপমবাবু পুরোপুরি সুস্থ নন। তিনি বিভিন্ন তাত্ত্বিক বিষয়েই বেশি স্বচ্ছন্দ। বিমানবাবুর যেমন সংগঠক ও নেতা হিসেবে যথেষ্ট ইতিবাচক দিক আছে, তেমনই দুমদাম মন্তব্য করে ফেলার নেতিবাচক দিকও রয়েছে। বিধানসভা ভোটে নজিরবিহীন ভরাডুবির পর বুদ্ধবাবু এখনও আলিমুদ্দিনের ঘরেই বেশি স্বচ্ছন্দ। ফলে এমন কাউকে প্রয়োজন ছিল সিপিএমের, যিনি নিজেকে এই সঙ্কট সময়ে নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। সূর্যবাবু সে দিক দিয়ে সফল। দলীয় সূত্রের খবর, বুদ্ধবাবুর নিজস্ব মতামতও সূর্যবাবুর পক্ষেই গিয়েছে। |
পার্টি কংগ্রেসের শেষ দিনে সিপিএমের মিছিল।
সোমবার কোঝিকোড়ে পিটিআইয়ের ছবি। |
সেই ‘পারফরম্যান্স’ এবং পলিটব্যুরোয় অগ্রজের সম্মতিতেই এ বার দলীয় স্তরে স্বীকৃতি পেলেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা। রাজ্য-রাজনীতিতে বিরোধী দলনেতার গুরুদায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি দলের পলিটব্যুরো সদস্যও এখন তিনি। যৌথ দায়িত্ব পালন করতে অসুবিধা হবে না? পার্টি কংগ্রেস শেষ হওয়ার অব্যবহিত পরে সূর্যবাবুর জবাব, “ব্যক্তির কথা এখানে আসছে না। দল যা দায়িত্ব দিয়েছে, তা-ই পালন করেছি। তা-ই করব।” বুদ্ধবাবুও পলিটব্যুরোয় তাঁর সতীর্থ হিসেবে থেকে গেলেন, এটা কি বাড়তি স্বস্তি? সূর্যবাবুর সহাস্য প্রতিক্রিয়া, “স্বস্তি এটাই যে, জল্পনা শেষ হল!”
বুদ্ধবাবুর জন্য ইয়েচুরির প্রচেষ্টা ‘সফল’ হলেও দলের আর এক প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর জন্য তাঁর লড়াই অবশ্য পুরোপুরি কার্যকরী হয়নি। পলিটব্যুরোয় শেষ পর্যন্ত ফেরানো হয়নি ভি এস অচ্যুতানন্দনকে। অশীতিপর নেতাকে রেখে দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবেই। তবে পলিটব্যুরোর এক সদস্যের কথায়, “কেন্দ্রীয় কমিটি থেকেও বৃদ্ধ মানুষটিকে ছেঁটে ফেলার চেষ্টা হচ্ছিল! সেটা যে রোখা গিয়েছে, এটাই সান্ত্বনা!” বলাই বাহুল্য, ওই নেতার ইঙ্গিত কেরল সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক পিনারাই বিজয়নের নেতৃত্বাধীন গোষ্ঠীর প্রবল ভি এস-বিরোধিতার দিকে।
এ বারের পলিটব্যুরোয় নতুন মুখ তিন জন পশ্চিমবঙ্গের সূর্যবাবু, কেরলের এম এ বেবি এবং তামিলনাড়ুর এ কে পদ্মনাভন। পশ্চিমবঙ্গের চার জন ও ত্রিপুরার মানিক সরকারকে বাদ দিলে ১৫ জনের মধ্যে ১০ জনই দক্ষিণী সদস্য! স্বয়ং কারাট ও তাঁর ঘরণী বৃন্দা কারাট, সীতারাম ইয়েচুরি, এস রামচন্দ্রন পিল্লাই, কে বরদারাজন, বি ভি রাঘবুলু, পিনারাই বিজয়ন, কোডিয়ারি বালকৃষ্ণন, বেবি এবং পদ্ননাভন।
ভি এস পলিটব্যুরো থেকে বহিষ্কৃত হওয়ায় বিগত কমিটিতে কেরলের একটি স্থান ফাঁকা ছিল। কেরলের বেবি বিজয়ন-গোষ্ঠীর লোক হিসেবে রাজ্যের তৃতীয় স্থানটি পূরণ করেছেন। বেবির কথায়, “ছাত্র রাজনীতি থেকে এই পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে আসছি এটাই আমার কাছে বড় কথা।” প্রয়াত এম কে পান্ধের বদলে পলিটব্যুরোয় এ বার শ্রমিক ফ্রন্টের প্রতিনিধিত্ব করবেন সিটুর সর্বভারতীয় সভাপতি পদ্মনাভন। যদিও তাঁর দাবি, “এমন কোনও ‘কোটা’র ব্যবস্থা নেই। সে ভাবে আমি বা কেউ পলিটব্যুরোয় ঢুকিওনি!” নতুন পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচনের পর কারাট বলেছেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের বড় দায়িত্ব নিতে হবে। রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কর্তব্য পালন করতে হবে। যেতে হবে মানুষের কাছেই। ধৈর্য ধরে তাঁদের মধ্যে কাজ করতে হবে এবং তাঁদের নিয়ে আসতে হবে আমাদের পাশে।”
বলাই বাহুল্য, তার আগে সর্বসম্মতিক্রমে তৃতীয় বারের জন্য সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন কারাট! পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটিতে প্রত্যাশিত ভাবেই তাঁর পাল্লা ভারী।
তবু সিপিএমের পার্টি কংগ্রেসের কাহিনি কোনও মোচড় ছাড়া ফুরোবার নয়! নতুন কেন্দ্রীয় কমিটির নামের প্যানেলের বিরুদ্ধে একটা ভোট পড়েছে! দিয়েছেন এক বঙ্গসন্তান! ডিওয়াইএফের সাধারণ সম্পাদক তাপস সিংহ। এক ভোট। তবু ‘সর্বসম্মত’ তো হল না!
|
সূর্যকান্তর ছবি: সন্দীপন চক্রবর্তী |