এটা আমের বছর। কিন্তু দীর্ঘ শীত আর চৈত্রের কালবৈশাখীর তাণ্ডব ও শিলাবৃষ্টি আম চাষি এবং আম ব্যবসায়ীদের সব হিসেব উল্টে দিতে বসেছে।
এক বছর আমের ফলন ভাল না হলে, পরের বছর ভাল হয়। এটাই আমের ধরন। সেই হিসেবে এ বার আমের ফলন বেশি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মুকুল আসার সময় থেকে ফল পুষ্ট হয়ে পর্যন্ত বার বার খেয়ালি আবহাওয়ায় বিভিন্ন জায়গায় আমের ফলন মার খেতে চলেছে। বিশেষ করে রাজ্যের সিংহ ভাগ আম যে জেলা থেকে আসে সেই মালদহে। তবে আবহাওয়ার এই অবস্থায় মালদহের বিশেষ করে একটি প্রজাতির আম এবং মুর্শিদাবাদের বেশির ভাগ প্রজাতির আমের ফলন ভাল হবে বলেই আশা করছেন আম চাষি এবং বিজ্ঞানীরা। আলিপুর আবহাওয়া দফতরের কৃষি সুপারিশ বিভাগের বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, বৃষ্টিতে মাটিতে রস ঢোকায় বিভিন্ন গাছে যে সব আম রয়ে গিয়েছে, সেগুলির স্বাদ ভাল হবে বলেই আশা করা যায়।
তবে আম জনতার আমের জোগান দেয় মালদহ, আর মুর্শিদাবাদ থেকে আসে কদরের আম। সেই মালদহের আমের ফলনেই প্রভাব ফেলেছে কালবৈশাখী। এই দফতরের কৃষি পরামর্শদাতা বিভাগ তাদের সমীক্ষায় দেখেছেন, এবার শীতে ঠান্ডার কামড় যেমন ছিল তুলনায় বেশি, তেমনই শীত ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহ পেরিয়ে বিদায় নিয়েছে। এক বিজ্ঞানী জানান, অনুকূল আবহাওয়া না থাকায় এবার আম গাছে মুকুল এসেছে দেরিতে এবং বিভিন্ন গাছে তুলনায় কম মুকুল হয়েছে। সেই সব গাছে আম যখন অনেকটাই পুরুষ্টু হয়ে উঠছিল, সেই সময় কালবৈশাখীর ঝড় এবং শিলা-বৃষ্টি আমের ফলনে প্রভাব ফেলেছে।
কী ভাবে? মালদহ ম্যাঙ্গো মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক সুবোধ মিশ্র বলেন, “এ বছর আম যা হওয়ার কথা ছিল, তার অর্ধেকও হয়নি। যেটুকু হয়েছিল, তার বেশিরভাগটাই সাফ হয়ে গেল ঝড় আর শিলাবৃষ্টিতে। এই ব্যাপক শস্যহানির প্রভাব তো আমের বাজারে পড়বেই। তবে বৈশাখের শেষ পর্যন্ত আরও কতগুলো কালবৈশাখী বা দুর্যোগ হয়, তা না দেখে আমের ভবিষ্যৎ এখনই নিশ্চিত করে বলা যাবে না।” অবস্থা কতটা খারাপ বোঝাতে ৭৬ বছর বয়সী আম চাষি এবং আম ব্যবসায়ী সুবোধবাবু বললেন, “৪০ বছর ধরে আমি আমের কারবার করছি। কিন্তু এমন ভয়াবহ অবস্থা আমি দেখিনি।”
সরকারি পরিসংখ্যান কী বলছে? মালদহের উদ্যানপালন ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ দফতরের উপ অধির্কতা প্রিয়রঞ্জন সানিগ্রাহী বলেন, “শিলাবৃষ্টিতে ৩২ হাজার মেট্রিক টন আম নষ্ট হয়েছে। যার আর্থিক মূল্য ৩ কোটি ২০ লক্ষ টাকা। মালদহের ইংরেজবাজার, মানিকচক , কালিয়াচক ১ ও ২, রতুয়া ১ ও ২ এবং হরিশ্চন্দ্রপুর ১ ও ২ নম্বর ব্লকের আমবাগানে আমের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।” গত বছর জেলায় ২ লক্ষ ২৫ হাজার মেট্রিক টন আমের ফলন হয়। এ বার যে হারে মুকুল এসেছিল, তাতে জেলার উদ্যানপালন ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ দফতরের কর্তারা জানান, এ বছর দেড় লক্ষ মেট্রিক টন আম হওয়ার সম্ভাবনা আছে। শিলাবৃষ্টিতে জেলার ২৮ হাজার হেক্টর আম বাগানের ৪ হাজার হেক্টর বাগানের আম নষ্ট হয়ে গিয়েছে। উত্তরবঙ্গ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অশোক সাহা বলেন, “এ বার প্রথমে শুখার জেরে আম চাষে সমস্যা হয়। অনেক গাছে মুকুল আসেনি। বাকি যে সব গাছগুলিতে মুকুল এসেছিল শিলাবৃষ্টিতে তা প্রায় পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গিয়েছে।’’ ঝড়ে আম গাছ থেকে পড়ে যায়। কিন্তু শিলাবৃষ্টিতে কী ভাবে ক্ষতি হয় আমের? আলিপুর আবহাওয়া দফতরের অধিকর্তা গোকুলচন্দ্র দেবনাথ বলেন, “যে সব আমে শিলার আঘাত লাগে সেগুলিতে ছত্রাকের সংক্রমণ হয়। তাতে হয় আম পচে যায় নয়তো বোঁটা ছিঁড়ে পড়ে যায়।” বিপদ আরও আছে। মালদহের বিভিন্ন আমবাগানে গত কয়েক বছর ধরে একটি পোকা ফসলের ক্ষতি করছে। এবার আবহাওয়ার খালখেয়ালিপনায় সেই পোকার উপদ্রব বেড়েছে। পোকা থেকে মুক্তি দিতে পারে একমাত্র কীটনাশক। কিন্তু মালদহের ওই পোকা কীটনাশকে প্রতিরোধী হয়ে গিয়েছে। তবে মুর্শিদাবাদের চিত্রটা অবশ্য অন্য রকম। মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুরের আম ব্যবসায়ী সানাউল্লা শেখ এবং লালবাগের আমচাষি হায়াতুন নবি বলেন, “আম উঠতে এখনও অনেক দেরি। পুরো বৈশাখ পড়ে রয়েছে। যদি আবার কোনও বড় ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় না হয়, তা হলে আমের দর নিয়ে উৎকণ্ঠার তেমন কিছু নেই।” ওই জেলায় এবার ঝড়-বৃষ্টি হলেও শিলাবৃষ্টি হয়নি। তাই জেলার চন্দনকোষা, রানিপসন, বীরা, গোলাবখাস, চম্পা, কোহিতুর, লক্ষ্মণভোগের মতো বিশেষ প্রজাতির আমের ক্ষতির আশঙ্কা কম। জেলার উদ্যানপালন দফতরের সহ অধিকর্তা শুভদীপ নাথের কথায়, “এই বিশেষ প্রজাতির আমগুলির ব্যাপক হারে চাষ হয় না। তাই তার ক্ষতিও কমই হবে। বরং এই বৃষ্টিতে গাছ জল পাওয়ায় ওই আমগুলি আরও সুস্বাদু হয়ে উঠবে।” কৃষি সুপারিশ বিভাগের বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, লক্ষণভোগ আমের মুকুল দেরিতে আসে। এ বার শীত দীর্ঘায়িত হওয়ায় ওই আমের মুকুল খুব বেশি এসেছিল। ঝড়ে অনেক মুকুল পড়ে যাওয়ায় যেগুলি গাছে রয়ে গিয়েছে সেগুলি পুরুষ্টু হবে। আমের দুরবস্থায় এইটুকুই যা ভাল খবর! |