সমস্ত বিতর্ক দূরে সরিয়ে রেখে রাজ্যের উন্নয়ন ও তার অভিমুখকেই এ বার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই অন্য মন্ত্রীদের না পাঠিয়ে তিনি নিজেই দিল্লি এসে রাজ্যের বরাদ্দ নিয়ে যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়ার সঙ্গে বৈঠকে বসছেন।
সোমবার সন্ধ্যায় দিল্লি আসছেন মমতা। অহলুওয়ালিয়ার সঙ্গে বৈঠক হবে মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে তিনটেয়। বরাদ্দ নিয়ে সচরাচর যোজনা কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র ও পরিকল্পনা মন্ত্রী মণীশ গুপ্ত। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁরা তো আসছেনই, থাকছেন পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে মন্টেকের সঙ্গে আলোচনায় গ্রামোন্নয়নের বিষয়টিতে মুখ্যমন্ত্রী যে বাড়তি জোর দেবেন, প্রতিনিধি দলে বর্ষীয়ান মন্ত্রী সুব্রতবাবুর সংযোজনে সেই ইঙ্গিত মিলেছে।
গত বছর পশ্চিমবঙ্গের জন্য ২২,২১৪ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিল যোজনা কমিশন। এ বার রাজ্য তা বাড়িয়ে অন্তত ২৪ হাজার কোটি করার দাবি জানিয়েছে। নিজেদের দাবি ব্যাখ্যা করে রাজ্য সরকারের পক্ষে কমিশনের কাছে একটি রিপোর্টও পাঠানো হয়েছে। কিন্তু কমিশন জানিয়েছে, বরাদ্দের পরিমাণ বড়জোর ২৩,৩০০ কোটি টাকা করা যেতে পারে। এই বিষয়টি নিয়ে মমতার সঙ্গে মন্টেক ও তাঁর দলবলের যে দর কষাকষি হবে, তা নিশ্চিত। কিন্তু শুধু বরাদ্দের পরিমাণ নয়, কোন খাতে বরাদ্দ, সে বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। মমতা বলেন, “কোন খাতে কত বরাদ্দ হবে এবং রাজ্যের আর্থ-সামাজিক বিকাশে তা কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে, সে বিষয়টাও বিশেষ জরুরি। যেমন আমরা এসে সামাজিক খাতে বরাদ্দের পরিমাণ ৪৯% করেছিলাম। এ বার তা আরও বাড়িয়ে ৫৩% করা হয়েছে।”
অর্থাৎ উন্নয়নের প্রশ্নে বরাদ্দের পরিমাণের সঙ্গে তার ভারসাম্যের উপরেও জোর দিচ্ছেন মমতা। এ প্রসঙ্গে প্রায়ই অন্ধ্রের বিষয়টি উল্লেখ করেন মুখ্যমন্ত্রী। চন্দ্রবাবু নায়ডুর আমলে অন্ধ্রপ্রদেশের উন্নয়ন নিয়ে প্রচুর ঢাকঢোল পেটানো হত। ঝাঁ চকচকে সাইবার সিটি তৈরি হয় সেখানে। বিদেশের বহু কর্পোরেট সংস্থা লগ্নি করতেও এগিয়ে আসে। কিন্তু সেই অন্ধ্রেই কৃষকদের অভাবী আত্মহত্যা গোটা বিশ্বের নজর কেড়েছিল। উন্নয়নের বিষয়টি যাতে সেই বেপরোয়া ‘কর্পোরেটাইজেশন’-এর দিকে না যায়, সে বিষয়ে মমতার বিশেষ নজর রয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “মাত্র ১০ মাস হল আমরা রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছি। এই স্বল্প সময়ে আমরা গ্রাম ও শহরের সাধারণ গরিব মানুষের উন্নয়নে বেশ কিছু কাজ করেছি। আরও করব।” তাঁর কথায়, সদ্যোজাত সরকার অনভিজ্ঞতার জন্য হয়তো কিছু ভুলচুক করছে। কিন্তু তাকে অতিক্রম করে রাজ্যকে উন্নয়নের গন্তব্যে পৌঁছে দিতেই হবে।
সোমবার সকাল ১০টা থেকে রাজ্যের বিভিন্ন দফতরের অফিসারদের সঙ্গে যোজনা কমিশনের প্রতিনিধিদের আলোচনা শুরু হবে। যোজনা কমিশনে পশ্চিমবঙ্গ বিষয়ক উপদেষ্টা ও অন্যান্য কর্তারা এই বৈঠকে থাকবেন। তার পরে মঙ্গলবার সকালে রাজ্যের মুখ্যসচিব সমর ঘোষ ও পরিকল্পনা সচিব জয়া দাশগুপ্তের সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক হবে যোজনা কমিশনের প্রতিনিধিদের। বিকেলে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে একান্ত বৈঠক হবে অহলুওয়ালিয়ার। এর পরে মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে তিন মন্ত্রী-সহ রাজ্যের সব প্রতিনিধি মুখোমুখি বৈঠকে বসবেন মন্টেকের নেতৃত্বাধীন কমিশনের প্রতিনিধির সঙ্গে। আজ সন্ধ্যাতেই দিল্লি পৌঁছেছেন রাজ্যের ১৬-১৭ জন অফিসার।
পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক সঙ্কট মোকাবিলায় ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে নেওয়া ঋণে সুদ-ছাড় চেয়েছে রাজ্য সরকার। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী এর জন্য কেন্দ্রের উচ্চতম মহলে দরবার করেছেন। যোজনা কমিশনের এই বৈঠকের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই, সুদ-মকুবের বিষয়টি খোদ অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বিবেচনাধীন। তবে কি দিল্লি এসে প্রণববাবুর সঙ্গেও বৈঠকে বসছেন মুখ্যমন্ত্রী? এই প্রশ্নের উত্তরে মমতা বলেন, “প্রণববাবুর সঙ্গে আমার সব সময়েই যোগাযোগ রয়েছে। নিয়মিত টেলিফোনে কথা হয়। তিনি অভিজ্ঞ নেতা, প্রবীণ মানুষ। সরকার পরিচালনার বিভিন্ন ক্ষেত্রেও আমি তাঁর পরামর্শ নিয়ে চলি।”
আগামী এক মাসের মধ্যে দু’বার মুখ্যমন্ত্রীদের বৈঠকে ডেকেছে কেন্দ্র। ১৬ এপ্রিল অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিষয়ে এবং ৫ মে জাতীয় সন্ত্রাসবাদ-দমন কেন্দ্র (এনসিটিসি) নিয়ে। কিন্তু যোজনা কমিশনের বৈঠকে আসছেন বলে ১৬ তারিখের বৈঠকে থাকছেন না মমতা। তবে ৫ মে-র বৈঠকে অবশ্যই থাকতে চান তিনি। মূলত তাঁর দাবিতেই কেন্দ্র এনসিটিসি নিয়ে আলাদা করে মুখ্যমন্ত্রীদের এই বৈঠক ডেকেছে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে শরিক তৃণমূলকে না চটানোর কৌশল নিয়েছে কংগ্রেস। কারণ পাটিগণিতের অঙ্কেই তৃণমূলের সমর্থন ছাড়া পছন্দের প্রার্থীকে রাষ্ট্রপতি ভবনে পাঠানো কংগ্রেসের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। এ জন্য মমতার সরকারকে সহায়তার নীতিই নেওয়া হয়েছে। তৃণমূলের বিরুদ্ধে নালিশ নিয়ে প্রদেশ কংগ্রেসের যে নেতৃত্ব হাইকম্যান্ডের দ্বারস্থ হয়েছিল, তাদেরও সেই কথা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাজ্যের ১১টি পিছিয়ে পড়া জেলার জন্য ইতিমধ্যেই ৮৬৬৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে যোজনা কমিশন। এর এক তৃতীয়াংশ রাজ্য হাতেও পেয়ে গিয়েছে। পিছিয়ে পড়া জেলাগুলির পানীয় জল, সড়ক, আবাসন, হস্তশিল্প ও খেলাধুলোর উন্নয়নে সে অর্থ ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছে রাজ্য। লোকপাল বিল থেকে এনসিটিসি সম্প্রতি নানা বিষয়ে কেন্দ্রের সঙ্গে মমতার সংঘাত বেধেছে। কিন্তু মমতাও কেন্দ্রের সঙ্গে বিরোধের বিষয়টি আপাতত মুলতুবি রেখে রাজ্যের উন্নয়নকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। সেই জন্যই গুরুত্ব পেয়ে গিয়েছে মমতার এই দিল্লি সফর। |