আলিমুদ্দিনের শাখা? শীর্ষক সম্পাদকীয় (২-৪) পড়ে কয়েকটি কথা লিখছি। আমাদের রাজ্যে উচ্চশিক্ষার সর্বত্র ক্ষমতার যে জবরদস্তি বিগত সাড়ে তিন দশক ধরে বামপন্থী শাসকরা করেছেন, যে ভাবে উৎকর্ষ ধ্বংস পেয়েছে দলতন্ত্র, চাটুকারিতার অপরাধ ও সার্বিক অধঃপাত ঘটেছে, তা আপনারা স্বীকার করেছেন। এই ভাবে চরম অপমানিত হয়েছেন অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্যের মতো উপাচার্য। যিনি তাঁর তিক্ত অভিজ্ঞতার স্মৃতি পুঞ্জিত করেছেন তাঁর ‘রেড হ্যামার ওভার ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি ১৯৮৪১৯৮৭’ শীর্ষক ৬২৩ পৃষ্ঠার গ্রন্থে। আমাদের তো মনে হয় না, কোনও ‘আলিমুদ্দিনের শাখা’র পক্ষেই এর চেয়ে হীন কোনও অপকর্ম করা সম্ভব।
বিরাজমান পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাকেন্দ্রগুলিতে দলীয় কর্মীরা ছেয়ে গেছেন। তাঁরা তাঁদের অপকর্মের ধারাবাহিকতা চালিয়ে যাচ্ছেন। কারণ, সারস্বত ক্ষেত্রে ময়দানি গণতন্ত্র বা সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে পেশি আস্ফালন করে তাঁরা সর্বত্র ছড়ি ঘুরিয়ে চলেছেন।
উচ্চশিক্ষা সংসদ যদি এ-ব্যাপারে কোনও পরামর্শ না-দেয়, তা হলে তো আলিমুদ্দিনের মূল কাণ্ডই প্রসারিত থাকবে! আপনারা নিশ্চয়ই তা চাইছেন না। উচ্চশিক্ষা সংসদ তো আলাদা কোনও ক্ষমতার কেন্দ্র নয়, তা তো বৈধ একটি সংস্থা। আপনাদের ভাষায় ‘অনিলায়ন’-এর সঙ্গে এর পার্থক্য আছে। শুনেছি, একটা সময়ে পশ্চিমবঙ্গের উপাচার্যরা আলিমুদ্দিনে স্লিপ পাঠিয়ে নেতাদের ঘরের বাইরে অপেক্ষা করতেন। ওই নেতাদের শিক্ষা-দীক্ষা-রুচির মান কী রকম ছিল, তা লিখতে চাই না। তুলনায় আইন মোতাবেক একটি সঠিক অর্থে স্বচ্ছ শিক্ষা-প্রশাসনের কাঠামো থাকলে আপত্তি করার তো কোনও হেতু দেখছি না।
পরিবর্তন হোক। নতুন উদ্যম আসুক। সেই উদ্যমকে সন্দেহ না-করে সমর্থনই তো বেশি করে করা দরকার আজ। তা না-হলে ছাত্র আন্দোলনে হাত-পাকানো, আলিমুদ্দিন মার্কা ‘বিশেষজ্ঞ’-দের দ্বারা নির্বাচিত (!) অধ্যাপক-সেপাই-সান্ত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্তামি করে যাবেন, এটা বোঝার জন্য খুব বেশি বুদ্ধি খরচ করতে হয় না। ত্রিগুণা সেন থেকে নিহত উপাচার্য গোপাল সেনের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, অরবিন্দ-রবীন্দ্রনাথ-বিনয় সরকারদের জাতীয় শিক্ষা পর্ষদের উত্তরাধিকার ত্যাগ করে আলিমুদ্দিনের শাখা হয়েছে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলিও তাই। আপনাদের সম্পাদকীয়তে তাকে নির্দেশ না-করে ঘুলিয়ে দিলেন কেন, বুঝলাম না। |
অচিন্ত্য বিশ্বাস। বিভাগীয় প্রধান, বাংলা,
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা-৩২
|
নাশভিল প্রবাসী (টেনেসি, ইউ এস এ) শুভঙ্কর মুখোপাধ্যায়ের চিঠিতে ‘এ মণিপুর কিন্তু সে মণিপুর নয়’ (২১-৩) পড়লাম। “রাজীবাক্ষ রক্ষিত মণিপুরকে চিত্রাঙ্গদার দেশ বলে বর্ণনা করেছেন, সেটা ঠিক নয়” পত্রকারের মন্তব্য। একদা আচার্য সুনীতিকুমার মহাভারতীয় মণিপুর নামের ভূসংস্থানগত নির্দেশনায় ওড়িশার একটি স্থানের উল্লেখ করেছিলেন।
মহাকাব্যে বর্ণিত অজস্র স্থান-নামের ঐতিহাসিক-ভৌগোলিক সংশয় প্রত্নতত্ত্বগত। কিন্তু ‘কবি, তব মনোভূমি রামের জনমস্থান অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।’ পত্রকার স্বয়ং মন্তব্য করেছেন, ‘মিথ আর ইতিহাস তো এক নয়।’ তবে? চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্য (১৩৪৬) রচনার প্রায় ৪৪ বছর আগে রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাব্যনাট্য ‘চিত্রাঙ্গদা’ (১২৯৯) রচনার প্রেরণালাভের উল্লেখ করে (দ্র: রবীন্দ্ররচনাবলী ৩য় খণ্ড, চিত্রাঙ্গদা-র কবিকৃত ভূমিকা) লিখেছেন, “এই ভাবটাকে নাট্য-আকারে প্রকাশ-ইচ্ছা তখনই মনে এল, সেই সঙ্গেই মনে পড়ল মহাভারতের চিত্রাঙ্গদার কাহিনী।” সুতরাং মহাভারতোক্ত ‘মণিপুর’ নামের সংস্কারই রবীন্দ্রনাথের মনে ছিল। কাব্যনাট্যটির নবম সর্গে আছে, বনচরদের মুখে অর্জুন শুনলেন ‘উত্তর পর্বত হতে আসিছে ছুটিয়া দস্যুদল’। নৃত্যনাট্যে ‘মল্লপল্লি’ নামটি আছে। কিন্তু পত্রকার ‘মাল্লাপল্লি’ পেলেন কোথায়? ‘মল্ল’ অর্থ কুস্তিগীর, যোদ্ধা বোঝায়। মণিপুরে ‘থাংতা’ নামের রণনৃত্যের প্রচলন আছে। আর ‘মাল্লাপল্লি’ মালোপাড়া বা জেলেদের পাড়া হলেই তা সমুদ্রতীরবর্তী কেন হবে? মালোদের ‘তিতাস’ কি সমুদ্রতীরবর্তী? চিত্রাঙ্গদা মণিপুরের কাহিনি বলেই মণিপুরী নৃত্যের প্রয়োগ। এ ধারণাও ভুল। কবির প্রিয় মণিপুরী নৃত্য আরও আগে ১৯২৬-এ ‘নটীর পূজা’তেও ব্যবহৃত হয়েছিল। এ-কালে ওড়িশি নৃত্য-আঙ্গিকেও ‘চিত্রাঙ্গদা’ পরিবেশিত হয়।
তার কারণ, মণিপুরকে ওড়িশাপল্লি বলে বিশ্বাস থেকে নয়, রবীন্দ্র-নৃত্যশৈলীর সীমা প্রসারণের স্বার্থে। |
অরুণকুমার বসু। প্রাক্তন অধ্যাপক,
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা-৩১ |