আটশো চার জনের মধ্যে মাত্র দুই জন আপত্তির হাত তুলিয়াছিলেন। কেরলের কোঝিকোড়ে অনুষ্ঠিত সি পি আই এমের পার্টি কংগ্রেসে পেশ হওয়া রাজনৈতিক প্রস্তাবে হয়তো অনেকেরই অনুমোদন ছিল না। কিন্তু সেই আপত্তি বা প্রতিবাদ তাঁহারা কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যাসবশত মনের ভিতরেই চাপিয়া রাখেন। তবে প্রস্তাবের উপর ভোটাভুটির সময় অন্তত দুই জন প্রতিনিধির মনে হইয়া থাকিবে, আপত্তির কথা প্রকাশ্যে নথিভুক্ত করা উচিত। তাঁহারা তাই প্রস্তাবের বিপক্ষে হাত তুলিয়া ফেলেন। এই অকিঞ্চিৎকর মতান্তরের প্রদর্শনীও পলিটব্যুরোর কোনও কোনও সদস্যের পছন্দ হয় নাই। কমিউনিস্ট পার্টিতে শীর্ষ নেতৃত্বের বাঁধিয়া দেওয়া লাইনে সর্বসম্মতিই রেওয়াজ। কোনও প্রতিনিধি সংশোধনী আনিতে পারেন, তবে তাহা গৃহীত হওয়ার নজির নাই। তাই পার্টি কংগ্রেসের আসরে রাজনৈতিক প্রস্তাবে আপত্তির হাত উত্তোলন লইয়া এত কথা। এই বিচলন দেখাইয়া দেয়, স্তালিনবাদী সাংগঠনিক স্বৈরতন্ত্রই এখনও সব কমিউনিস্ট দলের অনুশীলিত কর্মনীতি, ‘গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা’ একটি গাল-ভরা প্রচ্ছদের প্রতারণা মাত্র।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহিত পরমাণু সহযোগিতা চুক্তির প্রশ্নে ইউ পি এ সরকার হইতে সমর্থন প্রত্যাহারের দলীয় সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল, রাজনৈতিক পর্যালোচনা রিপোর্টের ওই সিদ্ধান্তকেই পশ্চিমবঙ্গ ও কেরলের নেতারা তাঁহাদের রাজ্যে দলের নির্বাচনী ভরাডুবির কারণ রূপে শনাক্ত করিয়া আসিয়াছেন। মায়াবতীকে প্রধানমন্ত্রী করিয়া অ-কংগ্রেসি ও অ-বিজেপি দলগুলির তৃতীয় ফ্রন্ট গড়ার পরিকল্পনাও যে আকাশকুসুম ছিল, একাধিক দলনেতা তাহা স্বীকার করিয়াছেন। কিন্তু যখন এই দুই সিদ্ধান্তের যাথার্থ্য ঘোষণা করিয়া পার্টি কংগ্রেসে রিপোর্ট পেশ হইল, তখন কেরল ও পশ্চিমবঙ্গের কমরেডরাও তাহাতে অনুমোদনের সিলমোহর লাগাইলেন। পার্টি লাইনের অভ্রান্ততার ধারণা দেশে-দেশে নেতৃপূজার প্রচলন করে। গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার দোহাই দিয়া সংগঠনকে নিচু তলা হইতে যে ভাবে ধাপে-ধাপে গড়িয়া তোলা হয়, তাহাতে কংগ্রেস বা কেন্দ্রীয় কমিটির বর্ধিত বৈঠকেও পলিটব্যুরোর শীর্ষ পদাধিকারীদের লাইনই মান্যতা পাইবে, তাহা আগাম নিশ্চিত করা থাকে।
গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতায় গণতন্ত্রের উপাদান সামান্যইতৃণমূল স্তর হইতে পার্টি-কমিটিগুলির নির্বাচিত হইয়া আসাতেই তাহা সীমাবদ্ধ। কিন্তু বিভিন্ন স্তরের বিভিন্ন কমিটিতে কাহারা সদস্য হইবেন, তাহা সর্বদাই উপরতলা হইতে স্থির করিয়া দেওয়া হয়। কেন্দ্রীয় কমিটি যেমন রাজ্য কমিটির সদস্যদের তালিকা তৈয়ার করে, রাজ্য কমিটি তেমনই জেলা কমিটিরএই ভাবে উপর হইতে নির্ণয় করা নামের প্যানেলই ভোটাভুটির জন্য পেশ হয়, প্রায়শ কোনও ভোটাভুটিও হয় না। প্যানেল তৈয়ারির সময় খেয়াল করা হয় যেন আপত্তির হাত তুলিতে পারেন, এমন কমরেডদের নাম বিবেচিত না হয়। ফলে সংগঠনের কোনও স্তরেই মনান্তর, মতভেদ বা বিভাজনের শঙ্কা থাকে না। সর্বসম্মতিক্রমে দলীয় লাইন অর্থাৎ পলিটব্যুরোর শাসক গোষ্ঠীর লাইন অনুমোদিত হইয়া যায়। পার্টির সর্ব স্তরের নির্বাচন উচ্চতর কমিটির দ্বারা আগাম নিয়ন্ত্রিত হইয়া থাকে। দলের ভিতর মতপার্থক্য সহ্য না-করার এই ঐতিহ্যের সযত্ন অনুশীলনই ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট দলগুলিকে ভিন্ন মতের প্রতি, আপত্তি ও প্রতিবাদের প্রতি, এমনকী গঠনমূলক সমালোচনা ও শুভ পরামর্শের প্রতিও অসহিষ্ণু করিয়া তোলে। পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘ বাম জমানায় রাজ্যবাসী তাহা প্রত্যক্ষও করিয়াছেন। পরাভূত, ক্ষেত্রবিশেষে নিশ্চিহ্ন হইয়াও ভারতীয় কমিউনিস্টরা অভ্যাস বদলান নাই। প্রমাণ কোঝিকোড়। |