বাড়ছে না ভাড়া, বাস্তব ছেড়ে দলীয় নীতিতে বন্দি অটো-বৈঠক
ন্যান্য গণপরিবহণের মতো অটোর ভাড়াও বাড়তে না-দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল রাজ্য সরকার। এবং এ ক্ষেত্রেও বাস্তবকে পিছনে সরিয়ে নীতি-ই প্রাধান্য পাওয়ায় মূল সমস্যার সুরাহা অধরা রয়ে গেল। অটোয় বাড়তি যাত্রী তোলার ‘বেআইনি’ দাবিটিও অবশ্য নাকচ হয়ে গিয়েছে ।
কী ছিল মূল সমস্যা?
গত এক বছরে অটোর জ্বালানি গ্যাসের দাম বেড়েছে ৪১%। যন্ত্রাংশের দামও লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। অর্থনীতির নিয়ম মেনে তাই অটোর ভাড়াবৃদ্ধিই ছিল সঙ্কট মোকাবিলার স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত পথ। উপরন্তু অটোর উপার্জনে নিম্নবিত্ত হাজারো মানুষ নির্ভরশীল, দৈনন্দিন রোজগারে টান পড়লে মূল্যবৃদ্ধির বাজারে যাঁদের পক্ষে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। তাই তাঁদের দাবি ছিল, জ্বালানির দামের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে ভাড়া বাড়ানো হোক। ইতিমধ্যে ইউনিয়ন কয়েকটি রুটে অল্পবিস্তর ভাড়া বাড়িয়েছে ঠিকই, তবে অটোচালকদের মতে, ব্যয়বৃদ্ধির তুলনায় তা নগণ্য।
এই পরিস্থিতিতে অটোচালকদের একাংশের আশা ছিল, সরকার ভাড়াবৃদ্ধিতে সায় দেবে। কিন্তু রবিবার ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রে অটো-ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আয়োজিত বৈঠকে অর্থনীতির যুক্তি খারিজ করে ‘দলীয় নীতি’-ই প্রতিষ্ঠা করেছেন রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র। বৈঠকের পরে তিনি বলেন, “অটোর ভাড়া বাড়ানো হবে না।”
একই সঙ্গে ভাড়াবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত গ্রহণের ‘একতরফা অধিকার’ও ইউনিয়নগুলোর হাতে আর রাখতে চাইছে না রাজ্য। মন্ত্রীর মন্তব্য, “অনেক অটো ইউনিয়ন ভাবছিল, সরকার না-বাড়ালে নিজেরাই ভাড়া বাড়িয়ে নেবে! তা বরদাস্ত করা হবে না। এ ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক করা হয়েছে।” এ দিন অটো ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের মন্ত্রী জানিয়ে দেন, কোন রুটে কী ভাড়া হবে, সরকারই তা ঠিক করার কথা ভাবছে। তবে কোনও অবস্থাতেই ভাড়া বাড়বে না।
দশ দাওয়াই
• কোনও মতেই ভাড়া বাড়ানো যাবে না
• চার জনের বেশি যাত্রী তোলা যাবে না
• কোনও অবরোধ-ধর্মঘট করা যাবে না
• বিজ্ঞাপন দিয়ে আয় বাড়ানোর ভাবনা
• রাজ্যে নতুন অটো কেনা-বেচা বন্ধ
• পারমিট, রুট ঠিক করতে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি
• অটোচালকদের লাইসেন্স বাধ্যতামূলক
• সব অটোকেই রাস্তার বাঁদিক ঘেঁষে চলতে হবে
• অটো চালকদের জন্য নির্দিষ্ট পোশাকের ভাবনা
• হাই সিকিওরিটি নম্বর প্লেট লাগানোর উদ্যোগ
এর আগে ‘দলীয় নীতি’ অমান্য করে রেল ভাড়া বাড়াতে গিয়ে রেলমন্ত্রীর পদ ছাড়তে হয়েছে দীনেশ ত্রিবেদীকে। বাস-মিনি-ট্রাম-ট্যাক্সির মতো অটোর ক্ষেত্রেও তৃণমূল নেতৃত্ব সেই নীতি বহাল রাখায় অটোচালকদের রোজগারে যে কোপ পড়বে, সরকার তা অস্বীকার করতে পারছে না। বস্তুত সেই কারণেই অটোচালকদের আয়বৃদ্ধির ‘বিকল্প’ পথ খুঁজতে এ দিন একটি কমিটি গড়েছে রাজ্য।
মন্ত্রী বলেন, “কমিটিকে বলা হয়েছে অন্য ভাবে আয় বাড়ানোর ব্যাপারে ভাবনা-চিন্তা করতে। দেখা হচ্ছে, অটোর পিছনে বা মাথায় বিজ্ঞাপন দেওয়া যায় কি না।”
কিন্তু এ ভাবে অটোচালকদের মূল সমস্যার কতটা সমাধান করা যাবে?
বস্তুত এই প্রশ্ন ঘিরে সংশয় এখন প্রায় সব মহলে। এমনকী, ওই ‘বিকল্প’ পথে অটোচালকদের আয় বাড়ার নিশ্চয়তা স্বয়ং মদনবাবুও দিতে পারেননি। পরিবহণ-সূত্রের খবর: সম্প্রতি ট্যাক্সিতে বিজ্ঞাপন লাগিয়ে উপার্জন বাড়ানোর চেষ্টা হয়েছিল। তাতে ফল মেলেনি।
আয় না-বাড়লে ভবিষ্যতে কী হতে পারে? অর্থনীতির শিক্ষকদের একাংশের মতে, আয় কমতে থাকলে অটো বা বাসের সংখ্যা কমতে বাধ্য। যে কারণে রাস্তায় বেসরকারি বাসের কমেওছে। এ বার অটোয় কোপ পড়লে সাধারণ মানুষই দুর্ভোগে পড়বেন। অর্থনীতির শিক্ষক অভিরূপ সরকারের মন্তব্য, “কোনও না কোনও দিন ভাড়া বাড়াতেই হবে। কমিটি কী সিদ্ধান্ত নেয়, সে দিকে লক্ষ্য রাখব।” তবে সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে অটোচালকেরা আর বিক্ষোভ-অবরোধে নামতে পারবেন না বলে এ দিন আমজনতাকে আশ্বাস দিয়েছেন পরিবহণমন্ত্রী। “নেতৃত্বকে না-জানিয়ে ধর্মঘট-অবরোধ-ভাঙচুর করা যাবে না। করলে আইন অনুযায়ী সরকার কড়া ব্যবস্থা নেবে।” হুঁশিয়ারি দেন তিনি। ‘অবৈধ’ অটোর রমরমা রুখতে পশ্চিমবঙ্গে নতুন অটো কেনাবেচা বন্ধ রাখারও নির্দেশ দেন মদনবাবু। তিনি জানান, এ বিষয়ে আজ, সোমবার সরকারি নির্দেশিকা জারি হবে। মন্ত্রীর দাবি, ৮ তারিখের পরে কোনও বিক্রেতা (ডিলার) অটো বেচলে তাঁর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কেউ অটো কিনলেও তাকে অবৈধ হিসেবে গণ্য করবে সরকার।
শহর-শহরতলির অটোকে ‘নিয়মে বাঁধতে’ এ দিন একগুচ্ছ পরিকল্পনাও নিয়েছে রাজ্য। মদনবাবু জানান, এ বার থেকে লাইসেন্স ছাড়া কেউ অটো চালাতে পারবে না। অটো চলবে রাস্তার বাঁ দিক ধরে। অটোয় চার জনের বেশি যাত্রী তোলা যাবে না। অটোয় লাগাতে হবে হাই-সিকিওরিটি নম্বর প্লেট। মন্ত্রীর বক্তব্য, “একই নম্বর লাগিয়ে একাধিক অটো চলছে। হাই-সিকিওরিটি নম্বর প্লেট লাগানো হলে এই জালিয়াতি বন্ধ করা যাবে।” ট্যাক্সির মতো অটোচালকদেরও উর্দি চালু করার প্রস্তাব দিয়েছেন পরিবহণমন্ত্রী। অন্য দিকে অটোচালকদের উপরে ‘পুলিশি জুলুমের’ অভিযোগটিকে সরকার গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। মন্ত্রী বলেন, “অটো যেমন রাস্তা জুড়ে থাকবে না, তেমন পুলিশকেও বলা হয়েছে অটোচালকদের অযথা হয়রান না-করতে।” মন্ত্রী জানান, অটোকে ‘নিয়মে বাঁধতে’ গঠিত কমিটির আহ্বায়ক হয়েছেন পরিবহণ দফতরের যুগ্ম সচিব বিশ্বজিৎ দত্ত। আগামী ৭২ ঘণ্টায় কমিটি বেলতলায় মোটর ভেহিক্লসের অফিসে প্রথম বৈঠক করবে। সেখান থেকেই কমিটির অফিসের ঠিকানা ও ফোন নম্বর জানিয়ে দেওয়া হবে। মদনবাবুর কথায়, “মানুষ প্রয়োজনে কমিটিকে পরামর্শ দিতে পারবেন। নতুন করে অটোর রুট চালুর পরামর্শও নেওয়া হবে।”
এ দিন ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রে অটো ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকের পরে মদনবাবু এ-ও বলেন, “এই প্রথম রাজ্য সরকার অটো ইউনিয়নগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসল। বৈঠকে সকলকে আসতে বলা হয়। অনেক বামপন্থী ইউনিয়নের প্রতিনিধিও এসেছেন। এমন বৈঠক রাজ্যে আগে হয়নি।” মন্ত্রী দাবি করলেও সিটু ইউনিয়নের কোনও প্রতিনিধি অবশ্য এ দিনের বৈঠকে ছিলেন না। ছিলেন না আইএনটিইউসি-র প্রতিনিধিও। কী বলছেন তাঁরা? সিটু প্রভাবিত অটো অপারেটর্স ইউনিয়নের সভাপতি কিশোর ঘোষ বলেন, “আমরা বৈঠকের কথা জানতাম না। আমাদের ডাকাও হয়নি।” আইএনটিইউসি ইউনিয়নের নেতা রমেন পাণ্ডের আক্ষেপ, “তৃণমূল সব কিছু নিজেদের ইচ্ছেমতো করছে! প্রস্তাব দিয়েছিলাম, সব ট্রেড ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের ডেকে বৈঠক হোক। সরকার মানল না!” বিরোধী ইউনিয়নগুলির অভিযোগ: স্থানীয় তৃণমূল নেতার ‘শংসাপত্র’ না-থাকলে এ দিনের বৈঠকে ঢুকতেও দেওয়া হয়নি। যদিও পরিবহণমন্ত্রীর দাবি, “বৈঠক ছিল সকলের জন্য। কাউকেই আলাদা করে ডাকা হয়নি।” বৈঠকের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে বিরোধী ইউনিয়নগুলির কী মত? বিরোধী ইউনিয়নের নেতারা তাতেও বিশেষ আশার আলো দেখছেন না। বরং তাঁদের বক্তব্য, ভাড়া না-বাড়িয়ে বিজ্ঞাপন থেকে বাড়তি আয়ের প্রস্তাবটি ‘সোনার পাথরবাটি’ ছাড়া আর কিছু নয়।
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.