কালবৈশাখীর দাপট অব্যাহত রাজ্যের জেলায় জেলায়। যার জেরে শনিবার দক্ষিণবঙ্গে মৃত্যু হল ১১ জনের। অন্য দিকে, শুক্রবারের ঝড় ও শিলাবৃষ্টিতে উত্তরবঙ্গে মৃতের সংখ্যা বেড়ে হল ৪। জখম হয়েছেন অনেকে। ভেঙেছে বহু গাছপালা, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কাঁচাবাড়ি। তার ছিঁড়ে যাওয়ায় নানা এলাকায় বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সব মিলিয়ে বিপর্যস্ত হয় জনজীবন।
সবচেয়ে ক্ষতি হয়েছে উত্তর দিনাজপুরের চোপড়া এবং মালদহের। চোপড়ায় ঝড় ও শিলাবৃষ্টিতে শুক্রবার সন্ধ্যায় মারা গিয়েছিলেন রসমত আলি। জখম হয়েছিলেন ৩টি শিশু-সহ অন্তত ৭০ জন। তাঁদের মধ্যে রাতে মারা যান দরিয়াগছ গ্রামের বাসিন্দা হুলাসু দাস (৫৫)। রাতে মালদহের রতুয়া, হরিশ্চন্দ্রপুর এবং ইংরেজবাজারের বিস্তীর্ণ এলাকায় শিলাবৃষ্টি হয়। প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, শিলার আঘাতে মৃত্যু হয় ইংরেজবাজারের নঘরিয়া গ্রামের বীরেন রবিদাস (৪৬) এবং বজ্রপাতে মারা যান চাঁচলের সাঞ্জিব গ্রামের আসমা বিবির (৪০)। জখম হন অনেকে। |
দুর্যোগ কেড়ে নিয়েছে আশ্রয়। ইংরেজবাজারের বিবেকানন্দ পল্লিতে মনোজ মুখোপাধ্যায়ের তোলা ছবি। |
উত্তরবঙ্গে শনিবার কালবৈশাখীর দাপট না থাকলেও দক্ষিণবঙ্গের রেহাই মেলেনি। বজ্রপাতে মুর্শিদাবাদে মারা যান পাঁচ জন। পুলিশ জানায়, মৃতেরা হলেন সাগরদিঘি থানার পিলকি গ্রামের সমর দাস (৩৫), হরিহরপাড়া থানার মামদালিপুরের হাবিবুর রহমান (২৪), জলঙ্গি থানার বিশ্বাসপাড়ার সাইফুল ইসলাম (২২), রানিনগর থানার শেখপাড়ার বাবু শেখ (৩৫) এবং বহরমপুর থানার শিবপুর গ্রামের বিজেতা সোরেন (৩২)। এঁদের কেউ খেতে কাজ করতে গিয়েছিলেন, কেউ ছিলেন বাড়িতে। আহত হন দু’জন। তাঁদের বহরমপুর নিউ জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে।
এ দিন গোসাবার লাক্সবাগানের রিতা মণ্ডল (৭০) এবং সাতজেলিয়ার সনৎ মিস্ত্রি (৬০) বজ্রপাতে মারা যান। ক্যানিং মহকুমার বহু এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ নষ্ট হয়ে যায়। শতাধিক ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং গাছপালা ভেঙেছে বলে প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে। গাছ ভেঙে পড়ায় এ দিন ক্যানিং-বারুইপুর রোড ঘণ্টা খানেকের জন্য বন্ধ থাকে। মহকুমার দু’টি স্কুল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বজ্রপাতে আহত হন তিন জন। অন্য দিকে, উত্তর ২৪ পরগনার বারাসাতের কদম্বগাছির জিয়ারুল হক (৩৫), পাঁচুড়িয়া গ্রামের নির্মল ঘোষ (৩০) ও তাঁর বাবা জয়দেব ঘোষের (৫০) মৃত্যু হয় বজ্রপাতে। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান দেগঙ্গার নন্দীপাড়ার বাসিন্দা মাহফুজ মোদি (৫৫)।
শনিবার সকাল থেকে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় বৃষ্টি হলেও দুপুরের পর থেকে পরিস্থিতির উন্নতি হয়। সকালে ধস নামে কালীঝোরা লাগোয়া সিকিমগামী ৩১ (এ) জাতীয় সড়কে। যার জেরে ঘণ্টা খানেক যান চলাচল ব্যাহত হয়। তবে, প্রশাসনিক হিসেবে উত্তর দিনাজপুর এবং মালদহে দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রাথমিক ভাবে ৭০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছে। দুই জেলাতেই বহু কাঁচাবাড়ি ভেঙেছে। অনেক বাড়ির চাল উড়ে গিয়েছে। শতাধিক গবাদি পশু ও পাখি মারা গিয়েছে। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বিদ্যুৎ ও টেলিফোন ব্যবস্থা। নষ্ট হয়েছে ফসল, আমবাগান, শাকসব্জি। ত্রাণের দাবিতে এ দিন চোপড়া এবং মালদহে দফায় দফায় অবরোধ করেন ক্ষতিগ্রস্তেরা। প্রশাসনিক আশ্বাসে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও বহু এলাকায় ত্রাণ বিলি শুরুই হয়নি বলে অভিযোগ। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব বলেন, “দুর্যোগের পরে ত্রাণ পেতে দেরি হলে ক্ষোভ হওয়া স্বাভাবিক। সব জায়গা থেকে ত্রাণ পাঠাতে বলা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীকেও জানিয়েছি। দুর্যোগ মোকাবিলায় সব ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।”
উত্তর দিনাজপুরেরে জেলাশাসক পাশাং নরবু ভুটিয়া বলেন, “জেলায় শিলাবৃষ্টি ও ঝড়ে প্রায় ১ লক্ষ সাড়ে ৭ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বাড়ি ও ফসল মিলিয়ে প্রায় ৬৭ কোটি ১১ লক্ষ ৪৩ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে।” এ দিন সকালে চোপড়ায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় যান রাজ্যের গ্রন্থাগার মন্ত্রী আবদুল করিম চৌধুরী। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ত্রাণ বিলি করা হচ্ছে। পরিস্থিতির কথা উচ্চ পর্যায়ে জানানো হয়েছে। এ দিন মালদহের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেন উত্তর মালদহের সাংসদ তথা প্রদেশ যুব কংগ্রেসের সভানেত্রী মৌসম বেনজির নূরও। তিনি বলেন, “দুর্গতদের জন্য প্রশাসনকে দ্রুত ত্রাণের ব্যবস্থা করতে বলেছি।” মালদহের জেলাশাসক শ্রীমতী অর্চনা জানিয়েছেন, ঝড় ও শিলাবৄষ্টিতে জেলার ৪০ হাজার মাটির বাড়ি ভেঙে গিয়েছে। এক লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ওই সব পরিবারকে পলিথিন ও শুকনো খাবার পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। কৃষিতে জেলায় প্রচুর ক্ষতি হয়েছে। মালদহের খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও উদ্যান পালন দফতরের সহ অধিকর্তা প্রিয়রঞ্জন সানিগ্রাহী বলেন, “শিলাবৃষ্টিতে ইংরেজবাজার, মানিকচক, কালিয়াচক, রতুয়া, হরিশ্চন্দ্রপুরের প্রায় ৩২ হাজার মেট্রিক টন আম নষ্ট হয়ে গিয়েছে। যার আর্থিক মূল্য ৩ কোটি ২০ লক্ষ টাকা।” |