একেই বোধ হয় বলে, রামখটাখট ঘ্যাঁচাং ঘ্যাঁচ! কোনও কথা মাটিতে পড়তে পাচ্ছে না। গলা খাঁকারির শব্দটুকু পাওয়ামাত্র বাকি সবাই রে রে করে তেড়ে উঠছে। বেশ কিছু দিন ধরে এ তল্লাটে বাগ্যুদ্ধের যা আড়ম্বর, তাতে পিলে চমকে যেতে বাধ্য। আমরা-ওরা-তারার খাপে একটাই সংখ্যা শুধু ‘কমন’। ৩৪। এইটে পরিমাণ মতো জপতে আর জপাতে না পারলে এ বাজারে নিস্তার নেই!
কী রকম শুনবেন? ধরা যাক, বাজার থেকে মাছ কিনে আনলেন। বাড়ি এসে পচা বেরোল। এই বারে মাছওয়ালার সঙ্গে তকরার করতে যাওয়ার আগে আপনার ভাল রকম পরিসংখ্যান জোগাড় করে নিয়ে যাওয়া চাই। বিগত ৩৪ বছরে কত বার পচা মাছ পেয়েছেন, কোন বার কত শতাংশ পচা বেরিয়েছিল, কী কী মাছ ছিল ইত্যাদি ইত্যাদি। মাছওয়ালা যখন শুধোবেন, এর আগে ৩৪ বছরে আপনি কত বার পচা মাছ বেচার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, আপনি ঠিক ঠিক উত্তর দিতে না পারলেই হড়কে পড়বেন!
আবার ধরুন, আপনি ভাবলেন ঝঞ্ঝাট করে লাভ নেই! বেশি করে তেল-লঙ্কা মিশিয়ে পচা মাছটাই আপাতত রেঁধে ফেলা যাক! তারও কি জো আছে? পাশের মাছবিক্রেতা তত ক্ষণে আপনার জানলায় ঠকঠক করছেন। গেল বার ওই বিক্রেতা যখন পচা মাছ দিয়েছিলেন, আপনি মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন! তা হলে এখন চুপ কেন? সে বার আরও দামি মাছ ছিল কি না, মাছের পরিমাণ আরও বেশি ছিল কি না, সে সব বিচার বিশ্লেষণ করে লাভ নেই! আপনি এক বার যখন কোনও ক্রমে মোমবাতি জ্বালিয়ে ফেলেছেন, আপনার সারা জীবনের জন্য মোমবাতি মানত করা হয়ে গিয়েছে!
এই বিচিত্র সাড়ে চৌত্রিশভাজার আসরে আপনার কোনও কথা-বার্তা-নীরবতার কোনও স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই। আপনি আগে কী করছিলেন, এক্ষণে কী করতে চাইছেন, এমনকী কী করতে চাইছেন না, তা-ও নিক্তি মেপে দেখা হবে। আপনি হয় চক্রান্তকারী, নয় চক্রান্তের প্রতিরোধকারী। এর বাইরে কিছু নেই। কিছু দিন আগে অবধিও এক দল আপনাকে নিয়ে কটূক্তি করেছে! আপনার তথাকথিত ‘রাজনীতিসচেতনতা’ নিয়ে মশকরা করেছে! এমন ভাব দেখিয়েছে, যেন মোমবাতি জ্বালিয়ে বা মিছিলে হেঁটে আপনি একটা মহাপাতকের কাজ করে ফেলেছেন! |
তখনও আপনি ‘আমরা’-র চোখে ‘ওরা’ হয়ে গিয়েছিলেন। এখন আবার সেই আপনিই যখন সংবাদপত্রের বাছাই বা শিক্ষাক্ষেত্রে অশান্তি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন, তখন অমনি নতুন ‘আমরা’-র চোখে আপনি হয়ে উঠছেন নতুন ‘ওরা’! আর প্রাক্তন ‘আমরা’দের চোখগুলো জ্বলজ্বল করে উঠছে! যেন এতে ওঁদের ভারী নৈতিক জয় হয়েছে! যেন এই তুই-মুইয়ের বাইরে আর কিছু নেই!
আবার অনেক সময় যেটা ‘নেই’ বলে মনে হয়, সেটাই হয়তো বেশি করে ‘আছে’। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের আগে কেউ কোত্থাও কোনও ব্যাপারে ট্যাঁ-ফোঁ করেননি, এ কথা অবশ্যই সত্যি নয়। তবে পিপুফিশুদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা চিরকেলে, এটা নিয়েও বোধহয় খুব দ্বিমত হবে না। সেই নিরিখে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্ব অবশ্যই একটা নতুন বাঁক। সেটা কতিপয় বিশিষ্ট জনের সশব্দ উপস্থিতির জন্য নয়। সেটা বাস্তবিকই যুগের ডাক হয়ে উঠতে পারার জন্য। আর গণসমর্থন ছাড়া কোনও আহ্বানই যুগের ডাক হয়ে ওঠে না। এ বার অমন সব ডাকাডাকির বাজারে ডাকাবুকো হয়ে ওঠার জন্য যে লাইন পড়ে যাবে, সেটাও কিছুমাত্র আশ্চর্যের নয়! কলকাতায় একটা সময় এক বারও ‘নন্দীগ্রামে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিংয়ে যাইনি’ বললে রীতিমতো এলেবেলে বলে মনে করা হত! বেশ কিছু মিটিং-মিছিলে ইচ্ছে করে পুলিশকে উত্ত্যক্ত করা হত। এক বারও ভ্যানে উঠতে না পারলে, লাঠির একটা খোঁচাও না খেলে মান থাকে না, মিডিয়াও থাকে না। কোনও বিপুলায়তন কর্মকাণ্ডেই অবশ্য এমন কিছু তুশ্চু ঘটনা এড়ানো সম্ভব হয় না, সে বিয়েবাড়িই হোক আর গণআন্দোলনই হোক! আর সেই সুবাদেই ‘নেই’-এর ঝাঁঝে ‘আছে’টাও মিথ্যে হয়ে যায় না।
এই ‘আছে’টাকেই সম্ভবত পড়তে এবং মানতে ভুল হয়ে যাচ্ছে ‘কমিটেড’ চক্রান্তকারী এবং তার ‘কমিটেড’ প্রতিরোধকারীদের। নিজের মতো করে প্রতিক্রিয়া জানানোর একটা অভ্যাস আমি-আপনি গত কয়েক বছরে রপ্ত করেছি। এখুনি চোপরাও বললেই থামতে পারব না! ‘কে তুমি নন্দিনী, আগে তো দেখিনি’ বলে ব্যঙ্গ করলেও থমকাব না। ভসভসিয়ে সোডার মতো প্রতিক্রিয়া বেরোতেই থাকবে। ৩৪ বছর ধরে কী কী অন্যায়-অবিচার হয়েছে, তার তালিকা নিশ্চয়ই বেরোক। কিন্তু সেই তালিকা যেন ‘তখন যখন বলেননি, এখন মুখে আঙুল দিন’ বলে তড়পে ওঠার কাজেই শুধু না লাগে। ইতিহাসের আর একটু বড় ভূমিকা বোধহয় থাকে। আর সেই ভূমিকাটাই বোধহয় রজনী কোঠারির ঋণস্বীকার করে চিনতে শেখায়, ৩৪ বছর ধরে এ রাজ্যে যে ‘সি পি এম সিস্টেম’ গড়ে উঠেছে, সেটা আসলে সি পি এমের চেয়েও বৃহৎ। গণতন্ত্রের কাঠামোর মধ্যে ৩৪ বছরের জন্য বিশল্যকরণী জুগিয়ে যাওয়া একটা বন্দোবস্তকে উপড়ে ফেলার, বাতিল করে দেওয়ার বুকের পাটা কে দেখাবে? মহাজনের পথ ছেড়ে দেওয়ার মতো বেকুবি কে করবে? কেনই বা করবে?
কিন্তু কথা বলার অভ্যাস রপ্ত করে ফেলেছে যে জনতা? সে তো বাঁধা পথে হাঁটার বান্দা নয়! আলো-বাতাসহীন মতাদর্শের জন্য বলিপ্রদত্ত হওয়ার দায়ও তার নেই। এই জনতার মধ্যে এমন বহু মুখ আছে, যারা লক্ষ্মণ শেঠ গ্রেফতার হলে খুশি হয় আবার পার্ক স্ট্রিটের ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়! এবং এই দুইয়ের মধ্যে কোনও সংঘাত আছে বলে সে মনে করে না! এই মুখগুলোকে এখন খুব কষ্ট করে খুঁজে বার করতে হচ্ছে না! এরা নিজেরাই নিজেদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। পথেঘাটে, বাসে অটোয়, ফেসবুকের দেওয়ালে! কমিটেড চক্রান্তকারী আর কমিটেড প্রতিরোধকারীদের খাতায় এদের নাম নেই। যত বারই নাম লেখা হয়, পিছলে যায়! পিছলে গিয়ে এরা ‘নেই’ হয়ে যায়, ‘নেই’ হয়ে গিয়ে ‘আছে’ হয়ে ওঠে!
‘কোমল গান্ধারে’ দেখা জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়ের মতো করে বলতে ইচ্ছে করে, আপনারা থাকুন! |