পারভেজ মুশারফের ভারত সফরের উপলক্ষ ছিল ক্রিকেট ম্যাচ দেখা। তার প্রায় সাত বছর পর, আগামিকাল আবার কোনও পাক প্রেসিডেন্টের বিমান নয়াদিল্লির টারম্যাক ছুঁতে চলেছে। এই প্রেসিডেন্টের সফরের উপলক্ষ, অজমেরে মৈনুদ্দিন চিস্তির দরগা দর্শন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মুশারফের সফর ছিল ক্রিকেট-কূটনীতি। আর এ বার আসিফ আলি জারদারির সফর হল ‘তীর্থ-কূটনীতি’ (পিলগ্রিমেজ ডিপ্লোম্যাসি)। অর্থাৎ, গত বারেরও মতো এ বারেও পাক নেতৃত্বের আসল উদ্দেশ্য, ‘ব্যক্তিগত সফর’-এর মোড়কে ঘরোয়া রাজনীতিতে কিছু বাড়তি সুবিধা আদায়। অন্য দিকে দিল্লির লক্ষ্য, বাড়তি উত্তেজনা না দেখিয়েও পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে প্রাসঙ্গিক সমস্ত দ্বিপাক্ষিক বিষয় ঝালিয়ে নেওয়া। সেই সঙ্গে সন্ত্রাস প্রশ্নে ভারতের উদ্বেগকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে আবার তুলে ধরা।
জারদারি দিল্লি থেকে অজমের যাওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে রয়েছে মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন। তার ঠিক আগে একান্ত বৈঠকে বসবেন মনমোহন সিংহ এবং জারদারি। দু’দেশের মধ্যে ভিসা-যোগাযোগ সহজ করা সংক্রান্ত চুক্তি নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরম এবং সফররত পাক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রেহমান মালিকের মধ্যেও আলোচনা হওয়ার কথা। আজ বিদেশমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণ জানিয়েছেন, “পূর্বনির্ধারিত কোনও আলোচ্যসূচি নেই। দ্বিপাক্ষিক সব বিষয় নিয়েই কথা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।”
ভোটের মুখে দাঁড়ানো জারদারির কাছে এই সফরের গুরুত্ব যথেষ্ট। সূত্রের খবর, পাক নেতৃত্ব বোঝাতে চাইবেন, ভারতীয় সেনা যেন সীমান্তে ইসলামাবাদকে কিছুটা নিঃশ্বাস ফেলতে দেয়। বিনিময়ে জম্মু-কাশ্মীরে যাতে ভারত-বিরোধী সন্ত্রাসের ঘটনা না ঘটে, সে দিকে নজর দেবে ইসলামাবাদ। এক দিকে বালুচিস্তানে কার্যত যুদ্ধ পরিস্থিতি, অন্য দিকে তালিবানের সঙ্গে দর কষাকষিতে জারদারি সরকার দেশের মধ্যেই গভীর চাপে। পাকিস্তানে পরপর জঙ্গি হামলা হচ্ছে। উপরন্তু পাক সেনার একটি বড় অংশের সঙ্গে রাজনীতিকদের দ্বন্দ্ব অবস্থা জটিল করেছে। |
এই পরিস্থিতিতে পাক প্রেসিডেন্টের বক্তব্য, ভারত সীমান্তে সেনা কমালে ইসলামাবাদও তাদের অগ্নিগর্ভ পশ্চিম-সীমান্তে বাড়তি মনোনিবেশ করতে পারবে। যদিও বিদেশ মন্ত্রকের খবর, ভারত এই প্রস্তাবে তেমন গুরুত্ব দিতে নারাজ। জম্মু-কাশ্মীরের পরিস্থিতি মোকাবিলার প্রশ্নে রশি আলগা করা অসম্ভব। উপরন্তু, প্রধানমন্ত্রী জারদারিকে সাফ বলবেন যে, মুম্বই সন্ত্রাসে অভিযুক্তদের দ্রুত শাস্তি এবং ভারত-বিরোধী জঙ্গি ঘাঁটিগুলি ধ্বংস করার ব্যাপারে হাতে-কলমে কোনও পদক্ষেপ না করা হলে, ভারতের পক্ষেও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে আস্থা বাড়ানো সম্ভব নয়। বস্তুত, ২৬/১১ নিয়ে এত দিন ধরে দিল্লি যে সব তথ্যপ্রমাণ-সংবলিত নথি ইসলামাবাদকে দিয়েছে, সেগুলির একটি ‘একত্রিত’ সংস্করণ আজই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক থেকে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে পাঠানো হয়েছে। বৈঠকে পেশ করা হতে পারে সেই নথিটি। মনমোহন এ-ও জানাবেন, পাক প্রেসিডেন্টের আমন্ত্রণ রক্ষা করে তিনি তখনই সে দেশে যাবেন, যখন এই বিষয়গুলি নিয়ে ইতিবাচক ভূমিকা নেবে ইসলামাবাদ। দিল্লির কাছে সামান্য অস্বস্তিদায়ক হতে পারে পাক প্রতিনিধিদলে সে দেশের স্বরাষ্ট্রসচিব জলিল আব্বাস জিলানির উপস্থিতি। কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মদত দেওয়ার অভিযোগে তৎকালীন ডেপুটি হাই কমিশনার এই জিলানিকেই ২০০৩-এ ‘অবাঞ্ছিত ব্যক্তি’ ঘোষণা করে দেশে ফেরত পাঠিয়েছিল দিল্লি।
এটুকু বাদ দিলে দু’তরফে একাধিক আস্থাবর্ধক আদান-প্রদানই হওয়ার কথা। বাণিজ্যিক সম্পর্কের অগ্রগতি নিয়ে যেমন কথা হবে, তেমন নতুন ভিসা প্রোটোকল তৈরির কাজও শেষ। দু’দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে গড়া বিশেষ গোষ্ঠী এই খসড়াটি চূড়ান্ত করেছেন। আগামিকাল এই নিয়েই কথা বলবেন চিদম্বরম-মালিক। এই সংক্রান্ত চুক্তিটি এখনই সই না-হলেও তা শীঘ্রই হবে বলে আগামিকাল জানানো হতে পারে। পাশাপাশি, ভারতের বাজারে পাকিস্তানের পণ্য যাতে আরও বেশি রফতানি করা যায়, সেই অনুরোধও করবেন পাক প্রেসিডেন্ট। ভারতের কাছে পেট্রোলিয়াম এবং পাক পঞ্জাবের একাংশের জন্য বিদ্যুতের সরবরাহ দীর্ঘদিন ধরেই চাইছিল পাকিস্তান। আগামিকাল ভারত এই বিষয়টিতে সবুজ সঙ্কেত দিতে পারে বলেই কূটনৈতিক সূত্রের খবর। |