|
|
|
|
|
|
রবিবাসরীয় গল্প |
সহবাসের ডায়েরি |
সংগীতা দাশগুপ্ত রায় |
দুপুরে অফিসে খাবার আনিয়ে খেতাম আগে। আজ কাল রাস্তায় বেরিয়ে কিছু একটা খেয়ে নিই। একটু সস্তায় হয়। আজও বেরিয়ে একটু দূরে গিয়ে খাব বলে পার্ক স্ট্রিটের মোড়টা ঘুরতে গিয়ে থমকে গেলাম। ওরা দু’জনে আসছে। ঝিমলির হাত ধরে আছে বাপন। চট্ করে ঘুরে দাঁড়িয়ে রাস্তায় বসে থাকা মুচিটার দিকে চটিটা এগিয়ে ধরলাম। ক’দিন ধরে সেফটি-পিন দিয়ে কোনও রকমে চালাচ্ছি। আজ এই সুযোগে দুটো পেরেক লাগিয়ে চলনসই করে নেওয়া যাবে চটিটা।
আমি জানি বাপন আমাকে খেয়াল করবে না। ও চিনতে পারে না আমার শাড়ির রং, হাতের পার্স, ব্লাউজের হুক। অনেক দিন নেয়নি ও আমাকে। ঝিমলিও তাকাবে না আমার দিকে কারণ ও এখন বাপনদার হাতের মধ্যে ডানা মেলে দিয়েছে। ওরা আমার মতো রাস্তায় দাঁড়িয়ে লাঞ্চ খায় না, তবে দু’জনে এই চিল চমকানো রোদ্দুরে রাস্তায় কী করছে কে জানে।
পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আমি বাপনের গলার স্বর শুনতে পেলাম, জল তেষ্টা পেয়েছে? ঠাণ্ডা কিছু খাবে? আমার জ্বর-জারি হলেও এ ভাবেই জিজ্ঞাসা করে, ওষুধ খেয়েছিস? জল খাবি? একই ভঙ্গি, একই কথার টান। কী করে পারে ও? দু’জনের সঙ্গেই কি অভিনয় করে বাপন? নাকি এক জনের সঙ্গে? কোন জন?
দু’টাকা।
নিতান্ত অবহেলায় চটিটা ঠেলে দিল মুচি। চটির দাম হাতে নিয়েই বুঝে গিয়েছে। দুটো কয়েন বাদ গেল আমার টিফিনের পয়সা থেকে। তা যাক, সম্মানটা তো বাঁচল। মুখোমুখি হয়ে গেলে বাপন অপ্রস্তুত হয়ে যেত।
এক ঠোঙা মুড়ি মাখার ওপর দুটো ছোলা-বাদাম এক্সট্রা ছড়িয়ে দিল মুড়িওয়ালা। আজকের দিনটা তা হলে মন্দ যাচ্ছে না। ঠিক সময় ওদের চোখে পড়ার হাত থেকে বেঁচে গেলাম। ক’টা ছোলাও ফাউ পেলাম। |
|
কলেজ থেকে ফিরে মা-র কাছে বসে অল্প তেলে নাড়া আলু ছোলা সেদ্ধ আর পেঁয়াজ দিয়ে মুড়ি মাখা ছিল আমাদের নিত্যি জল খাবার। তাতানের বেশি খিদে পেত বলে মা ওর বাটিতে আলু বেশি দিয়ে দিত। আমি অনেক সময় আমড়া কুচিয়েও মেখে নিতাম। কী অমৃত যে লাগত। তাতানের সঙ্গে এখন বছরে দু’দিন দেখা হয়। ভাইফোঁটায় আর মায়ের জন্মদিনে।
আমার মায়ের জন্মদিনে সকলের ছুটি থাকে। ১৫ অগস্ট মায়ের জন্মদিন। স্বাধীনতা দিবসে জন্মানো মা চিরটা কাল পরাধীন রয়ে গেল নিজের দারিদ্রের কাছে। বাপনের সঙ্গেও এমন করে কথা বলে যেন মা ওর কর্মচারী। আমি যদি রেগে গিয়েও বলি, ও ভাবে নিচু হয়ে থাকো কেন ওর কাছে, তো মা হাঁ হাঁ করে ওঠে। ও ভাবে ভাবিস কেন? ও রকম বড় মন, অমন উদারতা ক’জনের থাকে? বাপন যে আমার চাকরির টাকার হিসেব নেয় না কখনও, তার ওপর আমারই টাকায় আমার ভাইয়ের পড়ার খরচ চালানো নিয়েও কোনও দিন আপত্তি করেনি, এমনকী আজও যে আমার বাপের বাড়িকে সাহায্য করার আদিখ্যেতায় কখনও বাদ সাধছে না এ কি কম বড় মনের পরিচয়!
তবুও মায়ের ও রকম নুইয়ে থাকা দেখলে আমার রাগ হয়ে যায় কেন কে জানে!
|
২ |
বাড়ি ফেরার সময় মেট্রোর ভিড়ে পাশের লোকটা সমানে একটা কনুই মালিশ করে গেল আমার ডান দিকের বুকের ওপর। এখন এ সব নিয়ে ছুৎমার্গ করে কিছু বলা মানে জনতার অ্যাটেনশন কেনা। ভিড়ের মধ্যে থেকে মন্তব্য উড়ে আসবে, দিদি এত অসুবিধে যখন তখন একটা ন্যানো কিনে নিন না। ধুস্স্স্স্, পোষায় না। তার থেকে সরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি। এমনিতেও কী বা যাবে আসবে আমার। এ সব ছোঁয়ায় তো বৃন্তে কোনও বোধ পৌঁছোয় না। যারা মলেস্ট করে তারা জানে না, মেয়েদের শরীরের ঠিক কোনখানে ছুঁলে তারা হয় ভাল লাগায় শীৎকার করে উঠবে, কিংবা রাগে চিৎকার। বাপন জানে। আমাকে নিয়ে যখন পাগল ছিল ও তখন জেনেছি আমিও। এখন ঝিমলিও জানে নিশ্চয়ই। ওরা কি ট্যাক্সি করে ফেরে রোজ? ঝিমলি এক দিন বলেছিল, মেট্রোর সিঁড়ি ওঠা-নামা করতে ভাল লাগে না। তার চেয়ে শাটল্ ভাল। হ্যাঁ, শাটল তো ভালই। তুই তো শাটলেই আছিস এখন। নাকি আমিই শাটলে!
টুংকার দুটো খাতা কিনলাম আর একটা বেগুনি কালির পেন। খিদে খিদে পাচ্ছে আবার। পেয়ারাও চল্লিশ করে কিলো। তিনটে মাঝারি সাইজেই পনেরো টাকা। মায়ের মেডিক্লেম-এর প্রিমিয়ামটা জমা করতে হবে এই সপ্তাহেই।
তাতানও মা’কে এ বার একটা শাড়ি কিনে দিয়েছে পয়লা বৈশাখে। মা খুব খুশি। ছেলে হাতে করে এনেছে শাড়ি, তাও আবার একা। বোধ হয় রঞ্জুকে না বলে কিনেছে ভেবে নিয়েছে মা। আমি জানি, শাড়িটা রঞ্জুই কিনেছে। রঞ্জুর পছন্দ খুব সুন্দর।
তাতানকে ও-ই পছন্দ করে প্রোপোজ করেছিল। আমার কাছে পড়তে আসত তখন। এক দিন লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলল, পাপিয়াদি, তোমার কি মনে হয় মেয়েরা কাউকে ভালবাসলে তাকে নিজে থেকে জানানোটা ভুল? আমি বললাম, পছন্দ যদি ঠিক হয়, তা হলে না জানানোর কী আছে?
এটা অবশ্য মা জানে না। মা রঞ্জুকে পছন্দ করে না। আমি করি। আমার ভাইকে যে ভালবাসে, তাকে আমি ভালবাসব না কেন? মা বলে রঞ্জুর জন্যই তাতান কলকাতার বাইরে পোস্টিং নিল। রঞ্জুর এলাহাবাদের চাকরি মা’কে ছেলের থেকে দূরে করে দিয়েছে। এই কথাগুলো যখন মা বলে, আমি তখন আমার পুরনো বইয়ের তাকের মধ্যে ঢুকে যাই। ওড়নাটা মুখে পেঁচিয়ে বইগুলোর ধুলো ঝাড়তে থাকি। এ সব বই আমি নিজের বাড়িতে নিয়ে যাইনি। এই বই, এই তাকগুলো, ওই লাল মেঝের ঘরের কোণ, কটকটে দুপুরে ছাদের চটলা ওঠা সিঁড়ির গরম তাতের সেঁক এগুলো আমার মিঠেবেলার স্মৃতি।
টুংকাকেও এ রকম একটা ঘর বানিয়ে দেব। এ রকম খোলা তাকের দেওয়াল অবশ্য দিতে পারব না। ও রকম টাটানো ছাদও না। টুংকার বাবার কেনা বাড়িতে পাঁচ ইঞ্চির গাঁথনি দেওয়াল ভেঙে তাক করা যায় না। তবে বুক শেলফ্ আছে। কিছু বছর পরে আমিও এ রকম বক বক করতে করতে চা নিয়ে এসে টুংকার পাশে বসব, আর টুংকা কানে ইয়ারফোন গুঁজে বুক শেলফে সেঁধিয়ে যাবে। সে দিন অনেক দূর এখনও।
|
৩ |
ফ্রিজে ক’টুকরো মাছ রয়েছে। মাছের ঝোল, ভাত রেঁধে নিলেই হবে। কুড়মুড়ে করে আলু ভেজে নেব খানিকটা। কাল সজনে ডাঁটা, মিষ্টি কুমড়ো আর খোসাওয়ালা আলু দিয়ে চচ্চড়ি বানিয়েছিলাম ওপরে অল্প সরষে বাটা দিয়ে। এটা বাপনদের বাড়ির রান্না। কাকিমাই শিখিয়েছিল আমাকে।
বিয়ের পর পর বাপন চাইত ছুটির দিনগুলোতে জমিয়ে রান্না করি আমি। অন্য দিনগুলো অফিস থেকে ফিরে কোনও রকমে ডাল, ভাত, আলুসেদ্ধ, পাঁপড় ভাজা। আমার আবার ওই একটা দিনই ছুটি বলে শুয়ে-বসে থাকতে ভাল লাগত। তা ছাড়া আমি তেমন ভাল রান্নাও জানতাম না। ওর পছন্দ বুঝে কাকিমার কাছ থেকে জেনে নিয়ে রাঁধতাম এটা ওটা। এখন কি আর বাপন আমার রান্না খেতে ভালবাসে? দশ বছর ধরে একটানা কোনও কিছুই কি ভালবাসা যায়?
|
৪ |
বাপন খেয়ে এসেছে আজ। অফিসে কীসের নাকি গেট টুগেদার। টুগেদার তো বটেই। তোমরা খেয়ে নাও। আমি সন্ধেবেলা একগাদা আলফাল খেয়েছি। পেট ঢাক হয়ে আছে, বলতে বলতে জলে ইনো মেশাচ্ছে। ফোন বাজছে ভেতরের ঘরে। টুংকা দৌড়ে গেল ফোন আনতে, ঝিম কে বাবা? ঝিম ফোন করছে তোমায়। বাপন তাড়াতাড়ি ফোনটা নিয়ে ব্যালকনিতে চলে গেল। ঝিমলি এ বাড়িতে বহু দিন হল আর আসে না। আগে পড়তে আসত বাপনের কাছে। আমি মায়ের ওখানে গেলে ম্যাগি আর কফি বানিয়ে খাওয়াত জানি। ফিরে এসে ডাস্টবিনে ম্যাগির প্যাকেট দেখে আন্দাজ করেছি। বাপন নিজের জন্য কখনও কিছু রান্না করার কথা ভাবতেই পারে না, খিদে পেলে বরং এক প্যাকেট বিস্কুট খেয়ে খিদে মেরে দেবে। সাবস্টিটিউট করতে পারে ও খুব ভাল। আমাকেও তো করেছে। কিন্তু ঝিমলির সঙ্গে কথা বলে আরাম পায় ও?
ঝিমলি এক বার আমাকে বলেছিল ব্যাঙ্কের চাকরিতে তো খুব ভাল মাইনে। তাহলে তুমি এখন আর চাকরি করো কেন পাপিয়াদি? সে দিন খুব বিরক্ত লেগেছিল। বরের ভাল মাইনে না হলেই যে মেয়েরা চাকরি করবে এ মানসিকতা এ যুগে ভাবাই যায় না। ভাবলাম বলি তোমার বর যদি পোস্ট ডক্টরেট করে তবে তুমি কি মুখ্যু হওয়া প্রেফার করবে? বলিনি। আমার বেশি কথা বলতে ভাল্লাগে না। বাপনকে পরে বলেছিলাম এই মেয়েটার মাথার মধ্যে কী আছে? ও বলেছিল ভাল না লাগলে পাত্তা না দিলেই তো হয়! কথাটা বলেই জোরে করে দিয়েছিল টিভিটা। অপছন্দের আলোচনা এড়াতে বাপনের হাত থেকে রিমোট সবচেয়ে বড় অস্ত্র। আমিও তেমন মাথায় নিইনি এ সব। এখন একা হাঁটতে হাঁটতে এ সব মনে পড়ে। খুব কি বুড়িয়ে গেছি আমি?
|
৫ |
সকালে জামাকাপড় সাবানে ভেজাতে গিয়ে ওর পকেটে একটা রিসিট পেলাম। কোথাকার কোন হোটেলের বিল। ঝিমলিকে নিয়ে গিয়েছিল হয়তো আগের উইক-এন্ডে। আমাকে বলল হালিশহরে ওর বাবার ওখানে যাচ্ছে। ও জানে আমি বাবাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করব না কিছুই। ঝিমলির সঙ্গে ওর সম্পর্কটা নিয়ে কোনও রকম আলোচনা করলেই ওটাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়ে যাবে। সে আমি কিছুতেই পারব না। তার চেয়ে যা করছে করুক। শুধু যদি এগুলো আমার চোখের সামনে এ রকম বার বার করে না আসে তো শান্তিতে থাকি আমি।
|
৬ |
পিএসসি পরীক্ষা দিয়ে ফেরার সময় ট্রেনে বসে বাপন আমার হাতটা ছুঁয়ে বলেছিল তোর চোখের নিচের এই গভীর কালির দাগ আমি ঠিক মুছে দেব এক দিন। আমি হেসে বলেছিলাম ওটা বংশগত রে। মায়েরও আছে। এ যাবার নয়। ও বলল ওটা ক্লান্তিগত। একটা ভাল কিছু জুটে গেলেই সংসার আর সব ক’টা দায়িত্ব তুই সমেত, আমার। আসলে প্রেমিকার মধ্যে একটা লড়াকু জেদ, ভাইকে দাঁড় করানোর আর মাকে ওই শরিকি নোংরামো থেকে বার করে এনে একটা ভাল জীবন দেওয়ার ইচ্ছেটাকে ঘিরে মুগ্ধতা ছিল তখন। বিয়ের পরে সেটা ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে গেল। মাঝে মাঝে বলত কলেজে তুই কেমন চাবুক ছিলিস পাপি এখন দিন দিন কেমন নিরামিষ হয়ে যাচ্ছিস!
খারাপ লাগত আমার কিন্তু ওর কাছে আমিষ হতে গেলে যা করতে হয় তা করে উঠতে পারতাম না আমিও। কলেজ ইউনিভার্সিটি চাকরির পরীক্ষার সময়ে পাশে থাকা বাপন আর দাম্পত্যের বাপনও আলাদা হয়ে যাচ্ছিল।
আগে আগে ভাবতাম এক দিন টুক করে কোনও একটা ল্যাম্পপোস্টের গা থেকে ওই নাম্বারটা টুকে নেব। কিন্তু ডক্টর লোধ কি মেয়েদের চিকিৎসা করেন? তা ছাড়া আমার তো সে রকম কোনও সমস্যাও ছিল না। শুধু যখন চরম সময়ে আমি বলতাম উঃ, তোকে খুব ভালবাসি বাপন্ন্ন আর তখন ও ককিয়ে উঠত...এই তো! এক বার বল তো কী করছি আমি তোকে!
আদর করছিস। খুব আদর করছিস।
মুখ তুলতো ও, আহ্! এত ভাল কথা বলছিস কেন! একটু র’ হতে পারিস না!
পারতাম না। জানি না তা তো নয়। স্ল্যাংগুলো সবই জানি কিন্তু বলা যায় এ ভাবে! তাও এমন প্রেমের মুহূর্তে! আমি পারি না বাপন। প্লিজ জোর করিস না! জোর করত ও। বার বার মাথা ঝাঁকিয়ে আমার বুকের ওপর ফণা তুলে জোর করত। বল কী করছি। বল কোথায় মুখ রাখছি! বুকের সুখ পাখি দু’টো কেঁপে উঠে ওর মুখের মধ্যে থেকে যেতে চাইত। আমি কিছু দূর অবধি বলার চেষ্টা করতাম কিন্তু কোথা থেকে যে দুনিয়ার সব বাধা তখন আমার জিভেই আটকাত এসে! ওর পরিশ্রমের ঘাম ছিটকে এসে পড়ত আমার কপালে, ঠোঁটে। বলত, তুই আর একটু খারাপ হ’ পাপি। লক্ষ্মীটি আর একটু বল নইলে ব্যাপারটা বড্ড গতানুগতিক হয়ে যাচ্ছে এ বার। থমকে যেতাম আমি। আর এই টানাপোড়েনে আমার টানটান আগ্রহী শরীর যে বিন্দুতে পৌঁছেছিল চূড়ান্ত আবেগে সেখান থেকে ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে নেমে আসত নিরাবেগ শিথিলতায়। শেষ অবধি আমি একেবারেই শীতল শিথিল হয়ে গেলাম। বাপনও আর আমার মধ্যে কোনও তৃপ্তি পাচ্ছিল না। ঝিমলি হয়ত ওর শরীর নেওয়ার সময় ওই কথাগুলো বলে রোজ। কিন্তু এ ভাবে স্ল্যাং শোনার উত্তেজনাও কি এক দিন গতানুগতিক হয়ে যাবে না ওর কাছে! না, শুধু মাত্র এটাই কারণ হতে পারে না। হয়ত আরও কোনও কারণ ছিল আগ্রহ হারানোর। আমি বোধহয় এখনও ওকে খুব ভালবাসি। নইলে কার কাছে জাস্টিফাই করি ওদের এই লুকোচুরি? কেন করি? ও যে আমাকে একদম ভালবাসে না, তা না। যৌথ আগ্রহের সন্তান, যৌথ উদ্যোগের ঘরবসত এ সবের মায়া আছে ওর। ঝিমলিকে ও তাই চৌকাঠের ওপারে রেখেছে। এ পারে আনেনি এখনও। আনবেও না বোধ হয়। শুধু বাইরের পৃথিবীটা ওর আর ঝিমলির দু’হাতের মধ্যে উপছে উঠছে আমার চোখের সামনে এই যা।
|
৭ |
মা এসেছে। টুংকাইয়ের সঙ্গে শোবে মা। কাল সকালে চোখের ছানি অপারেশন হবে। তার পরেও দিন কুড়ি এখানেই থাকবে। একা একা নিয়ম করে ওষুধ দিতে তো পারবে না। তাতান ফোন করল দু’বার। কাল ক’টায় অপারেশন জানার জন্য ব্যস্ত। টাকা পাঠাবে বলছে। আমি বারণ করলাম। মা তো আমাদের দুজনেরই। পই পই করে বলল হয়ে গেলেই জানিয়ে দিতে। বলেছি বাড়ি ফিরে একেবারে ফোন করে দেব।
অনেক দিন পরে আজ বাপনের পাশে শুচ্ছি আমি। খুব অল্প আলো জ্বলছে এ ঘরে। সাইড টেবিলে জলের বোতলটার মুখ খোলা। জল খেয়েছে বোধহয় এক্ষুনি। খাটে দু-চারটে ছড়ানো কাগজপত্র। আমাকে দেখেই কাগজগুলো গুছিয়ে এক দিকে সরিয়ে দিয়ে হাসল, শুয়ে পড়, কাল সকাল সকাল উঠতে হবে। মায়ের প্রেশার ঠিক আছে তো?
হ্যা। টেনশনে আছে একটু। রঞ্জু রঞ্জু করছে।
স্বাভাবিক। কাল ক’টায়? দরকার থাকলে চলে আসব যদি পারি।
এলে তো ভালই হয়। ভরসা থাকে, বলতে বলতে আমি ওকে ডিঙিয়ে বোতলের ছিপিটা লাগাতে যাচ্ছিলাম। বালিশের পাশে রাখা মোবাইলাটায় নিঃশব্দে আলো জ্বেলে উঠে মেসেজ এল...স্ক্রীনে ফুটে ওঠে ‘ঝিম’... আমি চটপট বোতলটা নিজের দিকে নিয়ে বালিশে মুখ চাপলাম। চৌকাঠটা এগিয়ে আসছে এই মুহূর্তে। বাইরেটা সরীসৃপের মতো বুকে হেঁটে ঘরে ঢুকে পড়ছে আমার। ভাগের বিছানার ছোট্ট এই পরিসরটুকুর সীমা ছুঁয়ে ফেলার আগেই চোখ বন্ধ করে সজোরে চৌকাঠটাকেই ঠেলে দিলাম আমি। আর একটু, আর একটু জায়গা চাই আমার। অন্তত ঘুমিয়ে গিয়েও যদি এক বার পাশ ফিরতে চাই... আরও এক চিলতে জমি আমাকে দখল করতেই হবে।
|
|
|
|
|
|