রবিবাসরীয় প্রবন্ধ
‘হাতে পাঁজি মঙ্গলবার’
তুন বর্ষের ভোরেই কৈলাসে আসর জমে ওঠে, শিবের গাজন আগের দিনেই শেষ, তাই পার্বতীর সঙ্গে সাংবৎসরিক কথোপকথন জমিয়ে শুরু করতে আর কোনও বাধা থাকে না, ‘পুলকিতা পার্বতী পুছেন পঞ্চানন/ জগদুৎপত্তি কথা কহ দয়াময়। সংসার সৃজন অগ্রে কার জন্ম হয়।’ তার পরেই অতীত থেকে চলে আসে বর্তমান ও ভবিষ্যতের কথা, দরজার বাইরে নন্দী ও ভৃঙ্গী কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে শোনে, বঙ্গদেশের গ্রহবিপ্রদের তো জানাতে হবে, ‘বর্ষে বর্ষে কেন হয় নূতন নূতন। কী নিমিত্ত হয় কহ রাজা পাত্রগণ।। নূতন পঞ্জিকা নাম হয় কী কারণ। কী হেতু করিবে নব পঞ্জিকা শ্রবণ।’ শিব তো মহাকাল, কত আগম আর পুরাণের কথা তিনি গড়গড় করে পার্বতীকে বলে গিয়েছেন, পার্বতীর কোনও প্রশ্নেই ঠকেননি, এই প্রশ্ন তো একেবারে নস্যি, প্রশ্ন শোনা ও উত্তর দেওয়াটা বাৎসরিক অভ্যাস, তাই ‘ভব কন ভবানীকে কহি বিবরণ। বৎসরের ফলাফল করহ শ্রবণ।’ নতুন বছরের ছাপা হাতেগরম নতুন বই, আপামর বাঙালি জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ, পঞ্জিকার শুরুয়াত-এর ফ্রেমটা একেবারে তৈরি হয়ে গেল।
উনিশ শতকে বাঙালির জীবনে অনেক কিছু হচ্ছে, ছাপায় পাঁজি বা পঞ্জিকাও বইয়ের আকার পাচ্ছে। পঞ্জিকা শব্দটি প্রাচীন, নানা অর্থে ব্যবহৃত তালিকা, সূত্রের টীকা থেকে পঞ্চ অবয়বের সমাহার বা পঞ্জিকা বা পঞ্চাঙ্গ বোঝাত। সেই নামেই হাল আমলের রাষ্ট্রীয় পঞ্চাঙ্গ শব্দটি সরকারি সিলমোহরেও সিদ্ধ। শাস্ত্র ও রাষ্ট্র অনুমোদিত পাঁচটি অবয়ব হল, বার, তিথি, নক্ষত্র, যোগ আর করণ নির্ণয়। শিব খোলসা করে বললেও কথাগুলি উনিশ শতকে মুদ্রাযন্ত্র আসার আগে লোকের কাছে সহজে পৌঁছত না; মুশকিল আসানের জন্য গ্রামভিত্তিক এলাকায় গণক বা গ্রহবিপ্ররা থাকতেন, পুথিতে সব বাৎসরিক ভবিষ্যৎ-কথা তাঁরা সাঁটে লিখে রাখতেন। কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম থেকে মিশনারিরা, মিশনারি থেকে যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি লিখে গিয়েছেন কী ভাবে নানা এলাকাতে এই গ্রহবিপ্ররা সংবৎসর ঘুরে বেড়াতেন, বছরের গোড়ায় গৃহস্থের বাড়িতে বার, তিথি ও করণ ক্রিয়ার খবর দিতেন, লোকে শুনে রাখত। পক্ষান্তে আবার গিয়ে কৃত্যগুলি বলে গৃহস্থের স্মৃতি ঝালাই করতেন, বিনিময়ে সিধে পেতেন। নানা এলাকার দিন-ক্ষণ-লগ্ন-তিথি হিসেবের মধ্যে নানা গরমিল দেখা দিত, বালি সমাজের গ্রহবিপ্রদের হিসেবের সঙ্গে কোটালিপাড়ার বামুনদের অঙ্ক মিলত না, নাহক ঝামেলা হত। অষ্টাদশ শতকে নবদ্বীপ সমাজের মুখপাত্ররূপে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র হিসেবনিকেশে একটি সমতা রক্ষা করার চেষ্টা করেছিলেন, তা না হলে তো হিন্দুর ধর্মকর্ম সব লোপ পায়। বাংলা পাঁজির আদি মানুষ এই কৃষ্ণচন্দ্র, উনিশ শতকের ছাপা পাঁজির যে কোনও আখ্যাপত্রে বা ভূমিকায় সঙ্কলক বা সম্পাদক তাঁকে ছুঁয়ে গেছেন; আজও এই গোপাল ভাঁড় আর বিদ্যাসুন্দর-প্রিয় রাজাটি গ্রহবিপ্রদের আসরে ভাল মতোই জাঁকিয়ে বসে থাকেন।
পুথি থেকে ছাপা, ১৮১৮ নাগাদ ছাপা পাঁজির ভাল মতো বোলবোলাও শুরু হয়। শিব-দুর্গার কথা লোকের হাতে এসে গিয়েছে, আর গ্রহবিপ্রদের মুখাপেক্ষী হতে হবে না, তিথি ও রাশির হাল-হকিকত ছাপার পাতায় সাদা বাংলা ভাষায় লেখা আছে। সবাই মেনে নিয়েছিলেন, ছাপা পঞ্জিকা আমজনতার কাছে ছাপাখানার বড় দান। লভ্য আদি মুদ্রিত পঞ্জিকার শেষে জোড়াসাঁকো নিবাসী পঞ্জিকাকার দুর্গাপ্রসাদ জানিয়েছিলেন, গৃহস্থের আর কোনও অসুবিধা নেই, একটা পাঁজি কিনলেই হল, ‘অক্লেসে ক্লেস নাই পঞ্জিকা সকলের ঠাঁই দেখিবেন যখন হবে মনে।’ অঙ্কের হিসাব আর সাঁটের কথা বাংলা হরফে সহজ গদ্যে লেখা হত, ১৮৩৫-এ দীনসিন্ধু প্রেসের পঞ্জিকা ‘শুভাশুভ দিনক্ষণ বিচার’কে ‘ভাষায় সংগৃহীত’ করে ছাপল। শ্রীরামপুরের চন্দ্রোদয় প্রেসের পাশাপাশি কলকাতার প্রেসেরা বছরের শেষে নানা পাঁজি ছাপত; ১৮৫৯-এ রেভারেন্ড লং সাহেব তাঁর প্রতিবেদনে জানাচ্ছেন যে, হকাররা এই পাঁজি নিয়ে গ্রামেগঞ্জে ফেরি করত, ক্রেতার গাদি পড়ে যেত, লক্ষাধিক কপি বিক্রি হত। এক আনায় আশি পৃষ্ঠার পাঁজি বিক্রি করলেও লাভ থাকত, চাহিদা এমনিই। আর নতুন পাঁজি তো সব সময়েই অধুনা সময়ের পুরাণ। সেই সময়টা নিত্য ও নৈমিত্তিকের গ্রন্থিতে আবদ্ধ, সেই পুরাণকে শ্রদ্ধাভরে শুনলেই অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ-কথা হাতের মুঠোয় আসত, পড়ার আসর জমে উঠত। ‘শুনিবেক শুদ্ধ চিত্তে শুদ্ধান্বিত মনে॥
নিত্য আর নৈমিত্তিক সময়ের গাঁট তো উনিশ শতকের বঙ্গভূমিতে বিশেষ রূপ পেয়েছিল, চান্দ্র তিথি আর সৌর রাশিতে জট বাঁধা পালপার্বণ অমাবস্যা পূর্ণিমার হাজারো লগ্নের দেশি হিসাবের পাশাপাশি কোর্ট, আদালত আর রেভিনিউ ডিপার্টমেন্টের সাহেবি সময় সারণি জায়গা নিত। সেগুলি ঔপনিবেশিক ভারতে চালু করা পাশ্চাত্য বর্ষপঞ্জি ও ক্লক-টাইম-এর ফসল। ভিন্নধর্মী দুই সময় সারণির ভারসাম্য রাখাই তো ছাপা পাঁজির কাজ ছিল। আদালতের ‘টেরম, সেশন ও সিটিং’-এর তালিকা সময় ইংরেজি ধারা অনুযায়ী দিতেই হত, a.m. ও p.m.-এর হিসাব সূর্যাস্ত ও চন্দ্রোদয়ের সমগুরুত্ব পেত। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র শাসনের দায়ের চাপ তো শিবও অস্বীকার করতে পারেন না, তাই পালপার্বণের নানা ফরমায়েসি তালিকার পাশেই জায়গা পেত ঐহিক নানা সরকারি কৃত্যের সারণি, ট্যাক্স রিটার্নের হিসাব, স্ট্যাম্পের দাম, পুলিশি কানুন ও জরিমানা, ১৮৬০ থেকে পোস্ট অফিসের কথা, রেলের টাইমটেবিল, ভাড়ার পঞ্জি। সময়ের গাঁটবন্দিটা জবরদস্ত ও একেবারে প্রাক্টিক্যাল। একাধারে আচারনিষ্ঠ হিন্দু বা মুসলমান ও রাজভক্ত প্রজার কাছে কাজের বই ও অবশ্যপাঠ্য ম্যানুয়াল বলতে তো একটাই ছিল, নববর্ষের গোড়ায় কিনতেই হবে, আদি ও অকৃত্রিম কোনও বাংলা পাঁজি। মহারাষ্ট্র থেকে দুর্দান্ত বাঙালি সিভিল সারভেন্ট সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর আলোকপ্রাপ্তা জ্ঞানদাদেবীকে পাঁজি পাঠাতে লেখেন। আবার কবি কালিদাস রায় জানিয়েছেন যে তাঁর বাল্যকালে গণ্ডগ্রামেও ছাপা বই বলতে ঘরে পাঁজিই পাওয়া যেত। পাঁজির সর্বত্রগামী হওয়ার সাক্ষ্যের তুরুপের তাস অবশ্যই রবীন্দ্রনাথের হাতে, সাধারণ বিত্তের বাঙালির গৃহসজ্জার সেই অনুপম বর্ণনার মধ্যে অপরিহার্য ভাবে যেন পাঁজি এসে হাজির হয়, ‘জরাগ্রস্ত তক্তপোশ কালিমাখা-শতরঞ্চ-পাতা;/আরামকেদারা ভাঙ্গা-হাতা; পাশের শোবার ঘরে হেলে-পড়া টিপয়ের ’পরে পুরানো আয়না দাগধরা/ ...দেয়ালে ঠেসান দেওয়া সারে সারে বহু বৎসরের পাঁজি;’।
পাঁজি জ্ঞানসর্বস্ব নয়। নিত্যকর্মের এই বইটি উনিশ ও বিশ শতকীয় বাঙালির ফলাও ব্যবসার পণ্য, উপভোগের সামগ্রী, এর খাঁজে খাঁজে বাঙালির সংস্কৃতির নানা রস ও রূপের প্রত্নস্বাক্ষর, দৈনন্দিন সংস্কার ও ভাবনার হাজারো নিদর্শন। লাখে লাখে বিক্রি হত, জোর প্রতিযোগিতাও ছিল, শ্রীরামপুরের চন্দ্রোদয় প্রেসকে ছাপিয়ে উনিশ শতকের আশির দশকে উঠে আসে বেণীমাধব দে-রা, পাল্লা দিতে শুরু করে বঙ্গবাসী প্রেস। শতকের একেবারে শেষে পাঁজির ব্যবসায়ে সবচেয়ে নাম করেন কিশোরীমোহন বাক্চি ‘দর্জিপাড়া কেমিক্যাল ওয়ার্কস’ থেকে কালির ব্যবসাতেই তাঁর প্রথম হাতযশ। বিশ শতকের কুড়ির দশকে বাবার নামে প্রকাশিত ‘পি এম বাক্চি’র পঞ্জিকা আড়াই লক্ষ ছাপা হত, বিশাল এক ডাইরেক্টরি ছিল পাঁজিটির সম্পদ। ইংরাজি ডাইরেক্টরির ধরনে বাঙালি দেশজ সমাজের নানা ব্যক্তি পেশা, শহরের কুলজি, রাস্তাঘাটের যে বিরাট পঞ্জির সম্ভার ১৮৯৯ সালে প্রথম ছাপা হয়, তাকে পাঁজির জগতে অভিনব বলা হয়েছিল। এ রকম ঢাউস পঞ্জিকা (পাঁচশো পৃষ্ঠার অধিক) ডাইরেক্টরির মূল্য ছিল এক টাকা চার আনা, লোকে বলে ‘থ্যাকার স্পিঙ্ক কোম্পানির প্রকাশিত ২৪ টাকা মূল্যের ডাইরেক্টরিতে যাহা আছে’ বাক্চির বাংলা পঞ্জিকা ‘ডাইরেক্টরিতেও তাই’ রয়েছে। অবশ্য প্রথমটায় সাহেব নাম বেশি, দ্বিতীয়টায় বাঙালি। পি এম বাক্চির ব্যবসা এখন আর অতটা জাঁকালো নয়, তবে ষাট-সত্তর হাজার পঞ্জিকা-ডাইরেক্টরি আজও ছাপা হয়, অসম ও পূর্বাঞ্চলে রমরমে বাজার। ইতিহাসের গন্ধ তার গায়ে আজও লেগে আছে, বর্তমান মালিক জয়ন্ত বাক্চি ১৯০৯-১১’র ডাইরেক্টরির শোধিত সংকলন বার করতে চলেছেন। তাতে অখণ্ড বঙ্গভূমির সদর মফস্সল জুড়ে বাঙালির বসতি, কাজকর্ম, পেশা ও প্রতিষ্ঠানের খতিয়ান পাওয়া যাবে। এ যেন এক বিশেষ ঐতিহাসিক সময়ের বাঙালি সমাজের আদমসুমারি।


এ ইতিহাসের অনেকটাই দৃশ্যযোগ্য। রাশিচক্র লগ্ন ছক থেকে নানা দেবদেবীর ছবি, ১৮৪০ থেকেই বাংলা পাঁজিতে ‘প্রতিমূর্তি’র সূচি থাকত। বাংলা বইয়ে কাঠখোদাই-এর আদি নিদর্শনগুলির অন্যতম আকর তো এই পাঁজিই, চন্দ্রোদয় প্রেস থেকে ছাপা পাঁজির পাতায় পাতায় কৃষ্ণচন্দ্র কর্মকারের খোদাইকৃত মূর্তি আছে, বিদেশি নানা মোটিফকে দেশীয় দেব-দেবীর প্রতিকৃতির চার পাশে বসিয়ে তুলির আঁচড় কেটে তিনি যে রীতি তৈরি করেন, তা হীরালাল কর্মকার, রামচন্দ্র কর্মকার বা নৃত্যলাল দত্তরা অনেক দিন অনুসরণ করেছিলেন। পাতা জোড়া ছবি পালপার্বণকে দাগিয়ে দিত ও বিশিষ্ট করার কলকব্জা হিসাবে ব্যবহৃত হত।
উনিশ শতকের ছবিকে সরিয়ে বিশ শতকের পাঁজির অলঙ্করণে রদবদল ঘটেছিল। জামাইষষ্ঠী, পৌষপার্বণ, ভাইফোঁটা আর মহরম-এর ছবি উঠে এসেছে, পাঁজি ভেদে ঘণ্টাকর্ণ ও রাখিবন্ধন চিত্রায়িত হয়েছে, সাবেকি গঙ্গাপুজোর ছবি উবে গিয়েছে। পালপার্বণের মাহাত্ম্যে জোয়ার-ভাটা আছে, উৎসবের রুচি ও রাজনীতি বদলায়, সেই মতোই কৃষ্ণচন্দ্র কর্মকার থেকে প্রিয়গোপাল দাসরা পাঁজিতে মনপসন্দ ছবি এঁকে চলেন। লক্ষ্মী থেকে গন্ধেশ্বরী, আর হাল আমলে গন্ধেশ্বরীকে ছাপিয়ে রঙিন সন্তোষী মা আর সাঁইবাবা, পুরাণের শিবপুজোর সঙ্গে নতুন দেবদেবীর মাহাত্ম্য ও ব্রতকথা, সবই সময়ের দ্যোতক, যে সময়টা সদ্য দ্রষ্টব্য ও ‘পারফরমেটিভ’। ছাপার টেকনিকও বদলেছে, পাতাজোড়া কাঠখোদাই আর ইলেকট্রোপ্লেটিং করা ছবি জায়গা ছেড়ে দিয়েছে ডিটিপি-র স্ট্যাম্প সাইজ ছবিতে, পাতার লতাপাতার সুন্দর বর্ডার এখন একেবারে বিধবার সিঁথির মতো সাদা ফ্যাকফেকে। পাঁজি দেখে পড়ার ঢং নিশ্চয় বদলেছে, উনিশ শতকীয় প্রত্যাশার কিছুই আর সে ভাবে অবশিষ্ট নেই।
কথা প্রসঙ্গে ব্যোমকেশ বক্সী এক বার অজিতকে বলেছিল, ‘আরে বিজ্ঞাপন দেখো না, তা হলে কাগজে দেখো কী?’ পাঁজির ক্ষেত্রে কথাটা একশোর জায়গায় দুশো ভাগ সত্য, অন্তত সত্য ছিল ১৮৯০ থেকে ১৯৯০-এর মধ্যে। ১৮৬০ সালে পাঁজি আড়াই লক্ষ বিক্রি হয়েছে, ১৮৯০ থেকেই ব্যবসায়ীরা গণমাধ্যমরূপে পাঁজির গুরুত্ব বুঝছেন। ১৮৪০ থেকে ১৮৮০-এর পাঁজিতে সে ভাবে বিজ্ঞাপন দেখা যায় না, হাতে গোনা যায়, আকারে ছোট। কিন্তু ১৮৯০ থেকে বিজ্ঞাপনী পণ্য প্রচার পাঁজির যেন বিশেষ অংশ, নানা পেটেন্ট ওষুধ ও রকমারি বইয়ের বিজ্ঞাপনের শেষ নেই, পরিচিতি পত্রের লেখা ও রেখায় সেইগুলি জমকালো। বিজ্ঞাপনের ভাষা ও বিষয়ও দশকে দশকে বদলায়, প্রামাণিকতার ধ্যানধারণা তো এক থাকে না। মফস্সলে পেটেন্ট ওষুধ যাবে, তাই সশরীরে শিব নিজে জ্বরের পিল বা মিক্সচার দান করেন। ধন্বন্তরী ডক্টর সেজে রাতে ওষুধ বিলি করেন। এঁদের নাম ঠিকানা সব দেওয়া থাকে, শুধুমাত্র সদরে চিঠি লেখার অপেক্ষা। দৈব ওষুধ ও তেল কবচের গ্রাহক আছে, সালসা তো যৌবনবর্ধক, বৃদ্ধেরাও হাতির মতো নওজোয়ান হন, একেবারে ছবি এঁকে প্রমাণ দেওয়া হয়েছে। বটকৃষ্ণ পালরা তো নিজেরাই ওষুধ তৈরি করতেন, তাঁদের পাঁজি মানেই তো রংবেরঙের ওষুধের গুণাগুণ নিয়ে ক্যাটালগ। সেই রকম কিশোরীমোহনের আদত ব্যবসা স্ট্যাম্প, কালি ও তেল, তেল ও গন্ধদ্রব্যের রকমারি বিজ্ঞাপনে নাগরী বিলাসিনী থেকে গৃহলক্ষ্মীরা সেজেগুজে হাজিরা দিতেন, এক একটি ছবি যেন আজকের মডেল। আর বই তো রকমারি। শীল, বাক্চি বা বঙ্গবাসী দেদার বই ছাপছেন; উপন্যাস, যাত্রা থেকে মাইকেল আর গোপাল ভাঁড়, নানা রংবেরঙের পাতায় বইয়ের বিশদ বিবরণ দিয়ে খবর যেত, যেন সিগনেট প্রেসের ‘টুকরো কথা’র আদি, অমার্জিত একটি খসড়া। মাঝে মাঝে বইয়ের কোনও এক দৃশ্য নিয়ে প্রিয়গোপাল-এর আঁকা ছবি ছাপা হত।
বিশ শতক থেকে বাঙালির জীবনে আসছে অনেক জিনিস, গ্রামোফোন, ফুটবল ও সাপলুডো, বিনোদনের নানা আধুনিক উপকরণ, আফিস ঘড়ি আর বায়োস্কোপের যন্ত্র। বাঙালি যেন আধুনিক হচ্ছে, ঘর সাজানো হচ্ছে; যে কোনও কল কিনলেই গ্রাম ও পাড়ার লোকে জমায়েত হয়ে আসর উপভোগ করবে, এমন পণ্যের বিজ্ঞাপন পাঁজিতে আখছার মিলত। বাংলা পাঁজির ভোক্তারা একলাসেঁড়ে নয়। তবে কথা উঠত ‘দুষ্ট বিজ্ঞাপন’ নিয়ে, পঞ্জাব বা জলন্ধর থেকে পাঠানো রঙিন যৌবনচঞ্চলার ছবি প্রসঙ্গে, অবশ্য বলা-ই হত যে সেগুলি ভি পি-তে পাওয়ার প্রাক্শর্ত হচ্ছে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার সার্টিফিকেট। বায়োস্কোপের বাজারে যদি ‘এ’ মার্কা ছবি আর সবার দেখার যোগ্য গার্হস্থ্য চলতে পারে, তবে পাঁজি কী দোষ করল?
তবে বিজ্ঞাপনও পাল্টায়, গণমাধ্যমটাই আর সে রকম নেই। গত শতকের ত্রিশ থেকে ষাটের দশকে দেখা গ্লোব নার্সারির বড় মুলো আর গাজরের বিজ্ঞাপন এখন অনুপস্থিত। গ্লোব নার্সারি ওই বিজ্ঞাপন দেয় না, গুপ্ত প্রেসের পঞ্জিকার বর্তমান বাঁটকুলে আকারে ওই বিজ্ঞাপন ধরবেও না। পি এম বাক্চির হাল আমলের পঞ্জিকায় প্রেসিডেন্সি লাইব্রেরি জগদীশ ঘোষের গীতা আর অন্যান্য বইয়ের তালিকা ছাপিয়ে সন্তুষ্ট, সহোদরা ‘ছাতিম’ প্রকাশনের উল্লেখ থাকে না। নব্বইয়ের দশকে ‘পূর্ণচন্দ্র শীল’-এ পাতাজোড়া ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়ের যাত্রাপালার বিজ্ঞাপন ‘নাচানো’ ভাষায় লেখা থাকত, এখন ওই পাঁজিতেই পাদটীকার মতো পাতার তলায় মাঝে মাঝে পালার নাম দেওয়া থাকে। বরং পাতা জুড়ে থাকে জ্যোতিষী দৈবজ্ঞ ও সাধুবাবাদের ছবি, উনিশ শতকীয় পাঁজিতে ছাপা বাবাদের চাইতে তাঁরা আধুনিক পোশাকে সজ্জিত, জটাজুটা নেই, রিমলেস চশমা পরা, শুধু অনেকের গলাতেই দেখি রুদ্রাক্ষের মালা। পূর্বসূরিদের তুলনায় একবিংশ শতকের পাঁজি নিঃসন্দেহে অনেক বেশি ম্যাড়মেড়ে, আর কেজো, পূর্ণিমা, অমাবস্যা আর একাদশীর দিনক্ষণ দেখতে ওল্টাতে হয়, পুজোপার্বণ ও বিয়ে-শাদিতেও সেগুলি অপরিহার্য। ব্যস, ওই পর্যন্তই, আর কিছু নয়। কেবল ওই সব অনুষ্ঠানেই পাঁজি আজও অপ্রতিহত ও প্রবাদসিদ্ধ, তখন সবার কাছেই যাকে বলে, ‘হাতে পাঁজি মঙ্গলবার।’

ছবি: সুমন চৌধুরী


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.