তোমরা যদি ইংরেজি নববর্ষের সঙ্গে বাংলা নববর্ষের তুলনা করো, তা হলে বলব আমাদের বাংলা নববর্ষ ঢের গুণে ভদ্রলোক। জানতে চাইছ, কেন? আমার সহজ উত্তর: রাত দুপুরে ঘণ্টা বাজিয়ে, জাহাজের ভোঁ শুনিয়ে, কেল্লার তোপ দেগে, পাড়ায় পাড়ায় পটকা ফাটিয়ে, ঘুমতাড়ানি হামলা করে বাংলা নববর্ষ আসেন না। ইনি খুব ভোরবেলা, গঙ্গাস্নান করে, মুখে মিষ্টি হাসি নিয়ে, কাউকে বিরক্ত না করে ধীরে ধীরে বাড়িতে ঢোকেন, প্রথম আলোর সঙ্গী হয়ে। তা হলে? ভদ্রলোক নয়?
আজ অবশ্য এই ভদ্রলোকটির কথা থাকুক। সে তো আমাদের অনেক বার শোনা। বরং, চলো, আমরা অন্য কয়েকটি অঞ্চলের নববর্ষের কথা বলি। সে সব অঞ্চলের অনেক মানুষ কলকাতা শহরে থাকেন, তাই এ শহর এক নয়, অনেক নববর্ষে মেতে ওঠে সময়ে সময়ে।
|
প্রথমে চলো দেশের একেবারে দক্ষিণ-পশ্চিমে। কেরলে। পুরনো পঞ্জিকা অনুসারে কেরলবাসীর নববর্ষ ১৪ এপ্রিল, কিন্তু নতুন পঞ্জিকা অনুসারে নববর্ষ শুরু হয়, তিথি অনুসারে, ১৪, ১৫ অথবা ১৬ অগস্ট। কেরলবাসীর নববর্ষ উৎসব একান্ত ভাবেই পারিবারিক। ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যেই বন্দি থাকে। আর সেই কারণেই, এই উৎসবে কলকাতায় মালয়ালি শিশুদের বাজি পোড়ানো ছাড়া অন্য কিছুর আঁচ পাওয়া যায় না। নববর্ষের দিনটিতে মালয়ালি পরিবারের বয়স্ক মহিলারা কাকভোরে উঠে পড়েন। এর পর মহিলারা একে একে পরিবারের অন্যদের ডেকে তাঁদের জাগিয়ে তোলেন। বলেন, ওঠো, ‘ভিসুকানি’ দেখবে এসো। এই মালয়ালম শব্দটির অর্থ হল, ‘প্রথম দেখা’। এটি এক ধরনের সমৃদ্ধির দেবতাও বটে। শশা, ফুল, সাদা কাপড়, সোনার অলঙ্কার, কাঁঠাল, নারকেল, প্রদীপ, আরশি ইত্যাদি দিয়ে ঠাকুরটিকে বানানো হয়। ভোরে উঠে কেউই প্রথমে চোখ খোলেন না। দেবতার সামনে এসে একে একে বসেন, তার পর চোখ খুলে ‘ভিসুকানি’কে প্রথম দেখেন।
কলকাতার তামিলভাষী মানুষও পঞ্জিকা এবং তিথি অনুসারে ১৩ বা ১৪ এপ্রিল নববর্ষ উৎসব পালন করেন। এই উৎসবের নাম হল ‘পুথান্দু’। অনেকে ‘ভারুসা পিরাপ্পু’ বলেও ডাকেন। এই উৎসবের নিয়মকানুনও অনেকটা কেরলের ‘ভিসুকানি’র মতোই।
|
চিনে লণ্ঠন |
আমরা যে দিন ভাইফোঁটা নিতে ব্যস্ত থাকি, ঠিক তার আগের দিনটিতে এ শহরের গুজরাতি সম্প্রদায় সেজে ওঠেন ‘সাভান্ত’ উৎসবে। ‘সাভান্ত’ শব্দটির মানে হল ক্যালেন্ডার। কলকাতায় এই দিনটিতে ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে গুজরাতিদের নতুন জামাকাপড় পরতে দেখা যায়। স্নানটান সেরে মন্দিরে পুজো দিতে যাওয়াই হল সেই দিনের প্রথম কাজ। আত্মীয়বন্ধু সবাই সবার বাড়ি যান। বাড়িঘরে চুনকাম, রং করা ইত্যাদির সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসায়ীরা পুরনো হিসেবের খাতাও বদলে ফেলেন।
এ বার অন্ধ্রপ্রদেশ। আমরা যেমন নববর্ষ বলি, ওঁরাও তেমনি ‘যুগাডি’। এই শব্দটির মানে হল যুগ, তবে এখানে ‘যুগাডি’ শব্দটিতে সংক্রান্তি ও নববর্ষ উভয়কেই বোঝানো হয়। চান্দ্রবর্ষ হিসেবে মার্চ মাসের ৩০ তারিখ অন্ধ্রপ্রদেশে নববর্ষ পালন করা হয়। খাওয়াদাওয়া এই উৎসবের এক বড় অঙ্গ। এর সঙ্গে এঁরা এ দিন রেজিলিউশন গ্রহণ করেন ‘কাউকে কোনও খারাপ কথা বলব না’, ‘কোনও খারাপ জিনিস দেখব না’, ‘খারাপ কথা শুনব না’।
এ বার কাশ্মীর। কাশ্মীরি মানুষ মার্চ মাসের ৩০ তারিখ নববর্ষ বা নভর পালন করেন। এ দিনটা মিষ্টি বিতরণ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আড্ডায় ল্পল্পে উপভোগ করেন ওঁরা। আমন্ত্রিতদের মধ্যে অন্য সম্প্রদায়ের লোকজনও থাকেন। ফলে এঁদের উৎসব মিলন মেলার চেহারা নেয়।
অসমিয়া জনসাধারণ ১ বৈশাখেই ‘রংগালি বিহু’ বা নববর্ষ উৎসব পালন করেন। এ দিন এঁরা পরস্পরকে সম্মানের জন্য নতুন গামছা দান করেন। রংগালি বিহু উৎসবে শুধুমাত্র নারী-পুরুষ-শিশুরা সমবেত হয়ে আনন্দই করে না, গাছপালা, পশুপাখির জগৎ সম্পর্কে নৈতিক সচেতনতার পাঠও নেয়। ওই একই দিন পঞ্জাবিদেরও ‘বৈশাখি’ বা নতুন বছরের শুরু। দশম গুরু গোবিন্দ সিংহ এ দিন ‘খালসা’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। গুরুদ্বারগুলি এ দিন লোকে লোকারণ্য। চলে কীর্তন, ভজন, থাকে খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থাও।
২১ মার্চ থেকে ২৩ মার্চের মধ্যে কোনও একটি দিন পার্সিরা নববর্ষ পালন করেন। এ দিন সপ্ত স-এ ‘নওরোজ’ বা নতুন দিনের ডালিটি সাজান তাঁরা। এতে থাকে সিব (আপেল), সির (রসুন), সাম্বাল (লালচে নীল ফুল) সারতি (মধু বা ময়দা বা খেজুর বা জল), সামুখ (মাছ) এবং সুমনল। সুখাদ্য তৈরি করে আত্মীয়বন্ধুদের খাওয়ানো, নওরোজ উৎসবের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ।
শেষ করি অন্য এক দেশের কথা দিয়ে। সে দেশের বহু মানুষ এখনও কলকাতায় এবং আশেপাশে থাকেন, নববর্ষ পালন করেন। চিনাদের কথা বলছি। ফেব্রুয়ারির ২০ থেকে ৩০-এর মধ্যে তিথি অনুযায়ী পড়ে তাঁদের নববর্ষ। এই এগারোটি দিনের মধ্যে যে বছর যেমন তিথি পড়ে ‘য়ুয়ান দান’, অর্থাৎ চিনা নববর্ষ। ‘য়ুয়ান’ শব্দটির অর্থ হল নতুন বছর। আর ‘দান’ মানে হল প্রথম ভোর। কলকাতার চিনা এলাকাগুলিতে কাগজের ফুল, লতাপাতা ও ড্রাগনে পথঘাট সেজে ওঠে। চেনা শহর হঠাৎ অচেনা। |