তবু বিহঙ্গ
স্বর্গের অচিন পাখি যদি মর্তে নেমে আসে, তখন জন্ম হয় ‘মিথ’-এর, পুরাণের। অ-লৌকিক, অতি-লৌকিক বিশ্বাস আর গল্পগাছা ছোটে দুদ্দাড় ফোয়ারার মতো, তথ্য আর তত্ত্বের মিশেলে সে পাখির জীবন-মৃত্যু, কালে হয়ে ওঠে এক একটা জাতি-গোষ্ঠী-দেশ-সংস্কৃতির অমোঘ প্রতীক।
আগুনপাখি ফিনিক্স সম্পর্কে, পাঁচ বছুরে গোল্টাচক্ষুং শিশু থেকে শুরু করে ছিয়াশি বছরের গল্পদাদু অব্দি সবাই, দু’টো জিনিস অবধারিত জানে। এক, তার ‘রাইজিং ফ্রম দ্য অ্যাশেজ’, দুই, তার রেজারেকশন বা পুনরুজ্জীবন (বা পুনর্জন্ম) সংযোগ। এ পাখি কী খায়, কোথায় থাকে, কেমন গান গায়, সে নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। ও সব তো ল্যাজনাড়া, চিরচেনা পাখি-সংবাদ। আর এ হল ফিনিক্স, হুঁহুঁ বাবা!
আরব, পারস্য, চিন, জাপান, কোরিয়া, গ্রিস, রোম, মিশর কোন দেশজ সংস্কৃতি না জড়িয়েছে এই পুরাণ-পাখির পালকে? যিশুর জন্মেরও অন্তত পাঁচশো বছর আগে গ্রিক লেখক হেরোডোটাস লিখেছেন মিশরে শোনা-গল্প, ফিনিক্স থাকে ‘অ্যারাবিয়া’-য় (কেউ বা আবার লিখেছেন ভারতবর্ষে), আর সময় হলে পাড়ি দেয় সুদূর মিশরের ‘হেলিয়োপলিস’ শহরে। সময় হলে মানে, অন্তিম কালে, না কি নতুন জীবনের প্রাক্-লগ্নে, কোনটা লিখব বুঝতে পারছি না। আসলে সত্যি তো দুটোই।
পুরাণে, লোক-ইতিহাসে ফিনিক্সের রংবাহারি রূপের বর্ণনা আছে। সোনালি আর লালে মেশানো গা, বড় ল্যাজখানা পার্পল, নীল আর সবুজের ত্রিধারা, মাথায় রাজকীয় ঝুঁটি, গলায় এক্সট্রা পালকের তৈরি একটা ‘ক্রেস্ট’। কোথাও বা লেখা, তার পা-দুটোও নাকি আগুনের তৈরি। পুরাণ মতে, ফিনিক্স বাঁচে ৫০০, ৫৪০, ১০০০, এমনকি ১৪৬০ বছর। দোসরহীন, একলা তার বেঁচে থাকা। বুড়ো পাখিটির মনে যখন আসে নবজন্মসংবাদ, এক আশ্চর্য কায়দায় সে তৈরি করে তার প্রথম ও শেষ ‘নীড়’খানি। রোমান লেখক ওভিড লিখছেন, একটা ‘পাম’ কি ‘ওক’ গাছে তার সাধের বাসাটি, আর আর পাখির মতো সে যে কাঠকুটো দিয়ে নয়, দারচিনি, স্পাইকনার্ড-সহ হাজারো সুগন্ধি মশলার কাঠ-পাতা দিয়ে সে-বাসা তৈরি। কোত্থেকে আরও জোগাড় করে আনে ফ্রাঙ্কিনসেন্স, ম্যের, আরও নানান সুগন্ধি-নির্যাস।
ছবি: সুমন চৌধুরী
তার পর সাধের বাসাটিতে আগুন জ্বলে। কী করে? পুরাণ বলছে, পাখিটি নাকি আকুল নয়নে চোখ মেলে থাকে আকাশে সূর্যের দিকে, আর তার পরেই এক মুহূর্তে জ্বলে ওঠে আগুন। কারও মতে, শক্ত ঠোঁটে চকমকি পাথর ঘষে সে নিজেই আগুন জ্বালায় নিজের ঘরে। তার পর, শান্ত, সমাহিত সে নিজেই বসে পড়ে আগুন-আসনে। ঘর পোড়ে, ফিনিক্সও। সুরভিত দহনে দগ্ধ হতে হতে পড়ে থাকে ভস্মমাত্র।
অতঃপর ঘটে সেই অবিশ্বাস্য ম্যাজিক। পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার পর দিন ভস্মস্তূপে দেখা যায় পোকার মতো কিলবিলে কিছু একটা, নড়ছে। দ্বিতীয় দিন, ও মা, এ তো আরেকটা ফিনিক্স-ছানা উঠে দাঁড়াবার, ছোট্ট পাখা মেলবার চেষ্টায় অধীর। তৃতীয় দিনেই ছানাটি হয়ে যায় বড়সড়, পূর্ণাঙ্গ ফিনিক্স, তার মিথ-সত্য রক্ষা করে। মৃত্যু আর নবজীবনের দুর্দান্ত খেলাটি সাঙ্গ করে সে আবার ফিরে যায়, কোথায় কে জানে। অনেক লোক-কথায় পাই, নতুন ফিনিক্সটি পিতৃ(?)শ্রাদ্ধও সম্পন্ন করে, কিন্তু হাড়গোড়ের ওপর একটা সুবাসিত ‘বল’ বানিয়ে মুখে করে নিয়ে উড়ে যায় হেলিয়োপলিস-এর সূর্যমন্দিরে, ফেলে দিয়ে আসে সেখানে।
ফিনিক্স মৃত্যুহীন, অমর। অসামান্য শক্তিধর সে, নিজের জীবন তো নিতে পারে অনেকেই, সে জীবন নিজেকেই ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা আছে আর কার? নিদারুণ দহনজ্বালা সয়ে, পুড়ে ছাই হয়ে আবার বেঁচে উঠে, মাথা তুলে দাঁড়িয়ে সে হয়ে উঠেছে হার-না-মানা ‘গাটস অ্যান্ড গামশন’-এর প্রতীক। অটোমান অত্যাচার থেকে বেরিয়ে আসা আধুনিক গ্রিক নেশন-এর প্রতীক। আমেরিকার গৃহযুদ্ধে ধ্বংস হয়ে যাওয়া জর্জিয়ার আটলান্টা শহর যখন ফের মাথা তুলে দাঁড়াল, সামনে রেখেছিল এই নাছোড় পাখিকেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী নতুন ইউরোপের পরিচায়ক হিসেবে বেলজিয়াম প্রকাশ করেছিল এক ‘শান্তি মুদ্রা’ (পিস কয়েন), তারও প্রতীক ফিনিক্স। যুগে-কালে, মিথে-বাইবেলে, চিত্রে-চলচ্চিত্রে ফিনিক্স এক অনন্ত আশার, অমরতার ইন্সপিরেশন। মৃত্যুর-ওপার জীবনের, অপার জীবনের বার্তা পাখসাটে নিয়ে বেঁচে থাকে আগুনপাখি, রেজারেকশন-বিহঙ্গ।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.