|
|
|
|
নারীর হৃদয়, তীব্রতায় অবিচল |
অর্জুন মিত্র |
গল্পটা অজানা নয়। কাশীর রাজার তিন কন্যা অম্বা, অম্বিকা, অম্বালিকার স্বয়ম্বর সভায় রাজন্যবর্গকে পরাজিত করে তিন কন্যাকে হস্তিনাপুরে নিয়ে এলেন ভীষ্ম। অম্বিকা এবং অম্বালিকা বিচিত্রবীর্যকে বিবাহ করলেন। কিন্তু অম্বা জানালেন, রাজা শাল্ব তাঁর প্রণয়ী, তাঁকে যেন শাল্বের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। ভীষ্ম তা-ই করলেন। কিন্তু ভীষ্ম কর্তৃক অপহৃতা অম্বাকে শাল্ব প্রত্যাখ্যান করলেন। অম্বা তাঁর এই দুর্ভাগ্যের জন্য ভীষ্মকেই প্রধান অপরাধী বলে সাব্যস্ত করলেন এবং তাঁকে সংহার করার নিমিত্ত তপস্যায় বসলেন। তার পর অনেক কাহিনি, কিন্তু সার কথাটা হল, অম্বার কঠোর তপস্যায় তুষ্ট হয়ে শিব তাঁকে বর দিলেন, ‘তুমি অন্য দেহে পুরুষত্ব পেয়ে ভীষ্মকে বধ করবে... তুমি দ্রুপদের কন্যা হয়ে জন্মগ্রহণ করবে এবং কিছুকাল পরে পুরুষ হবে।’ এই বলে মহাদেব অন্তর্ধান করলেন এবং অম্বা চিতার আগুনে আত্মবিসর্জন দিলেন। অতঃপর পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের কন্যা রূপে তাঁর পুনর্জন্ম, বিচিত্র ঘটনাপরম্পরায় এক সময় নারী থেকে পুরুষে রূপান্তর, তার পর সেই নারী/পুরুষ শিখণ্ডীকে সামনে রেখে কুরুক্ষেত্রের মহারণের দশম দিনে অর্জুনের ভীষ্ম-জয়। ভীষ্ম শিখণ্ডীর সঙ্গে যুদ্ধ করেননি, কারণ তিনি এমন কারও সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাননি যিনি পূর্বে এক জন নারী ছিলেন। আমরা অবশ্য মনে রাখি না, ভীষ্মের যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী না হলেও শিখণ্ডী প্রচুর লড়াই করেছিলেন। একটা উত্তরকাহিনিও স্মরণীয় যুদ্ধের অষ্টাদশ তথা অন্তিম দিনে শিখণ্ডী নিহত হয়েছিলেন, হন্তারক অশ্বত্থামা। |
|
ছবি: সুমন চৌধুরী |
আমাদের পুরাণে পুনর্জন্ম বৃত্তান্তের কোনও অভাব নেই। কিন্তু অম্বা থেকে শিখণ্ডী এই অভিযাত্রার তুলনীয় কিছু মহাভারতেও বিরল। এ কাহিনি অনন্য, কারণ অম্বা অনন্যা। তাঁর স্বভাবের, চিন্তার, কামনার, প্রতিক্রিয়ার তীব্রতায় অনন্যা। ভীষ্মের প্রতি তাঁর যে তীব্র ক্ষোভ, তার মূলে ছিল এক অতলান্ত অপমানবোধ, আত্মমর্যাদার অকল্পনীয় লাঞ্ছনা। নারীত্বেরও। বৃদ্ধ তপস্বীরা তপস্যারত অম্বাকে নিরস্ত করতে এলে অম্বা তাঁদের বলেছিলেন, ‘তাঁর (ভীষ্মের) জন্য আমি পতিলাভে বঞ্চিত হয়েছি, আমি যেন স্ত্রীও নই, পুরুষও নই। আমার স্ত্রীত্ব ব্যর্থ হয়েছে, সে জন্য পুরুষত্বলাভের জন্য দৃঢ় সংকল্প করেছি, আপনারা আমাকে বারণ করবেন না।’ তপস্বীরা এই উচ্চারণের কোনও উত্তর দিতে পারেননি।
যুক্তি বা তর্কের চেনা শৃঙ্খলায় এর কোনও উত্তর হয় না। এই তীব্রতার জন্ম হৃদয়ে। নারীর হৃদয়। জ্যঁ-ক্লদ কেরিয়ের/ পিটার ব্রুক-এর মহাভারতে নবম দিনের যুদ্ধ শেষে নিশাকালে অম্বা অম্বার রূপেই ভীষ্মের সামনে আবির্ভূত হন এবং জানান, তিনি আগুনে নিজেকে আহুতি দিয়ে নতুন জন্ম পেয়েছেন এবং কুরুক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছেন ‘এখন আমি পুরুষ।’ ভীষ্ম প্রশ্ন করেন, ‘তোমার নাম কী?’ অম্বার উত্তর: ‘আমার অবয়ব পুরুষের মতো, লিঙ্গপরিচয়ে আমি পুরুষ। (কিন্তু) একটা ব্যাপার অবিচল, সতত দ্বিধাহীন: আমার অন্তরের গভীরে সে হৃদয় নারীর হৃদয় কেবল তুমি আছ, ভীষ্ম, সর্বদা তুমি একা আছ। এখন আমার নাম শিখণ্ডী। শিখণ্ডী।’
এ এক অসামান্য দ্বন্দ্ব। এক নারী তাঁর অপমানের প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন নারীত্বকে বিসর্জন দিয়ে, পুরুষের রূপ ধারণ করে। অর্থাৎ এ প্রতিশোধ কেবল ভীষ্মের বিরুদ্ধে নয়, নারীত্বের নিজের বিরুদ্ধেও। অথচ সেই প্রতিশোধের সুতীব্র প্রেরণা সরবরাহ করল তাঁর হৃদয়ে অন্তর্লীন নারীত্ব, শিখণ্ডী অকুণ্ঠ স্বরে জানিয়ে গেলেন, ‘সে হৃদয় নারীর হৃদয়।’ এবং, লক্ষণীয়, তিনি আপন পৌরুষ দিয়ে ভীষ্মকে পরাস্ত করলেন না, আপন অন্তর্নিহিত নারীত্বের ‘শক্তি’তেই ভীষ্মের পতনের কারণ হলেন। জন্মান্তর হল, সেই জন্মান্তরের অভীষ্টও পূর্ণ হল, কিন্তু অম্বার অপমানিত নারীত্ব তার যথার্থ শুশ্রূষা পেল কি?
মহাভারতকারকে সামনে পেলে জেনে নেওয়া যেত। কিংবা, হয়তো এ প্রশ্নের উত্তর তাঁরও অজানা। মহাভারত মন্থনে উঠে আসা আরও অনেক অনেক প্রশ্নের মতোই। |
|
|
|
|
|