করুণাধারায় জন্মজন্মান্তরে
বোধগয়ার পিপুল গাছের নীচে বসে কপিলাবস্তুর রাজকুমার সিদ্ধার্থ জেনেছিলেন, এই জীবন ও জগৎ দুঃখময়। কিন্তু সেই দুঃখের কারণ আছে। এবং দুঃখনিবৃত্তির হরেক উপায়ও আছে। এ ভাবেই ‘বোধিজ্ঞান’ লাভ করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বুদ্ধ।
সবাই কি আর এ রকম বোধিলাভ করতে পারেন? প্রতিটি কল্পে বড়জোর এক জন বুদ্ধ থাকেন। ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি থেকে শেষ হওয়া অবধি যে সময়টা, তাকে কল্প বলে। ১২৮× ১০৬ অর্থাৎ বারো কোটি আশি লক্ষ বছরে এক কল্প। তার পর আবার নতুন করে ব্রহ্মাণ্ড তৈরি হয়, নতুন কল্প শুরু হয়। কপিলাবস্তুর রাজকুমার বুদ্ধ হয়েছেন এই কল্পে। এর আগে অজস্র বুদ্ধ ছিলেন, ভবিষ্যতেও অনেক বুদ্ধ আসবেন।
আর জন্মজন্মান্তর ধরে এই ‘দুর্লভ’ বোধিলাভের যিনি চেষ্টা চালাচ্ছেন, তিনিই বোধিসত্ত্ব। জাতকের গল্প সেই ক্রমান্বয়ী উত্তরণের গল্প। নিছক জন্মান্তর নয়, এক জন্ম থেকে অন্য জন্মের মধ্য দিয়ে নিজেকে উন্নত করে চলার গল্প, বোধিলাভের অভিমুখে এগিয়ে চলার গল্প।
ছবি: সুমন চৌধুরী
কিন্তু তবু, অন্য পাঁচটা পুনরুত্থান/পুনরুজ্জীবনের গল্পের চেয়ে জাতকের গল্প আলাদা। সেখানে বুদ্ধ শুধু ‘গত জন্মে আমি এই ছিলাম’ বলে ছেড়ে দেন না। আরও পাঁচ জনকে দেখিয়ে দেন, তুমি এই ভূমিকায় ছিলে। তুমি ওই ভূমিকায়। কারণ, বোধিসত্ত্ব সর্বজ্ঞ। মানুষদের পৃথিবীতে, দেবলোকে, নাগলোকে সর্বত্র কী ঘটছে তিনি সব জানেন। তাঁর অজানা কিছুই নেই।
কিন্তু শুধু জানা? বুদ্ধ মানে শুধুই জ্ঞানী? বোধিলাভ মানে কেবল জ্ঞানলাভ? এবং সেই জ্ঞানই মুক্তির পথ? মোক্ষের উপায়? একটা সময় অবধি তেমনটাই জানা ছিল। বৌদ্ধধর্মে সর্বাস্তিবাদ, মহাসঙ্ঘিকা ইত্যাদি বিভিন্ন গোষ্ঠী ছিল। তাঁদের মতে ‘প্রজ্ঞা’ই আসল। কণিষ্কের আমলে তৈরি মহাযান বৌদ্ধধর্ম বলল, কেবল জ্ঞান নয়, করুণার কথাও। বলল, নিজের মুক্তিই একমাত্র কাঙ্ক্ষিত নয়, দশের মুক্তি না হলে সত্যকারের বোধি লাভ হয় না। ‘বোধিসত্ত্ব’ এই আদর্শেরই অনুসারী। আর পাঁচটা জীবের প্রতি করুণায় তিনি নিজের নির্বাণলাভকেও হেলায় তুচ্ছ করেছেন। যত দিন অন্যরা দুঃখ থেকে মুক্তি পাবে না, তিনি জন্ম-জন্মান্তর ধরে বারংবার চেষ্টা চালিয়ে যাবেন।
বোধিসত্ত্বের জন্ম-পরম্পরার কাহিনি তাই করুণারও কাহিনি। জীবের প্রতি করুণা থেকেই বোধিসত্ত্বরা তাদের মুক্তির জন্য চেষ্টা করেন, ‘বুদ্ধত্ব’ প্রত্যাখ্যান করে বারংবার জন্ম নেন। যে সব সর্বাস্তিবাদী জন্ম-জন্মান্তরের চেষ্টায় বোধিলাভ করলেন? মহাযান মতে, তাঁরা স্বার্থপর। শুধু নিজের মুক্তি খোঁজেন, অন্যদের নয়। সেখানেই বোধিসত্ত্বরা এগিয়ে।
যেমন, গোতম বুদ্ধের শিষ্য অবলোকিতেশ্বর। রাজগৃহে থাকার সময় গোতম একদিন উত্তর আকাশে রামধনু দেখেন। ‘উত্তর দিকে আমার ধর্ম ছড়িয়ে পড়বে, কিন্তু সেখানে জন্ম-জন্মান্তর ধরে কে চেষ্টা চালাবে?’ এগিয়ে এলেন অবলোকিতেশ্বর। ব্যক্তিগত নির্বাণসুখ তাঁর দরকার নেই, বরং জন্মজন্মান্তর ধরে উত্তর দেশের মানুষকে মুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করবেন। কে না জানে, দলাই লামারা সেই ‘মহাকরুণাময় অবলোকিতেশ্বর’ স্বয়ং! প্রথম থেকে দ্বাদশ, ত্রয়োদশ, মায় আজকের চতুর্দশ দলাই লামাও অবলোকিতেশ্বর!
আর একজন আছেন। বোধিসত্ত্ব মঞ্জুশ্রী। তাঁর এক হাতে জ্ঞানের তরবারি, অন্য হাতে বই। তরবারি দিয়ে অজ্ঞানের অন্ধকার ছিঁড়ে ফেলতে তিনি বারংবার পৃথিবীতে জন্মান। তিব্বতি বৌদ্ধরা বলেন, প্রাচীন বাংলার রাজপুত্র চন্দ্রগর্ভ সেই বোধিসত্ত্ব মঞ্জুশ্রী। দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান অতীশ নামে তিব্বতে এসেছিলেন, অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে তৎকালীন বৌদ্ধধর্মকে উদ্ধার করেছিলেন।
মহাযানপন্থীরা যখন সর্বাস্তিবাদকে ‘স্বার্থপর’ বলছেন, সর্বাস্তিবাদীরাও পাল্টা বলেছিলেন, নির্বাণ প্রত্যাখ্যান করে সকলের মুক্তির জন্য বারংবার বোধিসত্ত্ব হওয়া বেশ সুন্দর কথা। সে তো আকাশে ফুল ফুটে থাকলেও সুন্দর লাগত। কিন্তু ফোটে কি?
ফোটে না হয়তো। কিন্তু সকলের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত বোধিসত্ত্বের মুক্তি নেই এমন একটি আকাশকুসুমে বিশ্বাস না রাখলে উত্তরণ সম্ভব হবে কী করে?



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.