সরকারি অফিসে জারি নির্দেশ
টাইপিস্টের পাট চুকিয়ে কেরানি-বৃত্তান্তে কালান্তর
বিভূতিদার সঙ্গে শংকর গিয়েছেন হাইকোর্টের উল্টো দিকে টেম্পল চেম্বারে, সাহেব ব্যারিস্টারের অফিসে। বাড়িময় বোলতার চাকের মতো ঘরে এক-একটি অ্যাটর্নির বাসা। ‘কত অজানারে’ গল্পে অল্পবয়সী শংকর সেই সময় টাইপিস্টের কাজ খুঁজছেন। সাহেবের অফিসে চাকরি হল। শংকরের কলম লিখেছিল “টেম্পল চেম্বারে ঠিক দশটায় যাই। সাড়ে দশটায় কোর্টে যাওয়ার আগে সায়েব টাইপের কাজকর্ম দিয়ে যান। লাঞ্চের সময় ফিরে এসে সেগুলি তিনি দেখবেন। দু’টোর সময় আবার কোর্টে যাবেন...।”
তিরিশ থেকে আশির দশকের শেষ পর্যন্ত মধ্যবিত্ত-নিম্ন মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে এমন ‘শংকর’দের আখছার দেখতে পাওয়া যেত। সেই সময়টাই ছিল মাধ্যমিক পাশ করতে না-করতে বাবা-জ্যাঠা কিম্বা পাড়াতুতো দাদার হাত ধরে টাইপ স্কুলে বাধ্যতামূলক হাতেখড়ির। সেটাই তখন ‘সাবধানী’ বাঙালির আপৎকালীন রক্ষাকবচ ‘আর কিছু না পারুক, অন্তত টাইপ করে তো খেতে পারবে!’ সরকারি অফিসে কেরানির চাকরিতে একচেটিয়া আধিপত্য করা বাঙালির আঙুলে তখন দাপিয়ে রাজত্ব রেমিংটন, ইম্পিরিয়াল, অলিভার, রয়্যাল টাইপরাইটারের।
সওদাগরি অফিসে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান টাইপিস্টের কদর বেশি হলেও সরকারি অফিসে টাইপিস্ট-ক্লার্ক পদে বাঙালিরই ছিল অবাধ বিচরণ।
হাওয়া অনেক দিনই বদলাচ্ছিল। পূর্ণ বিচ্ছেদটা শেষ পর্যন্ত এসেই গেল। গত ২১ ফেব্রুয়ারি রাজ্য অর্থ দফতর থেকে জারি হওয়া একটি নির্দেশনামায় সরকারি চাকুরে বাঙালির কর্মজীবন থেকে পাকাপাকি ভাবে মুছে গিয়েছে একটা পদ ‘টাইপিস্ট-ক্লার্ক।’ এ বার থেকে আর কোনও টাইপরাইটার থাকবে না সরকারি অফিসে। থাকবেন না বাঙালি নস্টালজিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ‘টাইপিস্ট।’ সরকারি নির্দেশে টাইপিস্ট, টাইপিস্ট কাম ক্লার্ক, ক্লার্ক-টাইপিস্ট বা টাইপিস্ট ক্লার্ক এই সব পদে আর লোক নেওয়া হবে না। পদগুলির নাম বদলে হয়েছে লোয়ার ডিভিশন অ্যাসিস্ট্যান্ট বা লোয়ার ডিভিশন ক্লার্ক।
সব শুনে কয়েক সেকেন্ড টাইপরাইটার থামিয়ে চুপ করে রইলেন বীরেন্দ্র ঘোষ। প্রায় পঁচিশ বছর আলিপুর কোর্টের সামনে ফুটপাথে টাইপের কাজ করছেন।
আগে আইনজীবীদের অফিস থেকে দিস্তা-দিস্তা কাগজ আসত টাইপ করানোর জন্য। এখন বেশির ভাগ উকিলদের নিজের অফিসে কম্পিউটারেই টাইপ করা যায়। বীরেন্দ্রবাবু অন্যমনস্ক ভাবে বলেন, “সরকারি অফিস থেকে টাইপিস্ট উঠে গেল। আমরা যারা আদালতে বা লালবাজারের সামনে টাইপ করি এ বার তাদেরও ব্যবসা বন্ধ করতে হবে।”
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই টাইপের খটাখট আওয়াজ কমছিল সরকারি অফিসে। নিঃশব্দ কম্পিউটার-বিপ্লবে ‘বুড়ো’ টাইপরাইটারগুলোর তত দিনে নাভিশ্বাস উঠেছে। কি-বোর্ড একই রকম থেকে গেল, শুধু পাড়ার টাইপ শেখানোর স্কুলগুলো রাতারাতি বদলে গেল কম্পিউটার স্কুলে। হাওড়ায় রেমিংটনের কারখানা উঠে গিয়েছে। সেই কারখানার সিটু ইউনিয়নের প্রাক্তন সংগঠক-সচিব শুভেন্দ্রমোহন মৈত্র জানাচ্ছেন, সত্তর-আশির দশকে দিনে ১০০-১১০টি মেশিন তৈরি হত। ১৯৯৩ সাল থেকেই কারখানায় ‘সাসপেনশন অফ ওয়কর্’ হয়েছিল। ১৯৯৬-এ কারখানাটা বিক্রি হয়ে যায়। গত বছর উৎপাদন বন্ধ করে ভারতের টাইপরাইটার তৈরির ‘শেষ’ কারখানাটি। গোদরেজ অ্যান্ড বয়েস-এর মুম্বই কারখানায় এখন রেফ্রিজারেটর বানানো হয়।
যেমন টাইপ শেখানো বন্ধ করতে হয়েছে কলকাতার বেশ কিছু ‘কমার্শিয়াল স্কুল’কে। শিয়ালদহ এলাকায় ১৯২০ সালে চালু হওয়া এমনই একটি সংস্থার প্রধান গোরা দত্ত জানালেন, বছর দশেক আগেই তাঁদের টাইপ বিভাগ বন্ধ করা হয়েছে। কারণ, “এক জন, দু’জন ছাত্রছাত্রী আসছিল। এই ভাবে তো চলে না। তাই টাইপ মেশিনগুলো বিক্রি করে দিলাম।”
গোরাবাবুর মতো অনেকেরই ধারণা, শুধু সরকারি অফিসে নয়, বেসরকারি জায়গাতেও আর কয়েক বছরের মধ্যেই ‘টাইপিস্ট’ ব্যাপারটা অতীত হয়ে যাবে। তাদের অস্তিত্ব থাকবে শুধু পুরনো বই আর সিনেমায়। যেমন অনেক সাদা-কালো বাংলা ছবিতেই অফিসের দৃশ্য মানেই টাইপরাইটারের সশব্দ উপস্থিতি। ‘লুকোচুরি’র মতো ছবিতে নায়ক-নায়িকা একই অফিসে টাইপরাইটারের কাজ করতে-করতেই প্রেমে পড়েন। আবার ‘পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট’-এর মতো ছবিতে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনীত চরিত্রটি জনৈকা ‘মেদিনী দেবী’কে টাইপ করার স্টাইলে পিয়ানো বাজানোর প্রশিক্ষণ দেন!
‘কত অজানারে’-র সেই তরুণ টাইপিস্ট, শংকর বা মণিশংকর মুখোপাধ্যায় এখন মধ্য ষাট। সিইএসসি-র জনসংযোগ শাখার শীর্ষে রয়েছেন দীর্ঘদিন। ‘টাইপিস্ট’-এর হারিয়ে যাওয়া নিয়ে খুব একটা আবেগে ভাসতে চান না তিনি। বরং পুরো বিষয়টাকেই ‘পেশাদারি’ দৃষ্টিতে দেখতে পছন্দ করেন। “ঠিক সিদ্ধান্ত। স্মৃতি আঁকড়ে থাকলে যেমন চলে না, তেমনই পুরনো প্রযুক্তি নিয়ে তো এগোনো সম্ভব নয়। এক কালে টাইপরাইটার ছিল যুগের চাহিদা। এখন কম্পিউটারই যুগোপযোগী। আমিই শেষ কবে টাইপরাইটারে হাত দিয়েছি মনে নেই।”
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ফিরে গিয়েছিলেন সেই ষোলো বছর বয়সে, যখন বাবা হাত ধরে ভর্তি করে দিয়েছিলেন হাতিবাগানে টাইপ শেখার স্কুলে। “যে হাতিবাগান বাজার পুড়ে গেল, সেখানেই ছিল স্কুলটা। কবিতা-টবিতা লিখছি তখন। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। বাড়ির লোক ভাবলেন, টাইপ জানা থাকলে অন্তত পথে বসব না। আমি অবশ্য প্রায়ই টাইপ স্কুলে যাচ্ছি বলে শেষে আর যেতাম না।”
তবু পুরনোর জন্য কোথাও একটা চিনচিনে ব্যথা তো থাকে। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের আফশোস শুধু ‘টাইপিস্ট’ হারিয়ে যাওয়া নিয়ে নয়। “টাইপের একটানা খটখটাখট শব্দটা খুব অন্য রকম। সরকারি অফিস থেকে শুধু একটা ‘পদ’ নয়, একটা শব্দ চিরদিনের মতো হারিয়ে গেল!”
টাইপরাইটারের জন্য এখন নীরবতাই পালনীয়!



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.