পরের পর দু’সন্ধ্যায় দু’টো তীব্র কালবৈশাখী! রাত পোহাতেই ঝমঝমিয়ে বজ্র-বিদ্যুতে বৃষ্টি! আর সবই ঘটল এক এলাকায়!
গত দশক ধরে যেখানে কালবৈশাখীর রীতিমতো আকাল চলছে, সেখানে এ বার চৈত্রশেষে দক্ষিণবঙ্গে কালবৈশাখীর এ হেন ‘প্রাচুর্যে’ আবহবিদেরা কিছুটা বিস্মিত। বুধবার ঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৯৬ কিলোমিটার। বৃহস্পতিবার ৭২ কিলোমিটার। পরের পর দু’টো সন্ধে লণ্ডভণ্ড করা সেই ঝড়ের সঙ্গে অবশ্য বৃষ্টি তেমন হয়নি। তবে ঘাটতিটা সুদে-আসলে উসুল হয়ে গেল শুক্রবার। এ দিন কাকভোরে পৌনে এক ঘণ্টায় ৬৩ মিলিমিটারের আকাশভাঙা বৃষ্টিতে ভেসে গেল কলকাতা (এপ্রিলে মহানগরে এক দিনে বৃষ্টির রেকর্ড ১০৯ মিলিমিটার, হয়েছিল ২০০৫-এর ১১ এপ্রিল)। কোথাও কোথাও শিলাবৃষ্টিও। চৈত্রের তৃতীয় সপ্তাহে সাতসকালে আকাশ কালো করে, বজ্র-বিদ্যুৎ সহযোগে এমন বৃষ্টি আবহবিদদের কাছে বস্তুতই ‘বিরল’ ঘটনা।
মার্চ থেকে মে এই তিন মাস কালবৈশাখীর সময়। কোন মাসে ক’টা হবে, আগে মোটামুটি সেটাও একটা ছন্দে বাঁধা থাকত। যেমন, মার্চে অন্তত দু’টো, এপ্রিলে গোটা চারেক, মে-তে পাঁচ-ছ’টা। সব মিলিয়ে ১২-১৩টা। কিন্তু গত বছর দশেক ইস্তক ছন্দটা যেন হারিয়ে গিয়েছে। যেমন, ২০০৯ ও ২০১০-এর মার্চে একটাও কালবৈশাখী হয়নি বাংলায়। এপ্রিলে নাম-কা-ওয়াস্তে যে দু’-তিনটে হয়েছে, সেগুলো নিতান্তই দুর্বল। গত বছরের মার্চে দক্ষিণবঙ্গ দুর্বল একটা কালবৈশাখী পেয়েছিল। এপ্রিলে পেয়েছিল একটা। মে-তে ১৩টা। |
|
১) নীচের বাতাস
গরম হয়ে দ্রুত উপরে উঠেছে |
২) ঝাড়খণ্ডের ঘূর্ণাবর্ত টেনেছে জলীয় বাষ্প |
৩) তা এসেছে গরম হাওয়ার সংস্পর্শে |
৪) তৈরি হয়েছে জলপূণর্র্ উল্লম্ব মেঘপুঞ্জ |
৫) উঁচু স্তরে ঠান্ডা হাওয়ার গতি ছিল খুব বেশি |
৬) উঁচু ও নিচু স্তরের বায়ু কাছাকাছি এসেছে |
৭) দুইয়ের সংঘাতে বেড়েছে উল্লম্ব মেঘের উচ্চতা |
৮) তা ভেঙেই বুধ ও বৃহস্পতিবারের ঝড় |
৯) শীতল বায়ুর টানে জলকণাও উপরে উঠেছে |
১০) সেই জলকণা পরিণত হয়েছে বরফকণায় |
১১) মেঘ ভেঙে তাই বৃষ্টির সঙ্গে শিলাবৃষ্টিও |
|
এ বার এপ্রিলের গোড়াতেই কলকাতায় পর পর দু’দিন দু’টি জোরদার কালবৈশাখীর পরে সকালের প্রবল বৃষ্টি কি আবহাওয়ায় পরিবর্তনের কোনও সঙ্কেত?
ঘটনাটা আবহবিদদের কাছে কিছুটা ‘অস্বাভাবিক’ ঠেকলেও একে সামগ্রিক ভাবে ‘হাওয়াবদলের’ ইঙ্গিত হিসেবে দেখতে তাঁরা নারাজ। ওঁদের মতে, পরিমণ্ডলে একের পর এক অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলেই এই ঝড়-জল। তাঁরা এ-ও জানাচ্ছেন, দক্ষিণবঙ্গ থেকে কালবৈশাখীর অনুকূল পরিস্থিতি ক্রমশ টেনে নিচ্ছে উত্তরবঙ্গ। ফলে তরাই-ডুয়ার্সে এ বার তীব্র কালবৈশাখীর যথেষ্ট সম্ভাবনা। বস্তুত ওঁদের পূর্বাভাস মিলতেও শুরু করেছে। এ দিন বিকেলেই উত্তর দিনাজপুরের চোপড়ায়
প্রবল শিলাবৃষ্টিতে এক জন মারা গিয়েছেন, জখম শতাধিক।
ইদানীং কালবৈশাখীর সঙ্গী ঝড়ের তীব্রতা হ্রাস নিয়ে আবহবিদেরা আক্ষেপ করে থাকেন। আলিপুর আবহাওয়া দফতরের অধিকর্তা গোকুলচন্দ্র দেবনাথের কথায়, “আকাশ ঘোর কালো হয়ে উঠবে। উঠবে প্রবল ঝড়। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাবে। প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়বে। শেষে নামবে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। এই হল কালবৈশাখীর চরিত্র।” এ দিন সকালে যে আকাশভাঙা বর্ষণ কলকাতা
দেখেছে, তার সঙ্গে কালবৈশাখীর বৃষ্টির হুবহু মিল। তার কয়েক ঘণ্টা আগে ঝড়ও বয়ে গিয়েছে তুমুল বেগে। বুধ ও বৃহস্পতিবার এত তেজে কালবৈশাখী ঝাঁপিয়ে পড়ল কেন?
আবহবিজ্ঞানীদের ব্যাখ্যা: বছরের এই সময়টায় পূর্ব ভারতে কালবৈশাখী হওয়ার পিছনে একটা বিজ্ঞান রয়েছে। এ সময়ে ছোটনাগপুর মালভূমির তপ্ত পাথুরে মাটি থেকে নির্গত তাপে নীচের বাতাস গরম হয়ে উপরে উঠতে থাকে। ফলে বায়ুমণ্ডলের নিচু স্তরে শূন্যতার সৃষ্টি হয়, যা ভরাট করতে বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসে জলীয় বাষ্প। সেই বাষ্পের পরিমাণ নির্ভর করে ছত্তীসগঢ়-ঝাড়খণ্ড কিংবা বঙ্গোপসাগরের উপরে কোনও ঘূর্ণাবর্ত রয়েছে কি না, তার উপরে। ঘূর্ণাবর্ত ঝাড়খণ্ডে থাকলে ঝড় হয় আরও শক্তিশালী।
বুধ-বৃহস্পতির সন্ধ্যায় ঠিক সেটাই হয়েছে। ঝড় বয়েছে যথাক্রমে ৯৬ ও ৭২ কিলোমিটার বেগে। গোকুলবাবুর মন্তব্য, “২০০০ সাল পর্যন্ত ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার বেগের কালবৈশাখী ঝড় দেখেছি (১৯৭৩-এ তার সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১২৪ কিলোমিটার, ’৭৮-এ ১৫৩ কিলোমিটার)। এখন তা নিতান্তই কমজোরি। ২০০৯-এ কালবৈশাখী ঝড়ের সর্বোচ্চ গতি ছিল ৮২ কিলোমিটার, ২০১০-এ ৭২ কিমি, গত বছর ৭৫ কিমি।” এ বছর মার্চের শেষ দিনে যে কালবৈশাখী হয়েছিল, তার গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৫২ কিলোমিটার। তখন ঝড় সর্বত্র হলেও বৃষ্টি তেমন হয়নি, পরবর্তী কালবৈশাখীর ইঙ্গিতও মেলেনি।
ফলে কালবৈশাখীর ‘খরা’ এ বারেও তাড়া করছে কি না, তা নিয়ে আবহমহলে জল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছিল। এ দিনের পরে অবশ্য ছবিটা বেশ বদলে গিয়েছে। কিন্তু পরিমণ্ডলে কী এমন অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হল, যাতে রাতারাতি বদলে গেল হাওয়া-চিত্র?
আবহবিদেরা জানাচ্ছেন, তিন-তিনটে পরিস্থিতির সুবাদে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে দু’-দু’টো কালবৈশাখী ও পরে প্রবল বৃষ্টি পেয়েছে কলকাতা। এক, তাপমাত্রা বাড়ায় নীচের বাতাস গরম হয়ে উপরে উঠেছে। দুই, ছত্তীসগঢ়-ঝাড়খণ্ডের উপরে অবস্থিত ঘূর্ণাবর্ত বঙ্গোপসাগর থেকে জলীয় বাষ্প টেনে এনেছে বেশি। তিন, ঊর্ধ্বগামী তপ্ত বাতাস ও উপরের স্তরের শীতল বায়ুপ্রবাহের সংঘাতে তৈরি হয়েছে উল্লম্ব মেঘ। এ দিকে উপরের ঠান্ডা বাতাসের গতিবেগ ছিল বেশি, অভিমুখও ছিল অনেক উপরের দিকে। তা জলীয় বাষ্পকে নিজের দিকে টেনে আনায় উল্লম্ব মেঘের উচ্চতা আরও বেড়েছে। তাতেই এত জোরদার হয়েছে কালবৈশাখী।
উপরন্তু বুধবারের উল্লম্ব মেঘ ভেঙে ৯২ কিলোমিটার বেগের ঝড় সৃষ্টির পর দিনই ঘূর্ণাবর্ত আরও শক্তি সঞ্চয় করে ঝাড়খণ্ডের দিকে সরে আসে। তা আরও বেশি জলীয় বাষ্প ঢুকিয়ে দেয় পরিমণ্ডলে, তাপমাত্রা বৃদ্ধির দরুণ গরম হাওয়াও তৈরি হয় চটজলদি।
এবং এ সবেরই নিট ফল ফের আর একটা কালবৈশাখী, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়। পাশাপাশি উপরের স্তরের ঠান্ডা বাতাস জলীয় বাষ্প অতিরিক্ত পরিমাণে টেনে আরও উপরে উঠে যাওয়ায় জলকণা জমে বরফ হয়ে গিয়েছিল। উল্লম্ব মেঘ ভেঙে নামা বৃষ্টির সঙ্গে সেই বরফের টুকরো শিলা হয়ে নেমেছে।
দক্ষিণবঙ্গে কালবৈশাখীর ধুমধাড়াক্কা কত দিন চলবে?
আবহবিদেরা জানাচ্ছেন, ঝাড়খণ্ডের উপরে থাকা ঘূর্ণাবর্তটি বাংলাদেশের দিকে সরে গিয়েছে। তাই এ বার উত্তরবঙ্গের পালা। চোপড়া দিয়ে যার সূচনা হয়ে গেল এ দিন। |