|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ২... |
|
একটা বিশ্বাস থেকে কবিতা লিখতেন |
গৌতম চক্রবর্তী |
কবিতাসমগ্র, মল্লিকা সেনগুপ্ত। আনন্দ, ৪৫০.০০ |
এই বইয়ের প্রচ্ছদটি চমকে দেওয়ার মতো। সুদীপ্ত দত্ত-কৃত প্রচ্ছদে শুধুই নীল রঙের বৈচিত্র্য। হাল্কা ‘মেরিডিয়ান ব্লু’র প্রেক্ষাপটে গাঢ় ‘আল্ট্রামেরিন ব্লু’, তার ওপরে সাদা রঙে বইয়ের নাম। মল্লিকা সেনগুপ্ত মাঝে মাঝেই নীল শাড়ি পরতেন না?
কবি কী রঙের শাড়ি পরতেন কবিতাসংগ্রহের আলোচনায় সেই প্রসঙ্গ হয়তো অবান্তর। কিন্তু এই সংগ্রহের অনেক কবিতাতেই নীলিমার দ্যোতনা। ‘অপরাজিতার বনে কেমন করে যে হিলিয়াম ছেয়ে গেছে পাপড়িতে পাপড়িতে আরো ঘন নীল’ (বুঁদ ক্লোরোফিল) থেকে ‘অলকানন্দার গাঢ় নীল জলে রক্ত মিশে হল বেগুনিঘোর’ (জলের মাছ) কিংবা ‘ইটচাপা ঘাসের মতো সাদা মগজ...আর নীল ঘৃণা’ (ক্রিস্তভ জানুসি)। নীল আকাশের রং, সমুদ্রের রং, বিশ্বাসের রং। মল্লিকা আসলে একটা বিশ্বাস থেকে কবিতা লিখতেন।
ঠিক কী ছিল সেই বিশ্বাস? ‘আকালের মধ্যে সারস’ নামে অনুবাদ-কবিতার বইটি বাদ দিলে মল্লিকার কাব্যগ্রন্থ ১৪টি। গ্রন্থিত-অগ্রন্থিত সব মিলিয়ে ৪৬৫টি কবিতা! সেখানে তিনি বিশ্বাস রাখছেন নারী-পুরুষের সমানাধিকারে, বিশ্বাস রাখছেন ধর্মনিরপেক্ষতায়, আস্থা রাখছেন সমকালে। সেই কারণেই ‘ইনস্যাট ১’ থেকে গুজরাত দাঙ্গা, মেধা পটেকর, খেজুরি, তেখালি ব্রিজ, প্রিয়ঙ্কা-রিজওয়ানুর ইত্যাদি শব্দ ঢুকে পড়ে তাঁর কবিতায়। বছর চারেক আগে রাজ্য যখন উত্তাল, কবি-শিল্পীদের মধ্যে ‘আমরা-ওরা’, মল্লিকাও তখন শিবির বেছে নিয়েছিলেন। কোন শিবির, ‘নিশ্চিন্দিপুর’ কবিতায় আজও তার প্রমাণ, ‘নিশ্চিন্দিপুরের পথে শিল্পায়ন হলে সর্বজয়ার সংসারটা হয়তো বেঁচে যাবে।’
বিশ্বাস-অবিশ্বাস বড় কথা নয়। যে কোনও ‘কবিতাসমগ্র’ দুই মলাটের মধ্যে কবির যাবতীয় লেখা এনে পাঠকের সামনে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। বিভিন্ন সময়ে লেখা এই সব কবিতায় আছে কি কোনও পরম্পরার সুতো? ঘটছে কি কবিচেতনার নিঃশব্দ বিবর্তন? সামনে থেকে, মাঝখান থেকে ইচ্ছামাফিক ছেঁড়া ছেঁড়া ভাবে কবিতা পড়েও কি ধরতে পারছ অলক্ষ্য অদৃশ্য ইশারা? এই চ্যালেঞ্জ নেওয়াতেই আনন্দ।
এই ‘সমগ্র’ও ব্যতিক্রম নয়। সে ধরিয়ে দিল, ধর্মনিরপেক্ষতা, রাজনীতি, নারী-পুরুষ সমান অধিকারের থেকেও মল্লিকার কবিচেতনার পরম্পরা অন্য জায়গায়। ইতিহাসের সঙ্গে বর্তমানের কথোপকথন! সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ভূমিকায় লিখেছেন, মল্লিকার প্রথম বই চল্লিশ চাঁদের আয়ু পড়েই তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। মোহের কারণটি বিশদ জানাননি, শুধু লিখেছেন, ‘কোনও কোনও কবির কয়েকটি রচনা পড়লেই বোঝা যায়, এরা হারিয়ে যাবার জন্য আসেনি।’
কী ছিল ১৯৮৩-র সেই চটি বইয়ে? ‘ঘর’ নামের কবিতাটি নেওয়া যাক। ‘বাঁশের মাচান বাঁধো সঙ্গমের আগে, ঘর হবে
পুত্র বেঁধে নেব পিঠে
নদী দৃষদ্বতী আজো বইছে সেখানে, পলি, নতুন উদ্ভিদ।’
আর যাযাবর হয়ে ঘুরতে চায় না এই নারী। পিঠে বাঁশের মাচান নিয়ে কোথায় যাবে সে? ঋগ্বেদের দৃষদ্বতী নদী। সেখানেই আছে পলি, নতুন উদ্ভিদ বা নতুন জীবন। অতীতের নদী আর বর্তমানের পলিমাটির অনুষঙ্গেই লাইনটি ধাক্কা মারে মনে, তৈরি হয় কবিতা।
এই পুরাণ আর মহাকাব্যিক চেতনাভূমিতেই কি তৈরি হয়েছে মল্লিকা সেনগুপ্তের কবিমন? একাধিক কবিতায় বারংবার এসেছে সীতা, দ্রৌপদী, মাধবীর কথা। সেই সব কারণেই হয়তো তাঁকে ‘নারীবাদী’ বলে দেগে দেওয়া হয়। কিন্তু এই দাগানো ছেঁদো ব্যাপার। এতে কবি এবং কবিতাকেই অসম্মান করা হয়।
‘মাধবী’র কথাই ধরা যাক। মহাভারতে মহর্ষি বিশ্বামিত্র তাঁর শিষ্য গালবের কাছে এক কান সাদা, এক কান কালো এক লক্ষ ঘোড়া দক্ষিণা চান। গালব রাজা যযাতির কাছে যান। দানবীর যযাতি তাঁর কন্যা মাধবীকে গালবের হাতে সম্প্রদান করেন। গালব এক-একটি রাজ্যে যান, সেই রাজারা সেই রকম দুষ্প্রাপ্য ২৫ হাজার ঘোড়া দান করেন। বিনিময়ে শুধু মাধবীকে এক বছর তাঁদের সঙ্গে থাকতে হবে, পুত্রের জন্ম দিতে হবে। হাল আমলে ভারতীয় কবি, নাট্যকারেরা বারংবার এই কাহিনিতে অন্তর্ঘাত ঘটিয়েছেন। ভীষ্ম সাহনির নাটকে মাধবী শেষে স্বেচ্ছায় জরাগ্রস্ত বৃদ্ধা হয়ে যায়। মল্লিকার কবিতায় প্রথম দিকে মাধবীর চোখের আগুনে ছ্যাঁকা খেতেন গালব। সেই চোখ ক্রমে পানাপুকুরের মতো ঘোলাটে, নিস্তরঙ্গ। কবিতার শেষে গালবের থেকে বিয়ের প্রস্তাব পেয়ে মাধবীর সেই ঘোলাটে চোখ ফেটে রক্ত নামে। ‘সেই রক্ত আজও থাকে নারীর সিঁথিতে।’ কোনও তত্ত্ব বা প্রতিবাদ নয়, আচমকা আজকের সীমন্তিনীদের সঙ্গে সে দিনের মাধবীকে একাকার করে দেওয়া। রাজারা হয়তো নেই। কিন্তু সংসার, চাকরি, সন্তান প্রতিপালন ইত্যাদির লেলিহান আগুনে আজকের মাধবীরাও কি আগুন হারিয়ে ক্রমে ক্রমে হয়ে যান না নিস্প্রভ? ‘সমগ্র’ পড়ে মনে হল, সমসাময়িকদের মধ্যে সম্ভবত মল্লিকাই ছিলেন সবচেয়ে বেশি মহাভারতপ্রাণিত।
প্রতিটি কবিতা হয়তো শিল্পিত সুষমায় উত্তীর্ণ নয়, সেটি সম্ভবও নয়।
‘এ ভাবে হাচ থেকে এয়ারটেল হয়ে
আবার রিলায়েন্স স্বামীর ঘর’
গোছের লাইনে চমকও নেই, কবিতাও নেই। এ ভাবেই বহু জায়গায় রান মিস, তবু খেলার দক্ষতায় হাততালি না দিয়ে উপায় নেই। ঠিকঠাক ছন্দ-ব্যবহার না জানলে
‘দিল তো পাগল হ্যায় বাঙালির মনে
গ্লোবাল লোকাল সব কিলবিল করে’
-এর মতো লাইন লেখা বেশ শক্ত।
অসুস্থ অবস্থায় লেখা ‘আমাকে সারিয়ে দাও, ভালবাসা’ বইয়ের ১৩ নম্বর কবিতাটা যেমন।
‘আমাকে বাঁচতে হবে, যত ভাবি, ততই উহারা
সহানুভূতির রসে চিটচিটে জিভ দিয়ে চাটে।’
মারণ রোগে দেখতে এসে যারা আহা-উহু করে, তাদের প্রতি বিরক্তি। তারা কোথায় থাকে? সহানুভূতির রসে। মনুষ্যেতর পিঁপড়েদের মতো। সে কারণেই তৎসম ‘উহারা’ শব্দের ব্যবহার।
নারীবাদী-টাদীর ঢের আগে মল্লিকা সেনগুপ্ত তাই কবি।
‘যে ভাবে আদিম নারীরা তোমাকে প্রণাম জানাত, আমি সেই ভাবে
প্রণাম জানাই পুরুষ তোমাকে,’
লিখছেন মল্লিকা। ‘আপনি বলুন, মার্কস’ কবিতাটি তো ভোলার মতো নয়,
‘শ্রেণিহীন রাষ্ট্রহীন আলোপৃথিবীর সেই দেশে
আপনি বলুন মার্কস, মেয়েরা কি বিপ্লবের সেবাদাসী হবে?’
ইতিহাসকে প্রশ্ন করতে করতেই মল্লিকা পৌঁছে গিয়েছিলেন নিজস্ব বীক্ষায়।
যাবতীয় ভালমন্দ, পূর্ণতা-অপূর্ণতা, সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে এই বই কবির সেই বিবর্তন এবং বীক্ষাকেই ধরিয়ে দিচ্ছে। মল্লিকা নেই, কিন্তু তাঁর কবিতা আজও জ্যান্ত, দমাদ্দম লাথি ছুড়ছে। অ্যালাইভ অ্যান্ড কিকিং! |
|
|
|
|
|