|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
পাশ্চাত্যের উদাহরণ অনিবার্য |
বিশ্বজিৎ রায় |
দ্য মেটাফিজিক্স অব টেক্সট, সুকান্ত চৌধুরী। কেম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, মূল্য অনুল্লেখিত |
যে কোনও দেশ-কালের সংস্কৃতিই তো যোগাযোগ নির্ভর। একের সঙ্গে অন্যের যোগ। এক জন কিছু প্রকাশ করতে চাইছেন ও সেই প্রকাশিত অর্থপূর্ণ সাংস্কৃতিক বস্তুমাধ্যমটি বিশেষ পদ্ধতির মধ্য দিয়ে অপরের কাছে হাজির হচ্ছে। যাঁর কাছে বা যাঁদের কাছে হাজির হচ্ছে তাঁরা সেই প্রকাশমাধ্যমের সঙ্গে বোঝাপড়া করে বিশেষ অর্থে উপনীত হচ্ছেন। এই যোগাযোগের মাধ্যম ও পদ্ধতি দেশকালসাপেক্ষ। এক দেশে এক কালে যে পদ্ধতি ছিল, অন্য দেশে অন্য কালে সেই পদ্ধতি না-ই থাকতে পারে, বদলে যায়, পুরনোর বদলে নতুন মাধ্যম আর পদ্ধতির বিস্তার ঘটে। যেমন, কোনও নাট্য বা কথন এখন রেকর্ড করা যায়, সেই ধরে রাখা রূপ আবার করে শোনা দেখা সম্ভব। কিন্তু যখন এই প্রযুক্তির প্রয়োগ ছিল না তখন নাট্য বা কথনের মতো ধ্বনিবাহিত শিল্পের কোনও একটি পারফরম্যান্স ফিরে দেখা বা শোনার উপায় ছিল না। আবার বই নির্মাণের ক্ষেত্রেও হাতে লেখা বা টাইপ করা পাণ্ডুলিপি, আর হালের বৈদ্যুতিন কপি একই রকম শর্ত নিয়ে প্রকাশকের দরবারে হাজির হয় না।
মোদ্দা কথা হল, কথকের সঙ্গে শ্রোতার, লেখকের সঙ্গে পাঠকের, শিল্পীর সঙ্গে দর্শকের যোগাযোগের দেশকাল ভেদে নানা রকমফের আছে। প্রক্রিয়াটি জটিল। আর এই যে দু’পক্ষের মাঝখানে রয়েছে যা সেই ধ্বনি, গ্রন্থ বা ছবি; সেগুলির শরীর তো কেবল এক জনের হাতে গড়ে উঠছে না, নানা জন নানা ভাবে হাত লাগাচ্ছেন। যেমন বইয়ের পিছনে আছেন লেখক, চিত্রী, প্রকাশক। তাঁরা নানা স্তরে তাঁদের ভূমিকা পালন করছেন। মোটের ওপর এ যেন ক্রমজায়মান এক প্রক্রিয়া। ফলে সাংস্কৃতিক বস্তুর অর্থ নির্মাণ স্থির সহজতায় সম্ভব নয়। অর্থ যেন পিছলে পিছলে যায়, কোনওটাই ফেলনা নয়। কায়া আর ছায়া মিলিয়ে বহুমাত্রিক জগৎ। অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরীর দ্য মেটাফিজিক্স অব টেক্সট বইটি সাংস্কৃতিক বস্তু নির্মাণ ও আস্বাদনের এই ক্রমজায়মান প্রক্রিয়াটিকে নানা দিক থেকে বিচার বিশ্লেষণ করেছে। টেক্সট শব্দটির অর্থ এখন বহুবিস্তৃত। এর ঠিকঠাক বাংলা প্রতিশব্দ দেওয়া মুশকিল। অধ্যাপক চৌধুরী ব্যাপ্ত অর্থেই টেক্সট শব্দটির প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। ভূমিকা বাদ দিলে জেনারেল মেটাফিজিক্স আর স্পেশ্যাল টেরিটরিজ, এই দুই ভাগে বইটি বিভক্ত। মোট প্রবন্ধের সংখ্যা দশ। প্রথম ভাগে ছটি আর দ্বিতীয় ভাগে চারটি লেখা।
পারিভাষিক দিক দিয়ে মেটাফিজিক্স মানে অধিবিদ্যা। অধিবিদ্যা হল অস্তিত্ব, সত্য বা জ্ঞানের প্রকৃতি বিষয়ক দর্শনের বিশেষ শাখা। এক জন অধিবিদ্যাবিদ যে ভাবে আমাদের অভিজ্ঞতালব্ধ আপাত-সত্যের পিছনে থাকা নানা উপাদানকে, যে উপাদানের ওপর নির্ভর করে ওই আপাত-সত্য গড়ে উঠেছে, বিশ্লেষণ করেন তেমনই এই বইটিতে অধ্যাপক চৌধুরী নির্মিত সাংস্কৃতিক বস্তুর পূর্বপট ও তা উপভোগের পশ্চাৎপট, যা আসলে পরবর্তী নির্মাণের পূর্বপট, তার বিশ্লেষণ করেছেন। এখানে একটা কথা খেয়াল রাখা ভাল। অধিবিদ্যাবিদ কিন্তু প্রকাশ্য সত্যের পিছনে যে জগতের কল্পনা করেন সেই জগৎ বস্তুগ্রাহ্য নয়। এখানে অবশ্য কেন্দ্রীয় টেক্সটের পাশাপাশি যে সব টেক্সটের উদাহরণ আছে তা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য। তাত্ত্বিক কাঠামোটিকে প্রয়োজনমাফিক নানা উদাহরণ দিয়ে পাঠকের কাছে তুলে ধরেছেন তিনি। অধিকাংশ উদাহরণই পাশ্চাত্য সংস্কৃতির। শ্রীচৌধুরীর নিজের বিদ্যাবিষয় ইংরেজি বলে শুধু নয়, পাশ্চাত্যে সাংস্কৃতিক বস্তুর জগৎটি যে ভাবে নানা পর্যায় পরম্পরায় গড়ে উঠেছে ও সেই সব তথ্য যে ভাবে রক্ষিত হয়েছে, তত্ত্বায়িত হয়েছে, সে ভাবে তো এ দেশে আমরা সংরক্ষণপ্রয়াসী হয়ে উঠিনি, তত্ত্বায়ন ঘটাইনি, তাই বোধহয় সাংস্কৃতিক বস্তুর পূর্বপট বিচারে পাশ্চাত্যের উদাহরণ অনিবার্য। তবে রবীন্দ্রনাথ ও সুকুমার রায়ের রচনার কৃতী অনুবাদক শ্রীচৌধুরী তাঁর রচনায় সুকুমারের হ য ব র ল-র বেড়ালের রুমাল হয়ে ওঠার গপ্পোকে ব্যবহার করে (দ্য হ্যান্ডকারচিফ অ্যান্ড দ্য ক্যাট) দেখিয়েছেন হালের সংস্কৃতিতে টেক্সচ্যুয়ালিটি আর ভারচ্যুয়ালিটির সম্পর্ক দেবতা আর দানবের বিবদমানতার সম্পর্ক নয়, বরং ‘ছিল বেড়াল হল রুমাল’-এর মতোই তারা সম্পর্কিত বলে ভাবা যেতে পারে।
শ্রীচৌধুরী তাঁর বইতে রবীন্দ্রনাথের পাণ্ডুলিপির কাটাকুটি নিয়ে একটা পূর্ণ প্রবন্ধ লিখেছেন। প্রবন্ধটি বাঙালি পাঠকদের আগ্রহের কারণ হবে বলেই মনে হয়। রবীন্দ্রনাথ চিত্রবিচিত্র অবয়বে তাঁর পাণ্ডুলিপি ভরিয়ে তুলতেন। কবিতা যখন সামগ্রিক পাঠকের জন্য ছাপা হত তখন এই আঁকিবুঁকি কাটাকুটির ছবি পাঠক দেখতে পেতেন না। ফলে কবি কবিতা লেখবার সময় ওই কাটাকুটির মধ্য দিয়ে কী অর্থ জ্ঞাপন করতে চান তা সব সময় পাঠকের গোচর হত না। সব সময় যে বিশেষ অর্থ জ্ঞাপনের জন্য রবীন্দ্রনাথ কাটাকুটি করছেন তা না-ও হতে পারে। আবার কোনও কোনও কবিতার ক্ষেত্রে ভাবা যেতে পারে ওই কাটাকুটি অর্থবহ। যেমন ‘আফ্রিকা’ কবিতার পাণ্ডুলিপিচিত্র এ প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ। উদ্ভ্রান্ত সেই আদিম যুগের স্রষ্টার কথাবাহী এই কবিতার পাণ্ডুলিপিচিত্রে আদিম অবয়বের ছবি ছিল। কবিতার ছাপারূপ যে অর্থে উপনীত করে তা যেন আম-পাঠকের, আর পাণ্ডুলিপিচিত্রে যা রইল তা যেন কবির ব্যক্তিগত। নিজেই নিজের কাব্যের অর্থ নিয়ে অন্য সাংস্কৃতিক বস্তু নির্মাণ করছেন। রবীন্দ্রনাথের পাণ্ডুলিপির নানা আঁকিবুঁকির অর্থ নিয়ে এ ভাবে মাথা ঘামিয়েছেন শ্রীচৌধুরী। প্রসঙ্গত এসেছে ব্লেকের কাব্যচিত্র আর অবনীন্দ্রনাথের কুটুমকাটুম।
শ্রীচৌধুরী তাঁর বইতে পাশ্চাত্যের নবজাগৃতি পর্বের আলোচনা করেছেন। দেখিয়েছেন ধ্বনি কেমন করে সেই পরম্পরায় এক দিকে বাচ্য অন্য দিকে বাচ্য-অতিরেকী অর্থসন্ধানী আচারের অনুষঙ্গী হয়ে উঠেছে। শেক্সপিয়রের নাটক কেমন করে টীকা ও সম্পাদনায় হয়ে উঠতে পারে নতুন অর্থের দ্যোতক, কেমন করেই বা মঞ্চের জন্য গড়ে নেওয়া হত বিশেষ রূপ, এসেছে সে আলোচনাও। মার্জিনের খুঁটিনাটি মন্তব্য কী ভাবে কাজে লাগে অর্থভেদে, কেমন করে ই-টেক্সট এর জগৎ ভিন্নমাত্রা দিয়েছে লেখক, সম্পাদক, প্রকাশক-এর সম্পর্ককে, তা নিয়ে ছড়িয়ে রয়েছে চিন্তাভাবনা। পড়তে পড়তে মনে হয় নয় নয় করে ইদানীং বাংলা বইয়ের জগৎও তো নানা ভাবে সচেতন হয়ে উঠছে। যেমন শঙ্খ ঘোষ সম্পাদিত রবীন্দ্রকবিতা-সংকলন সূর্যাবর্ত-য় ‘আফ্রিকা’ কবিতার পাশে ছাপা হয়েছিল পাণ্ডুলিপিচিত্র, পাঠককে অতিরিক্ত অর্থের ধরতাই দেওয়ার জন্যই তো এই আয়োজন। কিছু দিন আগেই ছাপা হয়েছে অবনীন্দ্রনাথের খুদ্দুর যাত্রা। দু’খণ্ডের সেই আয়োজনে কেবল কালো হরফে ছাপা বইখানি পাবেন না পাঠক, দেখতে পাবেন অবনীন্দ্রনাথের মেধাবী উন্মাদনা, আঁকিবুঁকি-কাটাকুটি, কাগজ চেটানো ছবি, সব নিয়ে কথা আঁকা আর ছবি লেখার প্রচেষ্টা। শম্ভু মিত্রের কণ্ঠে শেষবেলায় ধরা আছে জীবনানন্দের কবিতা। দিনান্তের সেই উচ্চারণের পাশাপাশি যদি চাঁদবণিকের পালা-র রেকর্ড শোনেন তা হলে দুই সাংস্কৃতিক পাঠ্যের মধ্যে যেন কথকের ভাবনার ঐক্য চোখে পড়ে। চাঁদবণিকের সংলাপ বয়নে কোথাও যেন জীবনানন্দীয় দোলা উঁকি দিয়ে যায়। শ্রীচৌধুরী সাংস্কৃতিক বস্তু বিশ্লেষণে যে জায়মানতার কথা ভেবেছেন সেই জায়মান পূর্বপট ও পশ্চাৎপটের সূত্রে বঙ্গসংস্কৃতির দিকে চোখ রাখার সময় এসেছে। |
|
|
|
|
|