মুখোমুখি ১...
যৌবন-আইকন
বশেষে সেই দিনটা এল। সেই বহু প্রতীক্ষিত ‘ডেট’। আমার আর মীর-এর। মীরকে প্রথমটায় একটু অচেনা লাগল।
সেই ছটফটে সদাচঞ্চল দৌড়তে থাকা মীর হঠাৎই এত শান্ত, ফর্মাল আর ভদ্র কেন? ঝটিকা-উত্তর: “তুমিও বলছ এ কথা? তুমিও চাও, আমি সব সময় ফাজলামি করি? এক আত্মীয়ের ফিউনারেল-এ গিয়েছিলাম দিন কয়েক আগে। সবাই শোকস্তব্ধ। হঠাৎ একজন জিজ্ঞেস করল, ‘মীরদা এত গম্ভীর কেন?’ বোঝো!”
এই পুরো কথাটা মীর আমাদের ‘খাস খবর’-এর এক সিনিয়র কলিগ-এর গলা আর বাচনভঙ্গি নকল করে বলে গেলযাঁর কথা বলার সময় মুখ দিয়ে এক অদ্ভুত শোঁ-শোঁ আওয়াজ বেরোত। আমার ততক্ষণে হাতের কফি কোলে ছিটকে পড়ে জামাকাপড় ভিজে, হাসি আর কাশি একসঙ্গে মিলেমিশে এক প্রাণান্তকর অবস্থা। কফিশপে আগত বাকি প্রেমিক যুগলরা ততক্ষণে ভাব-ভালবাসা, ঝগড়া, সেলফোনে নিজেদের ছবি তোলা ইত্যাদি সব ছেড়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। সবে তারা ভাবতে শুরু করেছেএই বুঝি ‘মীরাক্কেল’-এর কোনও এপিসোডের কিছু লাইভ গ্লিম্পসেস দেখা যাবে, বা ‘জবাব কিনতে চাই’-এর কিছু টিপ্স, আর আমিও মনে মনে আশায় বুক বাঁধছিএই তো ফিরে পাচ্ছি সেই চির-পরিচিত মীরকেব্যস, চিচিং বন্ধ! মীর আবার গম্ভীর।
ভদ্রতা না করে জিজ্ঞেস করে বসলামতোমার কি একটু ‘ইয়ে’মতো হয়েছে? মানে...সাফল্য, প্রশংসা, ফ্যান ফলোয়িং তাতে কি একটু ভারী হয়ে গেছ? উত্তর এল,“ভারী নয়, ভারাক্রান্ত বলতে পার। মাঝে মাঝে ভয় করে। পারব তো এত মানুষের এক্সপেক্টেশন পূরণ করে যেতে? মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্ন দেখি সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম, গলা দিয়ে আর আওয়াজ বেরোচ্ছে না। যদি সত্যিই এমন হয়?”
এর উত্তরে আমার সত্যিই কিছু বলার ছিল না। ’৯৮ সাল থেকে ২০১২এই ১৩ বছরের বন্ধুত্বে আজ অবধি কোনও দিন মীরকে একটা সিগারেটে টান দিতে দেখিনি। গলা খারাপ হয়ে যাবে বলে। মদ্যপানও করে না বলেই জানি। শেষ কবে কোনও পার্টিতে দেখেছি ওকে, মনে পড়ে না। শেষ কবে হলে গিয়ে সিনেমা দেখেছে, তা ওর নিজেরই মনে নেই। সোম থেকে শনি রেডিওতে সকাল সাতটার লাইভ শো কোনও দিন পাঁচ মিনিট দেরিতে শুরু হয়েছে বলে খবর পাইনি। এ-হেন ডেডিকেশন যে-শিল্পীর থাকে, হারাবার ভয় তো সে-ই পায়।
ছবি: কৌশিক সরকার
গত বছর মুম্বইতে এক মিডিয়া অ্যান্ড এন্টারটেনমেন্ট কনক্লেভ-এ ‘রেডিওর জনপ্রিয়তা’ শীর্ষক আলোচনায় দর্শকাসনে ছিলাম আমি। বক্তারা কেউ বাঙালি ছিলেন না, কর্মসূত্রে বাংলার সঙ্গে কারও যোগও ছিল না। দর্শকরাও সবাই মুম্বইবাসী এবং জাতীয় স্তরের প্রেস ও মিডিয়া-র লোকজন। সেই আলোচনায় বার-তিনেক মীরের নাম ফিরে ফিরে এসেছিল। সাধারণ মানুষ, রেডিওর শ্রোতা, টিভির দর্শক ওকে সামনে পেলে বলেন‘আপনাকে দেখলে ডিপ্রেশন কেটে যায়, মন ভাল হয়ে যায়, কান্নার গলাব্যথা হাসতে হাসতে পেটব্যথায় বদলে যায়!’ এর বেশি একজন শিল্পী কী চাইতে পারে?
কিন্তু সুনামের পাশাপাশি আমার এই প্রিয় বন্ধুটির ইদানীং একটু বদনামও হয়েছে। এক শ্রেণির মানুষ ‘মীর’ নামটা শুনলেই নাক সিঁটকোন। সেই একই রকম ব্যক্তিগত খোঁচা দেওয়া জোক্স, সব কিছুকেই কিছুটা অশ্লীলতার দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া। সেই জন্যই কি গুরুগম্ভীর, হাই-প্রোফাইল অনুষ্ঠানে মীরের ডাক পড়ে না? একটু অন্য ধরনের দর্শক কি তা হলে ‘ব্র্যান্ড মীর’কে বয়কট করল?
“খবর নিয়ে দেখো, ওঁরাই কিন্তু সপ্তাহে তিন দিন টিভির সামনে সব কাজ ছেড়ে বসে পড়েন আমার অনুষ্ঠান দেখবেন বলে।” বলেই হ্যা, হ্যা করে হাসতে শুরু করল সেই ‘অসম্ভব আত্মবিশ্বাসী’ মীরযাকে আমার বহু পরিচিত মানুষ ‘ছ্যাবলা মীর’ বলে ডাকে। একটা সময় এসেছিল যখন মীর মানেই মিমিক্রি, বাপ্পি লাহিড়ী থেকে ঋতুপর্ণ ঘোষ হয়ে মিঠুন চক্রবর্তী, কেউই বাদ পড়তেন না ওর রসিকতার কোপ থেকে। সে নিয়ে প্রচুর জলঘোলাও হয়েছিল, প্রচুর বিতর্ক। সব হঠাৎ থেমে গেল কী করে? “সে সব থাক সুদীপ্তা। এখন আর কারও সঙ্গে শত্রুতা নেই আমার। ওঁরা সবাই অ-নে-ক বড়। শত্রুতা বাড়িয়ে লাভ নেই। আমি তাই এখন একটু সংযমী হয়েছি। স্থান-কাল-পাত্র-সময় না বিবেচনা করে কথা বলার বদভ্যাস এবং বদনামদু’টোই ছেড়েছি।”
হুম্ম্ম্! এতক্ষণে আমার মগজে ঢুকল এই আপাত-গম্ভীর, হঠাৎ ভাবুক সঞ্চালক মীর-এর চরিত্র পাল্টানোর আসল কারণটা।
কিন্তু সত্যি কি তাই?
মীরের চিকেন টিক্কা স্যান্ডউইচের একাংশ ততক্ষণে শেষ। আমার ক্যাপুচিনোও প্রায় শেষ। কিন্তু এর পরের আধঘণ্টায় ওদের আর বিশেষ গতি হল না। মীর যে তখন স্বীকারোক্তি করছে! বলছে, ওর আর ওঠার মতো জায়গা নেই ওপরে। আর কিছু অ্যাচিভ করার নেই। হাতছানি দিয়ে সাফল্য আর ডাকছে না ওকে। কারণ, ওগুলো সব পাওয়া হয়ে গিয়েছে ওর। আর তাই নিজেকে এখন খুব বদ্ধ, স্থবির লাগছে। কখনও বা একটু ক্লান্তও।
আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে একটাই অপশন ভেসে এল“গো ন্যাশনাল। আঞ্চলিকতার বাউন্ডারি পেরিয়ে জাতীয় স্তরে জোরকদমে ঝাঁপিয়ে পড়ো। যেখানে ভাষাটা তোমার জন্য কোনও বাধাই নয় (মীরের উর্দু মিশ্রিত শুদ্ধ হিন্দি যাঁরা শুনেছেন, তাঁরা একমত হবেন) সেখানে আর ভেবো না।”
সাজেশনটা মোটেই পছন্দ হল না আমার বন্ধুর। বলল, “হিন্দি চ্যানেলের ‘লাফটার চ্যালেঞ্জ’-এ যখন শেষ আটে পৌঁছেছিলাম বছর কয়েক আগে, তখনই প্রচুর অফার এসেছিল। নিইনি। এখন তো আরওই যাওয়ার ইচ্ছে নেই।”
নিজে খেটে তৈরি করা জায়গাটা, ‘শিওর শট’ সাফল্যের গদিতে বসার আরামটা মীর স্যাক্রিফাইস করতে চায়নি বোধহয়। নিজের সঙ্গে মেলাতে পারলাম মীরের ফিলজফি-কে। আমাদের ‘ডেট’ প্রায় শেষের দিকে। আলোচনাও প্রায় গুটিয়ে এনেছি। ইচ্ছে হল, একটা ‘র্যাপিড ফায়ার’ গোছের করলে কেমন হয়? করলাম। দেখুন, মীর কী জবাব দিল:
১) সবচেয়ে ভালবাসো...
মী: আমার মেয়ে মুসকানকে।
২) সবচেয়ে ঘৃণা করো...
মী: কাউকে কাজ পাওয়ার জন্য আত্মসম্মান বিসর্জন দিতে দেখলে।
৩) স্বপ্ন দেখো...
মী: একটা স্টেডিয়ামে আমার পারফরম্যান্স। তার আগে বেসমেন্টের মেক-আপ রুমে রেডি হচ্ছি। এমন সময় শুনলাম, সারা স্টেডিয়াম ‘ও-ও-ও-ও’ করে চিৎকার করছে। আমার জন্য হচ্ছে চিৎকারটা। আর আমি মেক-আপ রুম থেকে সেটা শুনতে পাচ্ছি। এমন একটা দিন নিশ্চয়ই আসবে, দেখো।
৪) দুঃস্বপ্ন...
মী: আগেই বলেছি।
৫) তোমার সবচেয়ে প্রিয় পজেশন...
মী: (এক) সত্যজিৎ রায়ের অটোগ্রাফ-সহ ওঁরই ডিজাইন করা একটা গ্রিটিংস কার্ড। বাবুদা (সন্দীপ রায়) আমাকে গিফ্ট করেছিলেন। (দুই) বহু দিন আগে একটা স্টেজ শো-তে এসআরকে-কে মিট করেছিলাম। মেক-আপ রুমের অ্যাশট্রেতে দু’টো সিগারেটের শেষাংশ রেখে গিয়েছিলেন। ওগুলো সযত্নে আমার কাছে তুলে রেখে দিয়েছি।
৬) তোমার মতে জীবন মানে...
মী: জীবন মানে অ্য-সাম শালা...
৭) তোমার মতে ভালবাসা হল...
মী: প্রথমে পরকীয়া। তার পর নিজের মাথা চাপড়ে‘ইয়ে ক্যা কিয়া?’
৮) তোমার ইন্সপিরেশন...
মী: ভোর পাঁচটার অ্যালার্ম-টা। ও-ই আমাকে উদ্বুদ্ধ করে সারাটা দিন লড়ে যেতে।
৯) সবচেয়ে ভয় পাও...
মী: যদি সব হারিয়ে ফেলি! কোনও নোটিস ছাড়াই যদি একদিন সব হাতের বাইরে চলে যায়...
১০) স্বীকারোক্তি...
মী: আমি ভাল বর হতে পারিনি। ভাল বাবাও না। ভাল ফ্যামিলিম্যান-ও নয়। অনেক কম বয়সে বিয়ে করায় অনেক দায়িত্ব চলে এসেছিল কাঁধে। বাড়ি খোঁজা, সংসার পাতা, হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করে দুই পরিবারকে ফেস করা, চাকরি খোঁজা, তার পরেই বাচ্চাসেও আবার অনেকটাই প্রি-ম্যাচিওরডতার পর তার বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা, স্কুল আর সর্বোপরি, আমার কাজের চাপ।

আড্ডার শুরুতে ওকে যতটা ক্লান্ত লাগছিল, এখন আর ততটা লাগছে না। অনেক দিন পর এতগুলো কথা কাউকে বলতে পেরে মুখটা অনেক ভারহীন। বাড়ি ফিরলাম মনে একটাই প্রশ্ন নিয়েআমাদের নেক্সট ‘ডেট’-টা কবে হবে? অনেক কথা বাকি রয়ে গেল যে!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.