|
|
|
|
|
|
|
হাঁড়ির খবর |
চিনে স্বাদের হরগৌরী
ঋজু বসু |
|
এ যেন সেই কইমাছের ক্লাসিক হরগৌরী। ডিম-ভরা কইবাবাজীর এক পিঠে মৌরি-মেথি-কালোজিরের ছোঁয়ায় হাল্কা ঝাল-ঝাল ভাব। অন্য পিঠে দই-তেঁতুলজলের অভিঘাতে স্নিগ্ধ অম্লতা।
কী আশ্চর্য! শহরের এক আনকোরাতম চিনে রেস্তোরাঁয় বসে বাঙালি হেঁসেলের ধ্রুপদী রচনার শোক উথলে উঠল। এ যাত্রা অবশ্য কই নয়, সবার প্রিয় ক্যালকাটা ভেটকি দ্য গ্রেট। খানার টেবিলে এক আধারে ভেটকির জোড়া অবতার। মাছের দু’টি রূপ। ভাজা ও ভাপা। ভাজার সঙ্গতে লাল টকটকে সুইট গার্লিক সস। ভাপার সঙ্গী ঝাল-ঝাল ঘন সবুজ ধনেপাতার সস। এক পাতে এমন ঝাল-মিষ্টি বা লাল-সবুজের বিয়ের সুগন্ধে মজলে বুকের গভীরে বেশ একটা দার্শনিক ভাবেরও জন্ম হয়। হরগৌরীতে পুরুষ-প্রকৃতির মিশেল বা দ্বন্দ্ব। জীবন মানেও তো আদতে টক-ঝাল বা লাল-সবুজের ওঠা-নামা। তা চোখ-কান খোলা রাখা বাঙালিমাত্রেই হাড়ে হাড়ে জানেন। |
|
রাজারহাটের সিটি সেন্টার টু-র সদ্যোজাত চিনে রেস্তোরাঁও এই উটকো মেরুর ভারসাম্য-সাধনে মেতেছে। চিনে দর্শনে যাকে বলা হয় ইন-ইয়াং। মানে ললিত-কঠোর কি উষ্ণ-শীতলের বেরাদরি। রেস্তোরাঁর নামও ইন-ইয়াং। পাত পেড়ে বসে এ তল্লাটে ভাল-মন্দ সাঁটাতে সাঁটাতেই মনে হল, ঠিকই তো, এই চরম দু’টো মেরুর মধ্যেই মিশে রয়েছে গোটা একটা স্বাদ-ভুবন। আমাদের দেশের রসনাবোধে তিক্ত, কষা, উগ্র, কোমলের মতো অনেকগুলো খাপ আছে। আর চিনেরা বিশ্বাস করেন, যে কোনও রান্নাই হল ইন-ইয়াংয়ের খেলা। অর্থাৎ নানা কিসিমের উপাদান বা মালমশলার ব্যালান্সিং-ভেল্কি।
শহরের নতুন রেস্তোরাঁ ইন-ইয়াং-এর মধ্যেও মিলতে পারে হরেকরকমবার ‘ব্যালান্স’। যে-সব সেকেলেদের নির্মাণের সঙ্গে মিশে আছে টেরিটিবাজারে গত জন্মের নানকিং বা প্রাক্-মেট্রো রেল যুগের ঢের আগের সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের চাং ওয়া, এই নতুন রেস্তোরাঁর ক্যান্টনিজ নুড্ল্সে তাঁরা অবশ্যই শান্তি পাবেন। রসস্নিদ্ধ নুড্ল্স খানিক স্মার্ট-মুচমুচে, খানিক লাজুক-নেতানো। প্রতি চামচেই ক্যালকাটা চাইনিজের স্পর্শ মিশে। নিউ ওয়ার্ল্ড চাইনিজের দাপটে যা ইদানীং বিরল।
|
|
এই সেকেলে নুড্ল্সের সঙ্গী চিলি চিকেনই কিন্তু কট্টর এ কালের প্রতিনিধি। চাং-ওয়ার সেই পোট্যাটো চিপস-স্টাইল কুড়মুড়ের বদলে বোনলেস মুরগি, সয়াস্নাত ক্যাপসিকাম, কাঁচা লঙ্কার বদলে শেফের বিশেষ কসরতে মজানো পেটমোটা লাল কাশ্মীরি লঙ্কা। দক্ষিণ-পুব এশিয়ার আমদানি সেজুয়ান পেপার, কমলার খোসা, রসুন, কী সব তেল-টেল মিশিয়ে এই খোলতাই লঙ্কা মিশে আছে মুরগির সঙ্গে। এই বাস্কেট চিলি চিকেন আসছে মোমো বা ওয়ান্টন কি শিঙাড়ার চেয়েও ঢের পাতলা ফিনফিনে ময়দার খোলের মধ্যে এলিয়ে। বাঙালির পরমাত্মীয় চিলি চিকেনও এ তল্লাটে তার নিজের মতো, আলাদা।
ইন-ইয়াংয়ের জোড়া ফলার একটি শেফ সঞ্জয় লামা খাঁটি চিনে রান্নায় চৌকস। আর শেফ ভীম দক্ষিণ-পুব এশিয়ার নানা ঘরানাও চিনে রান্নার শৈলীতে মিশিয়েছেন।
কয়েকটি রান্না এখানে এসে মিস করা কখনওই ঠিক হবে না। মুচমুচে পোড়া রসুন ছড়ানো একটা ভারী স্নিগ্ধ সুপ হয়। এই বার্ন্ট গার্লিক সুপে ফি-চামচ মুরগির কুচি মুখে পড়বে। হাল্কা রসুনের ঝাঁঝ ভরপুর একটা পাইনঅ্যাপল রাইসও ওরা চাইলে করে দেন। আনারসের ঝাল-মিষ্টিতে টাকনার আরাম। |
|
একটু চড়া রেস্ত নিয়ে সদলে খেতে হলে এই ভাতের সঙ্গে লবস্টার খেতে পারেন। অনেকটা চিংড়িমাংস পাতে পড়বে। জিঞ্জার গার্লিক কি বাটার গার্লিকের মতো চেনা সসেই ব্যাপারটা দৌড়বে। লবস্টার থাকলে রান্নায় বেশি কারিকুরির কে পরোয়া করে! ঝাল-মিষ্টি হুয়া সসের হোল ভেটকিও খাইয়েদের বড় দলের জন্য বেশ উপযোগী। আর আনারস-ভাতটার সঙ্গে সরু চিকেন ফালির নম্র-স্বাদ বাম বাম চিকেনও বেশ লাগসই।
চিনে খেতে যাওয়ার কথা ভাবলেই যাঁরা জমিয়ে কাঁকড়া-চিংড়ি-পর্ক-ল্যাম্ব খ্যাঁটনের কথা ভাবেন, তাঁদের পেটে স্বাদ-ব্যালান্সিংয়ের দিকটাও কিন্তু ভেবেছে ইন-ইয়াং। চিনে বাঁধাকপি, পাকচয়, জুকিনি, ব্রকোলি, স্নোপিজ যোগে হাল্কা রসুনস্নাত সসে যে চাইনিজ গ্রিন পেশ করা হয় তা খেলে শরীরময় একটা তাজাভাব সঞ্চারিত হবেই। কচকচে সব্জির চিরন্তন চিনে মহিমা। যাদের ডায়েটের নেশা আছে, আমিষকে অ্যাটাক করার আগে এই স্বাদু স্বাস্থ্যের হদিস পেয়ে তাঁরা অবধারিত পুলকিত হবেন। এই রেস্তোরাঁ বেশির ভাগ সসই নিজেরা তৈরি করে। ফাইভ স্পাইস সস, কোনজি সস বা ব্ল্যাক পেপার সসের এক একটি কীর্তি বেশ স্মরণীয়। |
|
চিনে রেস্তোরাঁয় ডেজার্ট-পর্বটা এমনিতে বাঙালির জন্য বেশ মর্মান্তিক। অনেকেই চিনে ডিনারশেষে ব্রাউনি, আইসক্রিম, টুটিফ্রুটিরই খোঁজ করেন। তাঁদের একটা ছোট্ট পরামর্শ। এ তল্লাটে এসে ওয়ালনাট টফির স্বাদগ্রহণ না-করে টেবিল ছাড়বেন না। চাইলে শুরুতেই বলে রাখুন, শেষ পাতে ওটা চাই-ই চাই! ক্যারামেলাইজ্ড চিনির রসে নাওয়া ডেলা পাকানো তিলখচিত আখরোট খেতে খেতে চোখ বুজে আসে। ঠান্ডা-নরম আইসক্রিমের সঙ্গতে এই টফি পাতে আসে। কিন্তু শুধু আখরোটের মাধুর্যও মোটে কম যায় না।
|
ছবি: শুভেন্দু চাকী |
|
|
|
|
|