ব্যাগ গুছিয়ে...
ক্যাঙারুর দেশে
মাটি থেকে তখন আমরা ছিলাম প্রায় ১৩০ মিটার উঁচুতে। একেবারে সিডনি হারবার ব্রিজের মাথায়। গোটা সিডনি শহরটাকে সেখান থেকে অন্য রকম লাগছিল। বিকেলের পড়ন্ত আলো এসে পড়েছিল সিডনি অপেরা হাউসের গায়ে। জ্বলজ্বল করছিল সেটি।
অস্ট্রেলিয়ার দুই আইকন সিডনি হারবার ব্রিজ এবং সিডনি অপেরা। একটার শীর্ষ বিন্দুতে দাঁড়িয়ে অন্যটাকে দেখতে দেখতে অন্য রকম অনুভূতি হচ্ছিল। আর কানে বাজছিল একটাই নাম। জন উটজন। কিছুক্ষণ আগেই দেখে এসেছি বিশ্বের অন্যতম ওই নির্মাণশৈলীকে। বাড়িটার আসল কৌশল তার স্থাপত্যকলায়। আর সেই স্থপতির নামই উটজন। বছর চারেক আগে তাঁর মৃত্যু হয়েছে পরিণত বয়সে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে তিনিই অন্যতম ট্রাজিক নায়ক!
ডেনমার্কের নাগরিক জন উটজন মারা গিয়েছিলেন অভিমান বুকে নিয়ে। নিজের সৃষ্টিকে এক বারের জন্যও স্বচক্ষে দেখে যেতে পারেননি। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতেও পারেননি। নিজের সৃষ্টি থেকে বহু দূরে মৃত্যু হয়েছে তাঁর। অতৃপ্ত বাসনা নিয়ে।
উটজনের সিডনি অপেরা হাউস বিশ্বের অন্যতম সেরা নির্মাণশৈলী হিসেবে স্থান করে নিয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জের ঐতিহ্যবাহী ভবনের তালিকায়। ভবনের সাতটি প্রেক্ষাগৃহে বছরে গড়ে দেড় হাজার অনুষ্ঠান হয়। সিডনি শহরের যে কোনও গাইডকে সঙ্গে নিন, আপনি উটজনের গল্পটা তাঁর মুখ থেকে শুনতেই পাবেন। আর সেটাই সিডনি অপেরা ঘুরে দেখার বাসনাটা উস্কে দেয়।
কী সেই গল্প?
ভারত থেকে ব্রিটিশরা যখন তাদের শাসন গুটিয়ে নেওয়ার তোড়জোড় শুরু করছে, সিডনি অপেরা হাউস তৈরির ভাবনার উৎপত্তি ঠিক সেই সময়ে। সিডনি শহরে তখন বড় বড় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের কেন্দ্র ছিল সিডনি টাউন হল। সে সময় নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্যের সংস্কৃতিচর্চার প্রাণপুরুষ ছিলেন ইউগিন গুসেন্স (Eugene Goosscns)। শহরে বড় একটি সংস্কৃতিচর্চার কেন্দ্র খোলার স্বপ্নটা প্রথম এসেছিল গুসেন্সের মাথা থেকেই। সেই ভাবনাটি নিউ সাউথ ওয়েলস প্রশাসনের অনুমোদন পেল ১৯৫৪ সালে।
সিডনি অপেরা কোথায় হবে সেই স্থান নির্বাচন প্রাথমিক ভাবে করে দিয়েছিলেন গুসেন্স। তাঁর ইচ্ছে ছিল সমুদ্রের খাঁড়ির ধার ঘেঁষে এমন একটা জায়গায় সেটি তৈরি হোক যাতে সিডনি হারবার ব্রিজ, বোটানিক্যাল গার্ডেন, রেল স্টেশন সব মিলিয়ে নতুন একটা পর্যটন স্থলের চেহারা নেয়। ঠিক হয়, সিডনি ট্রাম কোম্পানির স্থান বদল করে সেখানেই গড়ে উঠবে সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। সিডনি অপেরা হাউজ।
কিন্তু নকশা তৈরি করবে কে?
প্রস্তাবিত ওই অপেরার নকশা কী হবে তা ঠিক করতে প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা হল। ১৯৫৫ সালে বিশ্বের ৩২টি দেশ থেকে মোট ২৩৩টি নকশা এসে পৌঁছল। অপেরায় ঠিক কী কী হবে, কতগুলি প্রেক্ষাগৃহ থাকবে, কোন প্রেক্ষাগৃহে কী হবে, তাদের আসনসংখ্যা কত হবে, উচ্চতা কত হবে তা নকশা তৈরির শর্তের সঙ্গে লিখে দেওয়া হয়েছিল। দু’বছর ধরে বিভিন্ন বিচারক নকশাগুলি ঘেঁটে ১৯৫৭ সালে একটিকে চূড়ান্ত করলেন।
পাঁচ হাজার অস্ট্রেলীয় ডলারের সেই পুরস্কার জিতে নিলেন ৩৮ বছরের ড্যানিশ স্থপতি জন উটজন। সিডনি অপেরার গাইড জন টেরি হাসতে হাসতে বললেন, “আপনারা বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, চূড়ান্ত পর্যায়ের বাছাইয়ের সময়ে অন্য ৩০টি নকশার সঙ্গে উটজনের নকশাটিও বাতিলের তালিকায় রাখা হয়েছিল। ফের ঝাড়াই-বাছাইয়ের সময়ে সেটির দিকে নজর পড়ে বিচারকদের। শোনা যায়, ফিনল্যান্ডের স্থপতি ইয়েরো সারিনেন (Eero Saarinen) বাতিলের ফাইল থেকে তুলে এনেছিলেন উটজনের নকশাটি।”
১৯৫৭ সালে উটজন প্রথম বারের জন্য সিডনি আসেন তাঁর নকশা কী ভাবে বাস্তবায়িত করা যায় তা নিয়ে আলোচনা করতে। ১৯৫৯ সালের মার্চে শুরু হয় সিডনি অপেরার কাজ। ১৯৬৩ সালে উটজন তাঁর অফিস পাকাপাকি ভাবে তুলে নিয়ে যান সিডনিতে। কিন্তু নকশা কী ভাবে বাস্তবে রূপায়িত করা হবে তা নিয়ে নির্মাতা সংস্থার সঙ্গে উটজনের চাপানউতোর শুরু হল। অন্য দিকে সিডনি প্রশাসন চাইছিল তাড়াতাড়ি কাজ শুরু করে দিতে। নিউ সাউথ ওয়েলস প্রশাসন ১৯৫৭ সালে প্রকল্প তৈরির নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে দিয়েছিল। ঠিক হয়েছিল ১৯৬৩ সালের ২৬ জানুয়ারি (অস্ট্রেলিয়া দিবস) কাজ শেষ হবে। মোট খরচ ধরা হয়েছিল ৭০ লক্ষ ডলার।
১৯৬৫ সালে নিউ সাউথ ওয়েলসয়ে নতুন সরকার এল। ওই স্থপতির নানা প্রস্তাব নানা ভাবে ফিরিয়ে দিতে শুরু করল প্রশাসন। উটজন মৌখিক ভাবে পদত্যাগের হুমকি দিতে শুরু করলেন। তাতেও কিছু হচ্ছে না দেখে অপেরা হাউস কর্মসমিতিকে উটজন লিখিত ভাবে জানালেন, “আমার এই প্রস্তাব মানা না হলে আমি পদত্যাগ করতে বাধ্য হব।” জবাব এল, ‘আপনার পদত্যাগ গৃহীত হল। ধন্যবাদ।
-ভাল থাকবেন।’
১৯৬৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি উটজন তাঁর সাধের প্রকল্প থেকে সরে এলেন। তখন তাঁর বয়স ৪৭। এর পরে আর এক বারের জন্যও সিডনি ফেরেননি তিনি। ১৯৭৩ সালের ২০ অক্টোবর ধূমধাম করে উদ্বোধন হল সিডনি অপেরা হাউস। সেই অনুষ্ঠানে উটজন আমন্ত্রণ তো পানইনি, এমনকী সিডনি অপেরার সৃষ্টিকর্তার নামটিও এক বারের জন্য উচ্চারিত হয়নি কোথাও। না বক্তৃতায়, না ছাপার অক্ষরে।
দীর্ঘ ৩০ বছর উটজনকে ভুলে ছিল অস্ট্রেলিয়া। ১৯৯৬ সালে সিডনি অপেরার কিছু কিছু অংশের পুনর্গঠনের প্রয়োজন হয়ে পড়ায় যোগাযোগ করা হল ওই স্থপতির সঙ্গে। তিনি তখন ৬৭ বছরের বৃদ্ধ। জানিয়ে দিলেন ডেনমার্ক থেকেই যা করার করবেন। সিডনিতে আর যাবেন না। ২০০৮ সালের ২৯ নভেম্বর ডেনমার্কেই মৃত্যু হয় ওই স্থপতির।
মৃত্যুর পরে উটজনকে ‘বীর’-এর সম্মান দিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। ২০০৯ সালের ২৫ মার্চ সিডনি অপেরা হাউসের কনসার্ট হলে এক অনুষ্ঠানে গোটা অস্ট্রেলিয়া স্মরণ করে অপেরা হাউসের সৃষ্টিকর্তাকে। আর কোনও ব্যক্তির মৃত্যুর পরে স্মরণসভার আয়োজন কিন্তু করেনি সিডনি অপেরা।
সিডনি থেকে ফিরে আপনি ওই মহাদেশের যেখানেই যান না কেন, জন উটজন আর তাঁর অপেরা হাউস কিন্তু পিছু ছাড়বে না।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.