বাজারে আলু মহার্ঘ, চাষির লাভ সামান্যই
ক সময়ে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন লালুপ্রসাদ যাদব। নেতার জনপ্রিয়তা বোঝাতে সে সময়ে তাঁর অনুগামীরা ছড়া কাটতেন: যব তক্ সামোসেমে আলু, তব তক বিহারমে লালু। বিহারে লালুর রাজ্যপাট গিয়েছে ঢের আগেই। আলুর সঙ্গে শিঙ্গারার গাঁটছড়া কিন্তু রয়ে গিয়েছে আগের মতোই। বাঙালির পাতে আবার আলুর ব্যবহার রকমারি। আলু ভাতে, ভাজা বা দম তো আছেই, পোস্ত বা অন্য তরকারিতেও তার স্বচ্ছন্দ বিরাজ। ফলে থলে হাতে বাঙালির বাজরে যাওয়া মানেই আলু কেনা চাই-ই, চাই। গরিব মানুষের ভাত-রুটির সঙ্গে একটা তরকারি মানেও অবধারিত আলু।
ইদানীং সেই আলুই হয়ে উঠেছে মহার্ঘ। মেদিনীপুরের বাজারে আলুর দাম কেজি প্রতি ১২ থেকে ১৪ টাকা এখনই। আরও বাড়ার ভাল রকমই আশঙ্কা। আলুর জেলা মেদিনীপুরেই যদি এই হাল হয়, অন্যত্র কী অবস্থাসহজেই অনুমেয়। পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতা-সহ বিস্তীর্ণ এলাকায় আলুই অন্যতম প্রধান চাষ। বাজারে আলুর দর দেখে মেদিনীপুর শহরের বাসিন্দারা কেউ কেউ ভাবতেও পারেনএ বার নিশ্চয়ই চাষিরা চরা দরে আলু বেচছেন। আগের কয়েক বার চাষিদের লোকসানের যে কথা শোনা গিয়েছিল, এ বার নিশ্চয়ই সেই অবস্থার পরিবর্তনে ভালই মুনাফা হচ্ছে!
ভিন্ রাজ্যে পাড়ি দিচ্ছে পশ্চিম মেদিনীপুরের আলু। —নিজস্ব চিত্র।
এমন ভাবনার সঙ্গে বাস্তবের কিন্তু মিল নেই। সংশয় নিরসনে যে কেউ এক বার চন্দ্রকোনা রোড, গড়বেতায় ঢুঁ মারতে পারেন। মেদিনীপুর শহর থেকে কতই বা, ৪০-৫০ কিলোমিটার দূরত্ব। এই স্বল্প দূরত্বেই চাষের মাঠ থেকে শহরের বাজারের মধ্যের ফারাকটা ভিড়মি খাইয়ে দিতে পারে। বাজারে ১২/১৪ টাকা কেজি হলে কী হবে, চাষিরা কেজি-প্রতি পাচ্ছেন কিন্তু ৪, সাড়ে ৪ টাকা মাত্র। এই দামে তাঁদের লোকসান হচ্ছে না ঠিকই। কিন্তু ‘মুনাফা’ও কষ্ট-কল্পনা। লাভের ভাগ বেশি সেই মাঝের ব্যবসায়ীর। আমনের ধান সহায়কমূল্যে কেনা চলছে ঢিমতালে। সহায়কমূল্যে কেনার লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ হয়নি। বাজারেও দাম ওঠেনি। আগের বছর ধান-আলুতেও বিপর্যয় গিয়েছে। ফলে চাষির হাতে পয়সা ছিল না। হরেক ঘোষণা সত্ত্বেও সরকারি ভাবে চাষিকে সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থাও হয়নি। আলু চাষের জন্যও তাই মহাজন-ব্যবসায়ীর থেকেই ঋণ নিতে হয়েছিল চাষিকে। ফসল ওঠার পর অবধারিত ভাবেই চাষিকে মহাজন-ব্যবসায়ীর কাছে, ওই পক্ষের শর্তেই আলু বেচে দিতে হয়েছে।
সংরক্ষণ ও বণ্টনের ব্যবস্থাও চূড়ান্ত ভাবে বেসরকারি পুঁজি নিয়ন্ত্রিত। সরকার নামেই সরকার! এই ব্যবস্থায় ব্যবসায়ীর নির্ধারিত দামে ও মর্জিতে ফসল বেচে না দিয়ে দাম বাড়ার আশায় ফেলে রাখবেন, সে সুযোগ কোথায় চাষির! গড়বেতা থেকে মেদিনীপুরে এক-গাড়ি (=২০০ বস্তা, প্রতি-বস্তা ৫০ কেজির হিসাবে ১০ হাজার কেজি) আলু পরিবহণে খরচ (প্যাকেজিং, ওঠানো-নামানো যোগ করে) ২ হাজার টাকাও যদি হয়, কেজি-প্রতি মাঠের দর সাড়ে ৪ টাকার সঙ্গে যোগ হতে পারে ২০ পয়সা। না হয় ৫০ পয়সাও হল। তাতেও তো ৫ টাকার বেশি হয় না। না-হয় ৬ বা ৭ টাকাই হল, কিন্তু বাজারে যে দর ১৪ টাকা! থ মেরে যাচ্ছেন চাষি।
শালবনি থানার বড়াকুলিতে বাড়ি আশিস নায়েকের। তাঁর বক্তব্য, “আমাদের মতো চাষিরা যেখানে কেজি প্রতি ৪ থেকে সাড়ে ৪ টাকা পেয়েছি। সেখানে খোলাবাজারে এখন আলুর দাম ১৪ টাকা! এটা ভাবলেই কেমন লাগছে।” গত বার ৬ বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছিলেন। এ বার ৪ বিঘা জমিতে চাষ করেছিলেন আশিসবাবু। কুইন্টাল পিছু ৪৩০ টাকা পেয়েছেন। তাঁর কথায়, “গত বার আলু-চাষে ক্ষতি হয়েছিল। এ বার কম জমিতে চাষ করেছি। যদি আরও একটু বেশি দাম পেতাম, ভাল হত।”
এখন মাঠে আর আলু নেই। যে পরিমাণ ফলন হয়েছে, তার বেশির ভাগটাই চলে গিয়েছে ব্যবসায়ী, ফড়েদের কাছে। তাঁদের অনেকে আবার স্টোরে আলু মজুত রেখেছেন। ভবিষ্যতে আরও মুনাফার আশায়। চন্দ্রকোনা রোডের একটি স্টোরে ৪ লক্ষ ৩৫ হাজার বস্তা আলু রাখা যায়। এ বার ওই স্টোরে ২০-২৫ শতাংশ জায়গা এখনও ফাঁকা রয়েছে। স্টোরের ম্যানেজার মনোরঞ্জন কাঁড়ার বলেন, “গড়বেতা এলাকায় নতুন করে ৫টি স্টোর খুলেছে। তাই মজুতের সুযোগ বেড়েছে।” অন্য একাংশ ব্যবসায়ী এখনই ‘চড়া’ দামে আলু বিক্রি শুরু করেছেন। পশ্চিম মেদিনীপুরে গড়ে ৭৫ হাজার হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়। এ বার অবশ্য ৬০ হাজার হেক্টরের কিছু বেশি জমিতে চাষ হয়েছিল। গত দু’বছর আলুতে ক্ষতির কারণেই চাষিরা অপেক্ষাকৃত কম জমিতে আলু চাষ করেছিলেন। তার উপর বৃষ্টির কারণে ধসারোগেও চাষ কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আবহাওয়া অনুকূল থাকলে এক বিঘা জমিতে প্রায় ৪৫ কুইন্টাল আলু ফলে। এ বার সেখানে গড়ে ৩০ কুইন্টাল ফলেছে। জেলার সহ-কৃষিঅধিকর্তা (তথ্য) দুলাল দাস অধিকারী বলেন, “চাষ হয়েছিল কম জমিতে। তার উপর মাঝে বৃষ্টি হওয়ায় ফলন কিছুটা কমেছে।” অন্য দিকে,পঞ্জাবের আলু এ বার বন্যার কারণে মার খেয়েছে। ভিন্ রাজ্যের আলু পশ্চিমবঙ্গের বাজারে তেমন ঢোকেনি। এই পরিস্থিতির সুযোগেই চড়া মুনাফার অঙ্ক কষছেন ব্যবসায়ীরা।
জেলার মধ্যে সব থেকে বেশি আলু চাষ হয় গড়বেতায়। সেই গড়বেতার ডুকি-র বাসিন্দা রামচন্দ্র দিগার বলেন, “আলুর ক্ষেত্রে কোন বছর কী দাম হবে, তা আগে থেকে বলা যায় না। কখনও বেশি লাভ হয়। আবার কখনও ফসল বিক্রি করে চাষের খরচও ওঠে না। বেশি লাভ না-হলেও এ বার ক্ষতির মুখ দেখতে হয়নি। তবে খোলাবাজারের তুলনায় আমরা, চাষিরা সামান্যই দাম পেয়েছি।” শালবনির মহাশোলের ক্ষুদ্রচাষি সনাতম মাহাতো এ বার এক বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছিলেন। দাম পেয়েছেন কুইন্টাল-প্রতি ৪৮০ টাকা। তাঁর কথায়, “চাষের পর কেউই আলু ফেলে রাখতে চায় না। যাদের সামর্থ্য রয়েছে, তারা স্টোরে মজুত রাখে। না হলে অধিকাংশ ক্ষুদ্র-মাঝারি চাষিই ব্যবসায়ীদের কাছে আলু বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়। তখন আর পরে দাম বাড়তে পারে, এই ভাবনা মনে থাকে না।”


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.