তুলিটা হাতে তুলে নিয়েই সবুজ রঙে ডুবিয়ে নিল কিশোরী অঞ্জু। দেওয়ালে আঁকা গাছের পাতা সবুজে ভরিয়ে দিয়ে, গাছের নিচে কয়েকটা ঘাসও এঁকে দিল। অঞ্জুর পাশে দাঁড়ানো মধুমিতা তখন নীল রঙ বুলিয়ে দেওয়াল জুড়ে আকাশ বানিয়ে দিয়েছে। ঘাস আঁকা শেষ করে মধুমিতার আকাশে হঠাৎই একটি সবুজ রঙের ডানা একে দিয়ে, নিজেই দু’হাত ছড়িয়ে পাখি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অঞ্জুর পাখি হওয়া দেখে দু’হাতে মুখ ঢেকে হেসেই কুটিপাটি মধুমিতা। মুখ ঢাকতে গিয়ে হাতে থাকা তুলির নীল রঙ মধুমিতার কপালে লেগে গিয়েছে। মধুমিতার কাণ্ড দেখে অঞ্জুও মাতোয়ারা। মধুমিতার কপালে লেগে যাওয়া রঙ দেখাতে আশেপাশের সকলকে ব্যস্ত হয়ে হাত নেড়ে ইশারায় ডাকছে অঞ্জু। দেওয়ালে আঁকা গাছের ছবি দেখাতেও সকলকে ডাকছে অঞ্জু, হাত নেড়ে ইশারাতেই। জলপাইগুড়ি ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের বিশেষ স্কুলের ছাত্রী অঞ্জু রজক কথা বলতে পারে না। মূক প্রতিবন্ধী। মধুমিতা বসাক মানসিক প্রতিবন্ধী। ওদের সঙ্গীরাও সকলেই শরীর অথবা মনের প্রতিবন্ধকতার শিকার। শুক্রবার সকালে ওঁরাই জলপাইগুড়ির বাবুপাড়ার দেওয়ালে দেওয়ালে গাছ, পাখি, আকাশ এঁকেছে। সম্প্রতি জলপাইগুড়ির একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা সুভাষ মঞ্চের তরফে শহর জুড়ে দেওয়ালে ছবি এঁকে প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ ব্যবহারের বিরুদ্ধে সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। |
জলপাইগুড়িতে সন্দীপ পালের তোলা ছবি। |
তারই অঙ্গ হিসেবে শহরের বাবুপাড়ায় প্রতিবন্ধী শিশু, কিশোরদের দিয়ে পরিবেশ রক্ষার ছবি আঁকানোর ব্যাপারে উদ্যোগী হয় সংস্থাটি। সংস্থার তরফে জলপাইগুড়ি ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনকে প্রস্তাব দিতেই তাঁরাও রাজি হয়ে যান। ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক সঞ্জয় চক্রবর্তী বলেন, “আমাদের বিশেষ স্কুলের প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েরা ছবি আঁকতে অভ্যস্ত। প্লাস্টিকের ব্যবহার নিয়ে শহর জুড়ে ছবি এঁকে যে পথ চলা শুরু হয়েছে, তাতে ওরা কেন বাদ যাবে। সে কারণে সংস্থার প্রস্তাবে প্রথমেই রাজি হয়ে গিয়েছে। অঞ্জু, মধুমিতা, গোবিন্দও ছবি এঁকে খুব খুশি।” দেওয়ালে ইচ্ছে মতো রঙ করতে পেরে খুশি লুকোতে পারছিল না মধুমিতা। তার বক্তব্য, “অনেক রঙ করলাম। চারদিকে নীল, সবুজ এঁকে দিয়েছি।” গত ২৬ মার্চ ছবি এঁকে প্লাস্টিক বিরোধী অভিযান শুরু করেছে সুভাষ মঞ্চ। মঞ্চের তরফে জানানো হয়েছে, একমাস ধরে ছবি আঁকা চলবে। যে কেউ যেমন ইচ্ছে ছবি আঁকতে পারে। একমাস পরে সব ছবি বিচার করে পুরষ্কার ঘোষণা করা হবে। এদিন বাবুপাড়ায় ভারতী স্মৃতি অঙ্কন শিক্ষাকেন্দ্রের ছাত্রছাত্রীরা ছটি দেওয়ালে ছবি আঁকে। তাদের সঙ্গে সামিল হয়েছিল প্রতিবন্ধী স্কুলের পড়ুয়ারাও। শিল্পী তথা ভারতী স্মৃতি অঙ্কন কেন্দ্রের কর্ণধার বিভাস রায় বলেন, “আমাদের আঁকা ছবিতে প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েরা রঙ করল, এটাই সৌভাগ্যের বিষয়। সকলের মনের ভেতরেই ভাবনা লুকিয়ে রয়েছে। নানা প্রতিবন্ধকতা সত্বেও ওরা সবুজ আর নীল রঙ যে ভাবে ব্যবহার করেছে তা ওদের ভেতরে থাকা নির্মল ভাবনারই প্রতীক। ছবিতেও ওরা প্লাস্টিক রুখে নীল আকাশ আর সবুজ গাছপালা রক্ষার বার্তাই দিয়েছে।” এদিনের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত আয়কর আইনজীবী মিহির বন্দোপাধ্যায়, গবেষক বিমলেন্দু মজুমদার, চিকিৎসক পান্থ দাশগুপ্তরাও সামিল হয়েছিলেন। আয়োজক সংস্থা সুভাষ মঞ্চের আহ্বায়ক প্রবাল রাহা বলেন, “ছবি এঁকে প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরার পরেই সমাজের সর্বস্তর থেকে উৎসাহ পেয়েছি। এদিন প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েরা যেভাবে নিজেদের মতো করে ছবি আঁকল তাতে মনে হল এই উদ্যোগ যেন সার্থক। শিল্পী বিভাস রায়কে আন্তরিক অভিনন্দন।” |