অল্পের জন্য ‘সরিষ্কা’ হতে হতে বেঁচে গেল অরুণাচলের ‘নামদফা’। সৌজন্যে, সবেধন নীলমণি এক হলদে-কালো ডোরার ছবি। বছর পাঁচেক ধরে এই ব্যাঘ্র অরণ্যে বাঘ থাকা-না থাকা নিয়ে বিস্তর তর্কবিতর্কের পর বিশেষজ্ঞ ও বনকর্তাদের একাংশ প্রায় ধরেই নিয়েছিলেন, বাঘহীন হয়ে গিয়েছে এই অরণ্য। ঠিক সে সময়েই ক্যামেরা ট্র্যাপিং-এ নামদফায় রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের উপস্থিতির প্রথম ও প্রত্যক্ষ প্রমাণ মিলল। সেই সঙ্গে মিলল আরও ৩৪টি প্রাণীর ছবি।
১৯৮৩ সালে জাতীয় উদ্যান ও ১৯৮৬ সালে টাইগার রির্জাভ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া নামদফার আয়তন ১৯৮৫ বর্গ কিলোমিটার। দাবি করা হয়, নামদফার ৬০ শতাংশ অরণ্য এখনও কুমারী। সেখানে এখনও মানুষের পা পড়েনি। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বইছে বহু নদী, জলধারা, ঝর্না। রয়েছে একের পর এক পাহাড়। শীতকালেও এই অরণ্যের ভিতরে মাত্র ৭০ বর্গ কিলোমিটার অবধি জিপে যাওয়া যায়। নামদফায় ৯৬ ধরণের স্তন্যপায়ী ও সাড়ে তিনশো প্রজাতির পাখির বাস। এর মধ্যে ২৯টিই প্রথম তফসিলভুক্ত। |
ট্র্যাপিং ক্যামেরায় দেখা মিলল বাঘের। নামদফা বন-কর্তৃপক্ষের সৌজন্যে। |
নামদফা দেশের একমাত্র সংরক্ষিত অরণ্য যেখানে একই সঙ্গে রয়্যাল বেঙ্গল, চিতাবাঘ, মেঘলা চিতাবাঘ ও তুষার চিতাবাঘ রয়েছে। তবে গত এক দশকে নামদফায় প্রকৃত বাঘের সংখ্যা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক হয়েছে। খোদ ‘প্রজেক্ট টাইগার’-এর ওয়েবসাইটে ১৯৯৩, ১৯৯৫, ১৯৯৯ ও ২০০২ সালে যথাক্রমে ৪৯, ৫২, ৫৭ ও ৬১টি বাঘ থাকার দাবি করা হলেও অরুণাচল ও অসমের বাঘ বিশেষজ্ঞরা তা মানতে নারাজ। এনটিসিএ কর্তৃপক্ষের হিসেবে ২০০০ সালে এই অরণ্যে ১১টি বাঘ ছিল। ২০০৬ সালে মাত্র ৪টি বাঘ থাকার পরোক্ষ প্রমাণ মিলেছিল। সেই সঙ্গে অরণ্যে বাড়তে থাকা জবরদখল এবং চিনা উপজাতির চোরাশিকারের ফলে দ্রুত কমছিল অন্যান্য প্রাণীর সংখ্যাও। ২০০৮-০৯ সালে নামদফায় ব্যাঘ্র গণনা অভিযানেও চারটি বাঘের সন্ধান মেলে। ২০১১ সালে বাঘের বিষ্ঠা বিশ্লেষণ করেও নামদফায় বাঘের অস্তিত্ব প্রমাণ হয়।
নামদফা ব্যাঘ্র প্রকল্পে বাঘের সঠিক সংখ্যার সন্ধানে ২০১২ সালে প্রথম ক্যামেরা ট্র্যাপিং-এর সিন্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রায় দেড়শো বনকর্মী, পশুপ্রেমী, রক্ষী ও স্বেচ্ছাসেবী সুমারি শুরু করেন। বাঘ বিশেষজ্ঞ ও সুমারি প্রকল্পের প্রধান ফিরোজ আহমেদ জানান, ‘কোর এরিয়া’-য় হ্যাপি ভ্যালি, হলদিবাড়ি, হর্নবিল, বুলবুলিয়া, রানিঝিল ও ফার্মবেস এলাকায় ৮০টি ক্যামেরা বসানো হয়। পশুপ্রেমী ও স্বেচ্ছাসেবকরা এমন কিছু এলাকায় পৌঁছন যেখানে আগে বনকর্মীদের পা পড়েনি। কিন্তু প্রথম থেকেই শিকারিদের প্রতিরোধের মুখে পড়েন তাঁরা। সশস্ত্র শিকারিরা ৫ লক্ষ টাকা ব্যয়ে নির্মিত রক্ষণ শিবিরটি পুরো ভেঙে ফেলে। লিসু, ইয়োবিন উপজাতির শিকারিরা কোডবয় সংরক্ষিত ব্যাঘ্র অরণ্যের ভিতরে ঢুকে বনরক্ষী ও স্বেচ্ছাসেবীদের মারধর করে, গুলি চালায়। সুমারির জন্য পাতা ২৫টি মূল্যবান ক্যামেরা ও ৫০টির বেশি মেমরি কার্ড শিবির থেকে লুঠ করে তারা। ফলে সুমারির কাজ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এমনকী, পরিস্থিতি
দেখতে আসা প্রধান মুখ্য বনপাল জে এল সিংহকে লক্ষ্য করেও শিকারিরা গুলি চালায়। ব্যাঘ্র অরণ্যের ভিতরে বাঘ শিকারে ব্যবহার হওয়া বেশ কিছু বর্মি ফাঁদও উদ্ধার হয়।
তবে বিস্তর সমস্যার পরেও, থেকে যাওয়া মেমরি কার্ডে বাঘের একটি ছবি ও পায়ের ছাপ, বহু ধরনের হরিণ, সোনালি বিড়াল, মেঘলা চিতাবাঘ, মালয় সূর্য ভল্লুক, হাতি, গউর, বিনটুরং, খালিজ ফেজ্যান্ট, মার্বল্ড ক্যাট, চিতাবাঘ, বিশাল সিভেট, হলুদ গলার মার্টেন, বুনো কুকুর, লাল গরাল, র্যাট ব্যান্ডিকুট, স্টাম্পড টেইল্ড ম্যাকাকের মতো পশুপাখির ছবি পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে বাঘের বিষ্ঠার ১৩টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। সেগুলি পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। |