|
|
|
|
শতায়ু বাঙালি নৌ-অফিসার |
কৃষ্ণ মেননের সঙ্গে তর্কের স্মৃতি আজও অটুট |
অগ্নি রায় • নয়াদিল্লি |
ষষ্ঠীচরণের মতো খেলার ছলে হাতি লোফেননি তিনি। মনোহর আইচের মতো এখনও হাতের গুলি ফুলিয়ে তাক লাগাতেও পারেন না। শতবর্ষ পূর্ণ করা ভারতীয় নৌবাহিনীর এই প্রাক্তন বাঙালি কমোডরের স্মৃতি কিন্তু এখনও সতেজ। সঙ্গে অমলিন হাসি, দীর্ঘায়ু যার সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে শিশুর সারল্য।
চার দিন আগেই শত বর্ষপূর্তির পারিবারিক উৎসবে মেয়েদের বানানো কেক থেকে একটি টুকরো তৃপ্তির সঙ্গে খেয়েছেন সুধীরকুমার চট্টোপাধ্যায়। বরিশালের এই আদি নিবাসী নৌসেনার চাকরি থেকে অবসরই নিয়েছেন সেই ১৯৬৭ সালে! তার পর আরও পাঁচ বছর কান্দলা বন্দরের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে। ব্যস, এর পর দিল্লিতে দীর্ঘ অবসর।
পেঁপে-বিট-গাজর-লাউ-কড়াইশুঁটি, গলানো ভাত আর পাবদা মাছ মিশিয়ে তৈরি সুস্বাদু একটি মণ্ড। গত পাঁচ বছর ধরে দুপুরে এটাই মেনু সুধীরবাবুর। মাছটা অবশ্য বদলে বদলে যায়, আর মরসুম অনুযায়ী সব্জি। খাওয়া সেরে সুধীরবাবু ডুব দিলেন স্মৃতিতে। “আমি তখন কান্দলা বন্দরের দায়িত্বে। ইন্দিরা গাঁধী সে সময় প্রধানমন্ত্রী। খুবই পছন্দ করতেন আমায়। কোনও কারণে সে সময় এক বার দেশের সমস্ত বন্দরে ধর্মঘট বিক্ষোভ চলছিল। শুধুমাত্র আমার ওখানে হয়নি। উনি খুব খুশি হয়েছিলেন।
বন্দর পরিদর্শনে গিয়ে আমার বাড়িতে এলেন দুপুরে খেতে। আমার স্ত্রীর রান্না করা লাউ-চিংড়ি চেয়ে চেয়ে খেয়েছিলেন! ভাঙা বাংলায় কথাও বলেছিলেন পরিবারের সবার সঙ্গে।”
আজীবন নৌসেনা বিভাগে কাজ করেছেন ঠিকই। কিন্তু সুধীরবাবু পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। ১৯৩৬ সালে শিবপুর বি ই কলেজ থেকে পাশ করেছিলেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে। তখন দেশে ব্রিটিশ শাসনের রমরমা। পাশ করার পর মার্টিন সংস্থায় (পরে যার নাম হয়েছিল মার্টিন বার্ন) কিছুদিন চাকরি করেছিলেন। বেলুড় মঠের চূড়াটির সংস্কারের
|
সুধীরকুমার চট্টোপাধ্যায় |
সময় মূল নকশাটি করেছিলেন সুধীরবাবুই। ১৯৪৪ সালে যোগ দেন সেনায়। ব্রিটিশ ভারত এবং স্বাধীন ভারত দু’তরফেই কাজ করেছেন। থেকেছেন একই রকম আপসহীন। জওহরলাল নেহরুর বিশেষ বন্ধু, তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী কৃষ্ণ মেননের সঙ্গে একবার রীতিমতো বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়েছিলেন সুধীরবাবু। “কোনও একটি সেনা আবাসনের জন্য করা আমার ডিজাইন দেখে ডেকে পাঠিয়েছিলেন মেনন। বলেছিলেন, এত খরচ করে এত বড় বাড়ির প্রয়োজন নেই। বেশ কড়া ভাবে বলেন, আমার বাবা-ঠাকুর্দারা কি এত বড় বাড়িতে থেকেছেন?” ব্যস, এতেই মাথা গরম হয়ে যায় সুবোধবাবুর। সপাটে জানতে চেয়েছিলেন, ‘কৃষ্ণ মেনন তো এসি ঘরে থাকেন!
তাঁর বাবাও কি এসি ঘরেই গোটা জীবন কাটিয়েছিলেন?’ রাতে স্ত্রীকে বলেছিলেন, চাকরিটা বোধহয় গেল! কিন্তু মজার ব্যাপার, পরদিন মেনন তাঁকে ডেকে পাঠিয়ে বিরস কণ্ঠে ওই
ডিজাইন মঞ্জুর করে বলেছিলেন, ‘‘তোমার মতো তার্কিকের সঙ্গে কে ঝগড়া করবে!”
চাকরি ছেড়েছেন চার দশক হয়ে গেল। কিন্তু ৮০ বছর পর্যন্ত দাপটে গাড়ি চালাতেন দিল্লির বুকে। মেয়েদের ধমকে ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। নব্বই পর্যন্ত ছুটতেন! পার্কে গাছের ডাল ধরে ঝুলতেন। ফ্রি হ্যান্ড করতেন নিয়মিত। একশোতে পৌঁছে অবশ্য সে সব আর হয় না। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে যান না। হাঁটাচলা শ্লথ হয়েছে। টিভি কোনও কালেই দেখতেন না। খবরের কাগজের শিরোনামে চোখ বুলোনো অবশ্য বাধ্যতামূলক। মেয়ে, নাতি-পুতি মিলিয়ে রয়েছেন ১৭ জন। তবে সবাই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়েছিটিয়ে। তাঁর দেখাশুনোর জন্য বাড়িতে রয়েছেন সর্বক্ষণের সহায়ক।
স্বাভাবিক প্রশ্ন, এই দীর্ঘায়ুর রহস্য কী? সুধীরবাবুর মেয়ে ছন্দা বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতা নিবাসী। তিনি বললেন, “গোটা জীবন ধরেই নিয়মিত ব্যায়াম। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে বাইরের খাওয়া খাননি কখনও। সিগারেট বা মদ ছোঁননি। এ ছাড়া আর একটা সুবিধা ছিল। বংশগত ভাবেই ডায়াবিটিস আর রক্তচাপজনিত অসুখ আমাদের পরিবারের কারও নেই। বাবা তো এখনও রোজ চকলেট খান!”
তবে দীর্ঘায়ু জীবনের সঙ্গে যেমন জড়িয়ে রয়েছে প্রচুর স্মৃতি-অভিজ্ঞতা, তেমনই রয়েছে দুঃসহ বেদনার দিকও। বেদনা পরিচিতি পৃথিবীটা বদলে যাওয়ার, সঙ্গহীনতার। সর্বোপরি প্রিয়জনের মৃত্যু দেখার। গত তিন বছরে সুধীরবাবুর চোখের সামনেই চলে গিয়েছেন তাঁর দুই পুত্র। এক জন কিডনির সমস্যায়, অন্য জন নার্ভের অসুখে। তারপর থেকেই নিজেকে কিছুটা গুটিয়ে নিয়েছেন সুধীরবাবু। হেঁটে বাইরের ঘরেও যেতে চান না। কথাও বলতে চান না বেশি। এক শতাব্দীর স্মৃতি এবং নিস্তব্ধতা মাথায় নিয়ে দিল্লির বসন্ত কুঞ্জের বাড়িতে শুধু দিন যাপন করে চলেন সুধীরকুমার চট্টোপাধ্যায়। |
|
|
|
|
|