|
|
|
|
|
‘লাল ঝান্ডা’ বাঁচাতে
দলের হাতে ‘তিরঙ্গা’
প্রেমাংশু চৌধুরী • কোঝিকোড় |
|
এত দিন যাঁরা শুধুই চিন বা রাশিয়ায় বিপ্লবের কথা বলতেন, তাঁদের মুখে এ বার শোনা যাচ্ছে স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা। এত দিন যাঁদের মুখে শুধুই শোনা যেত মার্ক্স-লেনিন-স্তালিন-হো চি মিন-মাও জে দংয়ের কথা, তাঁদের মুখে এখন স্বামী বিবেকানন্দের মতো ভারতীয় ব্যক্তিত্বদের কথাও শোনা যাচ্ছে। শুধু সমাজতন্ত্রের তত্ত্বে নয়, সিপিএমের বহিরঙ্গেও ‘ভারতীয়করণ’ ঘটছে। ক্রমশ। অর্থাৎ, লাল ঝান্ডাকে বাঁচাতে তারা দ্বারস্থ হচ্ছে তিরঙ্গার।
কোঝিকোড় পার্টি কংগ্রেস সিপিএমের সেই ‘ভারতীয়করণ’-এরই জলজ্যান্ত উদাহরণ। আজ বিকেলে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মতাদর্শগত দলিল পেশ করে সীতারাম ইয়েচুরি বলেছেন, ভারতীয় বাস্তবতা মেনেই মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টিকে সমাজতন্ত্রের পথে হাঁটতে হবে। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, এই অবস্থানে কোনও ভুল নেই।
যে মঞ্চে দাঁড়িয়ে ইয়েচুরি এ কথা বলেছেন, সেই মঞ্চ সাজানো হয়েছে কোঝিকোড়ে টিপু সুলতানের তৈরি দুর্গের আদলে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়ে যে টিপু হয়ে উঠেছিলেন অন্যতম জাতীয়তাবাদী নায়ক। পার্টি কংগ্রেসের মঞ্চের এমন ‘ভারতীয় আদল’ এই প্রথম। কোঝিকোড়ের সাবেকি টাউন হলের উল্টো দিকে বিরাট তাঁবুতে চলছে ঐতিহাসিক প্রদর্শনী। সেখানে মার্ক্স-এঙ্গেলস-লেনিনরা রয়েছেন। অক্টোবর বিপ্লব, কমিউনিস্ট পার্টির ম্যানিফেস্টো, ইউরোপে শিল্পবিপ্লবের ফলে শ্রমিক শ্রেণির উপরে নিপীড়নের কাহিনিও রয়েছে। কিন্তু সেই সঙ্গেই অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরা হয়েছে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসকেও। |
|
কোঝিকোড়ের প্রদর্শনীতে তেরঙ্গা। ছবি: সন্দীপন চক্রবর্তী |
দলের নেতারা প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন, দলে ঘটা করে নভেম্বর বিপ্লবের বার্ষিকী-অনুষ্ঠান পালিত হয়। কিন্তু ১৫ অগস্ট স্বাধীনতা দিবস পালনের কোনও কর্মসূচি পার্টিতে নেই কেন? এক সময় কমিউনিস্টরা বলেছিলেন ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’। অনেক ভুল সংশোধনের মতো এই ভুলও পরে সংশোধন করা হয়। তা হলে স্বাধীনতা দিবস পালনে বাধা কোথায়? পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সম্মেলনেই হাওড়ার সিপিএম নেতা দিলীপ ঘোষের মতো ব্যক্তিরা এই প্রশ্ন তুলে দিয়েছিলেন। এ বার পার্টি কংগ্রেসেও সেই প্রশ্ন উঠেছে। আজ সন্ধ্যায় মতাদর্শগত দলিল নিয়ে বিতর্কে অংশ নিয়ে রাজ্যের নেতা মইনুল হাসান বলেছেন, মানুষের কাছে পৌঁছতে হলে ভারতীয় পৌরাণিক কাহিনি তুলে ধরে কথা বলতে হবে। ভারতীয় মানসে যাঁরা জননায়ক হিসেবে জায়গা করে নিয়েছেন, তাঁদের উদাহরণ তুলে ধরতে হবে। এ দেশের ইতিহাস, আদবকায়দা, স্বভাবচরিত্র মাথায় রাখতে হবে। মইনুলের ভাষায়, কোনও ‘অ্যাবস্ট্রাক্ট রেসিপি’-তে সাফল্য মিলবে না।
পার্টি কংগ্রেসের সূচনাতেই প্রকাশ কারাট জানিয়ে দিয়েছিলেন, সমাজতন্ত্রের জন্য আন্দোলনে তাঁরা কোনও বিদেশি মডেল অনুসরণ করছেন না। ভারতীয় প্রেক্ষাপট ও বাস্তবতা অনুযায়ী মার্ক্সবাদ ও লেনিনবাদের প্রয়োগেই তাঁরা বিশ্বাস করেন। সেই অনুযায়ীই কোঝিকোড়ের প্রদর্শনীতে লেনিন এবং তার পিছনে লাল ঝাণ্ডার মিছিলের সঙ্গেই রয়েছে তিরঙ্গা হাতে সত্যাগ্রহ আন্দোলনের ছবি। স্বাধীনতা সংগ্রামে কমিউনিস্টদের ভূমিকা, লালা লাজপত রাইয়ের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টির শ্রমিক সংগঠনের আন্দোলন তুলে ধরেছে সিপিএম।
শুধু পুঁজিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই নয়, অস্পৃশ্যতা, জাতপাতের মতো বিভিন্ন রকমের সামাজিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে এ দেশে যে আন্দোলন হয়েছে, তা-ও তুলে ধরা হয়েছে। প্রদর্শনীতে রয়েছেন স্বামী বিবেকানন্দও। যে মালাবার অঞ্চলে পার্টি কংগ্রেস বসেছে, সেখানেই অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন বিবেকানন্দ। আজ মইনুল বলেছেন, শতাব্দীপ্রাচীন এই দেশের ইতিহাসে ধর্মেরও যে বিরাট প্রভাব রয়েছে, সে কথাও মাথায় রাখতে হবে। দলের নেতারা মনে করছেন, ভারতে যে পরিমাণ দারিদ্র, জাতপাত ও ভেদাভেদ রয়েছে, সেখানে সিপিএম মহীরুহ হয়ে উঠতে পারত। কারণ, তাদের মূল লড়াইটাই এ সবের বিরুদ্ধে।
কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তারা পরিণত হয়েছে বনসাইতে।
আজ তাই চিন না রাশিয়া, লাতিন আমেরিকা না উত্তর কোরিয়া, কোনটা সমাজতন্ত্রের আদর্শ মডেল, সেই বিতর্ক থেকে ঠেলে বেরিয়ে ভারতীয় পথেই সমাজতন্ত্রের দিশা খুঁজতে চাইছে সিপিএম। আজ ও কাল পার্টি কংগ্রেসে সেই নিয়েই জোর বিতর্ক। |
|
|
|
|
|