|
|
|
|
|
বরদারাজনও ‘ব্রাত্য’,
ভুল মেনে নিলেন কারাট
সন্দীপন চক্রবর্তী • কোঝিকোড় |
|
টেগোর সেন্টিনারি হলে যাওয়ার পথে সিল্ক স্ট্রিটে ইয়াসের আরাফতের বড় অবয়ব। পুরসভার সেন্ট্রাল মার্কেটের সামনে মকবুল ফিদা হুসেনের হাসিমুখ বিরাট ফ্লেক্স জুড়ে। ‘হরকিষেণ সিংহ সুরজিৎ-জ্যোতি বসু নগর’ নামে অধুনা নামাঙ্কিত সেন্টিনারি হলের গোটা প্রাঙ্গন জুড়ে এ কে গোপালন, বি টি রণদিভে, পি সুন্দরাইয়া থেকে ই কে নায়নারের পোর্ট্রেট। পার্টি কংগ্রেসে পেশ-হওয়া ২৩ পাতার শোক প্রস্তাবে অস্ট্রেলিয়া ও সুদানের কমিউনিস্ট পার্টির প্রয়াত দুই সাধারণ সম্পাদক পিটার সাইমন, মহম্মদ ইব্রাহিম নুগুদের নাম। এমনকী, পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির জনৈক সদস্য মনসুর সঈদের নামও আছে। পশ্চিমবঙ্গের ‘বিদ্রোহী’ নেতা সুভাষ চক্রবর্তীকে নিয়েও কোনও সমস্যা নেই।
|
বরদারাজন |
কিন্তু বিংশতিতম পার্টি কংগ্রেস উপলক্ষে সুসজ্জিত কোঝিকোড়ের কোথাও স্মিতহাস্যময়, ঈষৎ কান-খাড়া ভদ্রলোকের নাম নেই। ছবি না-হয় নেই। কিন্তু আনুষ্ঠানিক শোক প্রস্তাবে তাঁর নামটা পর্যন্ত জায়গা পেল না? সিপিএম তা হলে ভুলেই গেল বিদায়ী কেন্দ্রীয় কমিটির প্রয়াত সদস্য ডব্লিউ আর বরদারাজনকে! জীবিত এবং ‘ঠিক পথে’ থাকলে এ বারের পার্টি কংগ্রেসে পলিটব্যুরোয় ঢোকার যিনি অন্যতম দাবিদার ছিলেন বলে দলের একাংশ এখনও মনে করে।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, ভুলে গিয়েই ‘ভুল’ করে বসেছে সিপিএম! সবিস্তার শোক প্রস্তাবে বরদারাজনের নাম নেই, এই তথ্য দলের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাটকে মনে করানো হয়েছে প্রস্তাব আনুষ্ঠানিক ভাবে পেশ হয়ে যাওয়ার পর! ‘ভুল’ বুঝতে পেরে কারাট অবশ্য নামটা প্রস্তাবে ঢুকিয়ে নিতে বলেছেন। আপাতত অধিবেশনে তা ‘নোট’ করে রাখা হয়েছে। কারাটের কথায়, “নজর এড়িয়ে গিয়েছিল। বরদারাজনের নাম পরে উল্লেখ করে নেওয়া হয়েছে।”
সকলের ‘নজর’ অবশ্য এড়ায়নি। ‘নৈতিক অধঃপতনে’র অভিযোগে ২০১০-এর ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতার বৈঠকে কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে ‘ডিমোট’ করা হয় সিটু নেতা বরদারাজনকে। বাদ দেওয়া হয় তামিলনাড়ু রাজ্য কমিটি থেকেও। তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের তদন্তে গঠিত দলীয় কমিটির মাথায় ছিলেন তাঁরই বন্ধু এবং চেন্নাইয়ে এক এলাকার বাসিন্দা এ কে পদ্মনাভন। অদৃষ্টের পরিহাস এমনই, সেই পদ্মনাভন পরবর্তী কালে সিটুর সর্বভারতীয় সভাপতি হন এবং কোঝিকোড় থেকেই সিটুর ‘কোটা’য় পলিটব্যুরোয় যাওয়ার প্রবল দাবিদার। মৃত্যুর পর ‘ব্রাত্য’ বন্ধুর কথা তাঁর মনে পড়ছে? ‘মিস্’ করছেন? পার্টি কংগ্রেস চলাকালীন প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে চাননি পদ্মনাভন। তবে ঘনিষ্ঠ মহলে তাঁর আক্ষেপ, “মনে থাকবে না? এক সঙ্গে এক কমিটি থেকে পার্টি করা শুরু করি। কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হলেও দক্ষিণ চেন্নাই জেলা কমিটিতে ওকে রেখে দেওয়া হয়। ওকে বুঝিয়েছিলাম, একটু সময় নিয়ে এই সঙ্কট থেকে উঠে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু ও তাড়াহুড়ো করে জীবনটাই শেষ করে দিল!”
কলকাতার কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে ফিরেই ‘নিখোঁজ’ হন বরদারাজন। চেন্নাইয়ের পেরিয়ার লেকে কয়েক দিন পরে তাঁর মৃতদেহ মেলে। আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন এক বিচ্যুত কমিউনিস্ট এ ভাবেই সিপিএমের ইতিহাসে উল্লিখিত সদালাপী বরদারাজন (দক্ষিণ ভারতের হাতে-গোনা নেতাদের এক জন, যিনি হিন্দি ও ইংরেজিতে একই রকম স্বচ্ছন্দ ছিলেন)। ডব্লিউ আরের মরদেহে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে আর এক বরদারাজন পলিটব্যুরোর সদস্য এবং কৃষক সভার নেতা কে বরদারাজন শোকাতুর গলায় বলে ফেলেছিলেন, ‘শুদ্ধকরণে’র এমন মাসুল মর্মান্তিক। দু’বছর পরে কে বরদারাজন আপাতত এই প্রশ্নে নীরব।
প্রয়াত বরদারাজনের বিরুদ্ধে মহিলা-ঘটিত স্খলনের অভিযোগ এসেছিল দলের ভিতর থেকেই। দলের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে অভিযোগ পৌঁছনোর পরে তদন্ত চালিয়ে ‘নৈতিক অধঃপতনে’র দায়ে তাঁকে শাস্তি দেওয়া হয়। সেই আঘাত সহ্য করতে না-পেরে কাউকে না-জানিয়ে কলকাতা থেকে চেন্নাই ফিরে নিখোঁজ হন বরদারজন। কলকাতা ছাড়ার পর থেকে দেহ উদ্ধারের মাঝের ঘটনা এখনও অজানা। দলের একাংশের ধারণা, দক্ষিণী সিপিএমে ‘অত্যন্ত প্রভাবশালী’ এক পরিবারের তিনজনকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে রাখা নিয়ে প্রশ্ন তুলে কোপে পড়তে হয়েছিল বরদারাজনকে। তারই জেরে অভিযোগের ফাঁস ঘিরে ধরেছিল তাঁকে।
ঘটনাচক্রে, সিপিএমের এ বারের রাজনৈতিক-সাংগঠনিক রিপোর্টে উঠে এসেছে মাদকাসক্তি, অবৈধ যৌন সম্পর্ক, সাইবার ক্রাইম, আয় বহির্ভুত সম্পত্তির মতো ‘বুর্জোয়া বিচ্যুতি’ দলের একাংশে বাসা বেঁধেছে! এই বন্ধনীর মধ্যে কি দলের বিশেষ কারও প্রতি ঘুরপথে ইঙ্গিত রইল? কারাট বলছেন, “ওটা নিয়ে চাঞ্চল্য তৈরি অর্থহীন। কী কী ক্ষেত্রে গত চার বছরে দলে শৃঙ্খলাজনিত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সেগুলোই উল্লেখ করা হয়েছে। তার মানে এই নয় যে, পার্টিটাই মাদকাসক্তের হয়ে গিয়েছে!” |
|
|
|
|
|