|
|
|
|
পড়ল বিরুদ্ধ ভোট |
|
আঞ্চলিক দলের সঙ্গী হয়ে
লাভ কী, প্রশ্ন সিপিএমে প্রেমাংশু চৌধুরী • কোঝিকোড় |
|
চিরাচরিত টানাপোড়েনের আপাতত অবসান। নতুন বিতর্কের সূচনা। সাক্ষী রইল কোঝিকোড়।
সিপিএমের সামনে এত দিন সব থেকে বড় টানাপোড়েনের বিষয় ছিল, কংগ্রেস না বিজেপি, কে বড় শত্রু! কিন্তু সিপিএমের এখন স্পষ্ট অবস্থান হল, কংগ্রেস বা বিজেপির মধ্যে কোনও ফারাক নেই। আর্থিক উদারনীতির প্রশ্নে দুই দলই সমান। এর বদলে বিশতম পার্টি কংগ্রেসে উঠে এসেছে নতুন প্রশ্ন। তা হল, অ-কংগ্রেসি, অ-বিজেপি দলগুলির সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতায় গিয়ে রাজ্যে রাজ্যে দলের ক্ষতি হচ্ছে, নাকি লাভ হচ্ছে! পার্টি কংগ্রেসে রাজনৈতিক প্রস্তাবের খসড়া নিয়ে বিতর্কে অন্ধ্রের প্রতিনিধিরা প্রশ্ন তুলেছেন, এক দিকে যখন নিজস্ব শক্তি বাড়িয়ে তোলাটাকেই ধরে নেওয়া হচ্ছে দলের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য হিসেবে, তখন আবার আঞ্চলিক দলগুলির সঙ্গে হাত মেলানোর কথা বলার প্রয়োজন কোথায়? তাঁদের যুক্তি, অতীতে এ ভাবেই আঞ্চলিক দলগুলির কাছে জমি খুইয়েছে বাম দলগুলি। অন্ধ্রের পাশাপাশি মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু থেকেও একই প্রশ্ন ওঠে।
পরিস্থিতি সামলাতে আজ খোদ প্রকাশ কারাটকে আসরে নামতে হয়েছে। রাজনৈতিক প্রস্তাবের খসড়ায় জবাবি বক্তৃতায় তিনি বলেছেন, নিজেদের শক্তি বাড়ানো আর আঞ্চলিক দলগুলির সঙ্গে হাত মেলানোর মধ্যে কোনও স্ববিরোধ নেই। নিজের শক্তি বাড়াতে হলে অনেক বেশি মানুষকে সিপিএমের নীতি ও আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট করতে হবে। তাই ‘বাম ও গণতান্ত্রিক বিকল্প’ গড়ে তোলার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু এটা কোনও নির্বাচনী সমঝোতা নয়। আমজনতার বিষয় নিয়ে, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো রক্ষায় বা ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রাখতে আঞ্চলিক দলগুলির সঙ্গে হাত মিলিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলা হতে পারে। সংসদেও এদের সঙ্গে সমন্বয় করা হতে পারে। কিন্তু তাই বলেই এদের সকলের সঙ্গে সিপিএম নির্বাচনী সমঝোতায় যাবে, তা নয়। যখন যেমন প্রয়োজন পড়বে, সেই অনুযায়ী আসন সমঝোতা হবে। জাতীয় স্তরেই হোক বা রাজ্য স্তরে।
এত ব্যাখ্যাতেও অবশ্য অন্ধ্রের দুই নেতাকে সন্তুষ্ট করা যায়নি। তাঁরা নিজেদের সংশোধনীতে ভোটাভুটি দাবি করেছেন। সেখানে হেরে গেলেও রাজনৈতিক প্রস্তাব পাশের সময় তাঁরা বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন। পলিটব্যুরো নেত্রী বৃন্দা কারাট অবশ্য বলছেন, ঐকমত্যের ভিত্তিতেই রাজনৈতিক প্রস্তাব পাশ হয়েছে। তাঁর যুক্তি, “পার্টি কংগ্রেসে আটশোর কাছাকাছি প্রতিনিধি এসেছেন। মাত্র দু’জন বাদে সকলেই প্রস্তাব পাশের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। একে তাই ঐকমত্যই বলা উচিত।” তবে দলের একাংশ বলছে, দলিলের উপরে ভোটাভুটি নিয়ে এই রকম ঘটনা সাম্প্রতিক কয়েকটি পার্টি কংগ্রেসে অন্তত ঘটেনি।
সিপিএম প্রথম থেকেই ‘জমিদারদের দল’ হিসেবে কংগ্রেসকে ‘বুর্জোয়া’ বলে অভিহিত করে এসেছে। ১৯৮৮ সালে তিরুঅনন্তপুরমে ত্রয়োদশ পার্টি কংগ্রেসে তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ প্রথম কংগ্রেসের পাশাপাশি বিজেপিকেও বিপদ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের নেতারা অবশ্য প্রথমে বিজেপিকে সমান বিপদ বলে কংগ্রেস-বিরোধিতার লাইন লঘু করতে চাননি। কারণ পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি-র কোনও শক্তি ছিল না। পরে বিজেপির উত্থানের পরে তাদের প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে সিপিএম। ২০০৪ সালে বিজেপিকে কেন্দ্রের ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতেই কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত নেয় সিপিএম। এক সময় যাঁরা
কংগ্রেস বিরোধিতাকে লঘু করতে চাননি, সেই পশ্চিমবঙ্গের নেতারাই আবার সমর্থন প্রত্যাহার না করে কংগ্রেসকে সঙ্গে নিয়ে চলার পক্ষপাতী ছিলেন। দ্বিতীয় ইউপিএ-সরকারের জমানায় সংসদের ভিতরে-বাইরে কংগ্রেসের বিরোধিতায় বিজেপির সঙ্গে কতটা সমন্বয় রাখা হবে, বা আদৌ রাখা হবে কি না, তা নিয়ে বারবার দ্বিধার মধ্যে পড়েছেন প্রকাশ কারাট-সীতারাম ইয়েচুরিরা।
এখন দলের মধ্যে নতুন বিতর্ক শুরু হয়েছে আঞ্চলিক দলগুলির সঙ্গে হাত মেলানো নিয়ে। বর্তমানে সিপিএমের একটা বড় অংশের মত হল, হরকিষেণ সিংহ সুরজিতের আমলে বিহারে আরজেডি বা অসমে অসম গণ পরিষদের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতায় গিয়ে দলের ক্ষতি হয়েছে। কারণ, ওই সব রাজ্যে ওই দলগুলি শক্তিশালী। কাজেই তাদের ঠিক করে দেওয়া আসনে, তাদেরই পছন্দের প্রার্থী খাড়া করতে হয়েছে। মাঝখান থেকে যেখানে সিপিএমের জনসমর্থন ছিল, তাতে ভাগ বসিয়েছে ওই আঞ্চলিক দলগুলি। পৃথক সত্তা টিকিয়ে রাখতে পারেনি সিপিএম। অন্ধ্রের নেতারা এই একই কারণে তেলুগু দেশমের সঙ্গে গত বিধানসভা নির্বাচনে আসন সমঝোতায় যেতে চাননি। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বেরও একই মত। কিন্তু তাঁরা বলছেন, সিপিএমের নিজস্ব শক্তি যে হেতু এখন বিশেষ নেই, তাই কংগ্রেস বা বিজেপির বিরুদ্ধে বিষয়ভিত্তিক আন্দোলনে এই দলগুলিকে সঙ্গে নিতেই হবে। কিন্তু এর সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতার কোনও সম্পর্ক নেই। এর মধ্যে যে সব বিষয়ে সিপিএম আন্দোলন গড়ে তুলতে চায়, সেই খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগ বা কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক নিয়ে তৃণমূলও সরব। তারাও আঞ্চলিক দলগুলির সঙ্গে সমন্বয় রক্ষা করে চলছে, যেটা বিকল্প গড়ে তোলার ইঙ্গিতবাহী। তা হলে কি প্রয়োজনে জাতীয় স্তরে তৃণমূলের সঙ্গে বিষয়ভিত্তিক সমন্বয়ে যেতে তৈরি সিপিএম? বৃন্দা কারাটের জবাব, “এ কথা কেউ ভাবতেও পারে না। তৃণমূল তো কংগ্রেস থেকেই ভেঙে বেরিয়ে আসা দল। ওরা ন্যূনতম গণতন্ত্রেও বিশ্বাস করে না। ওরা নাগরিক অধিকারের উপর হামলা করছে।” |
|
|
|
|
|