|
|
|
|
পরমাণু প্রশ্নে সিদ্ধান্ত ঠিক, সময় ভুল |
|
সেই বাংলার ঘাড়ে
দায় চাপালেন কারাট
সন্দীপন চক্রবর্তী • কোঝিকোড় |
|
দলের অন্দরে প্রকারান্তরে ‘ভুল’ স্বীকার করে নিলেন প্রকাশ কারাট। আবার একই সঙ্গে সুকৌশলে সেই ভুলের ‘দায়’ তিনি দিয়ে রাখলেন পশ্চিমবঙ্গের ঘাড়ে!
পরমাণু চুক্তির প্রশ্নে ইউপিএ-১ সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের ঘটনাকে ঘিরে সিপিএমের অন্দরে যে বিতর্ক চালু ছিল, পার্টি কংগ্রেসের মতো সর্বোচ্চ মঞ্চ থেকেই তাতে যবনিকা ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন কারাট। পরমাণু চুক্তিতে সমর্থন তুলে নেওয়ার মধ্যে কোনও ভুল ছিল না, এই ‘লাইনে’ই সিলমোহর আদায় হল পার্টি কংগ্রেসে। কিন্তু তারই পাশাপাশি সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক বললেন, সমর্থন প্রত্যাহারের সময় নির্বাচনে ‘ভুল’ হয়েছিল। আরও আগেই সমর্থন তুলে নেওয়া উচিত ছিল। পশ্চিমবঙ্গে সেই সময় পঞ্চায়েত নির্বাচন ছিল বলেই তাঁরা অপেক্ষা করেছিলেন। যদিও সেই অপেক্ষা করতে গিয়ে কোনও দিক থেকেই সিপিএমের ‘লাভ’ হয়নি।
দলীয় সূত্রের খবর, কারাটের ব্যাখ্যায় মার্ক্সীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পরমাণু চুক্তি নিয়ে সমর্থন প্রত্যাহার একেবারে ‘সঠিক’ সিদ্ধান্ত। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, প্রত্যাহারের সময় ঠিক ছিল না। কেন্দ্রীয় সরকারকে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ) পর্যন্ত যেতে দেওয়া ঠিক হয়নি। বিলম্বের ব্যাখ্যায় কারাট বলেছেন, বেশি অপেক্ষা না-করে সমর্থন তুলে নেওয়া হবে বলেই প্রাথমিক ভাবে ঠিক ছিল। কিন্তু ২০০৭-এর ২৯ সেপ্টেম্বর পলিটব্যুরো ও তার পরে কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে মনোভাব বদল করা হয়। কারণ, পশ্চিমবঙ্গে ২০০৮-এর পঞ্চায়েত ভোট তখন আসন্ন। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের পর সেই ভোটে দলের ফল নিয়ে উদ্বেগ ছিল। কেন্দ্রে সমর্থন তুলে নিলে পাছে সরকার পড়ে গিয়ে লোকসভা ভোট পঞ্চায়েতের আগেই চলে আসে এবং তাতে দলের হাল বিপন্ন হয় পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতির প্রেক্ষিতেই তখন কেন্দ্রীয় কমিটির হাত-পা বাঁধা হয়ে গিয়েছিল। অথচ ভোট হওয়ার পর দেখা গেল, শেষ পর্যন্ত কোনও কিছুতেই কোনও লাভ হয়নি!
সিপিএমেরই একাংশের ব্যাখ্যা, রাজনীতিতে ‘সময়জ্ঞান’টাই আসল। কোন সময়ে কোন সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তা ঠিক করতে ভুল হলে তার মাসুল গোনা অবধারিত। কেন্দ্রীয় সরকারের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের মতো গুরুতর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ‘সময়’ ভুল করা মানে প্রকারান্তরে ‘ভুল’ই স্বীকার করা এমনই বক্তব্য দলের ওই অংশের। কারাট অবশ্য অধিবেশনের রুদ্ধদ্বার কক্ষে খসড়া রাজনৈতিক দলিল ও রাজনৈতিক পর্যালোচনা রিপোর্ট নিয়ে বিতর্কের জবাবি ভাষণে শুক্রবার বলেছেন, যাবতীয় সিদ্ধান্তের দায়ই দলে ‘যৌথ ভাবে’ নিতে হবে।
সময়-ঘটিত ‘ভুল’ কবুল করতে গিয়ে দু’টি ‘চাল’ চেলেছেন সাধারণ সম্পাদক।
প্রথমত, পরমাণু চুক্তি নিয়ে কেন্দ্রে ইউপিএ সরকারের উপর থেকে সমর্থন তুলে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস-তৃণমূলের জোটের রাস্তা প্রশস্ত (যার জেরে বামেদের লাগাতার নির্বাচনী ভরাডুবি) করে দেওয়া হয়েছিল কেন, সে প্রশ্ন বারেবারে তুলেছে বঙ্গ ব্রিগেড। প্রায় দু’বছর আগে বিজয়ওয়াড়ায় কেন্দ্রীয় কমিটির বর্ধিত অধিবেশনে আমেরিকার সঙ্গে পরমাণু চুক্তির প্রশ্নে ইউপিএ-র উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে কমিউনিস্টরা ভুল কিছু করেনি বলে মতেরই পক্ষে ‘অনুমোদন’ আদায় করেছিলেন কারাট। এ বার কোঝিকোড়ে একধাপ এগিয়ে কার্যত বঙ্গ ব্রিগেডের অস্ত্রেই তাদের ঘায়েল করার চেষ্টা করেছেন তিনি! বলেছেন, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম উত্তর পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে ‘উদ্বেগে’র জন্যই কেন্দ্রে সমর্থন প্রত্যাহার করতে ‘দেরি’ হয়েছিল।
দ্বিতীয়ত, পরমাণু চুক্তির বদলে মূল্যবৃদ্ধির মতো জনগণের ‘বোধগম্য’ বিষয়ে সমর্থন তুললে মানুষের মন পাওয়া যেত বলে দলের একাংশের মত ছিল। কিন্তু সিপিএম সূত্রের খবর, আজ জবাবি ভাষণে কারাট বলেছেন, তাতে কোনও লাভ হত না। মূল্যবৃদ্ধি খুবই ‘জনপ্রিয়’ বিষয়। কিন্তু এ-ও ঠিক যে, ‘বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থা’য় মূল্যবৃদ্ধির সমস্যা লেগেই ছিল এবং আছে। মূল্যবদ্ধির সমস্যা সত্ত্বেও ২০০৯-এর লোকসভায় কংগ্রেস ভাল ফল করেছিল। বামেরা ফায়দা তুলতে পারেনি। মূল্যবৃদ্ধির মতো ‘নিয়মিত’ ঘটনায় সমর্থন তুললে বরং মনে হত, সম্পর্কচ্ছেদের জন্য একটা ‘অজুহাত’ খাড়া করা হল! অর্থাৎ দ্বিতীয় মতও খারিজ করেছেন সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক।
আরও একটি ক্ষেত্রে আলিমুদ্দিনকে এক হাত নিয়েছেন কারাট। রাজনৈতিক দলিল ও পর্যালোচনা রিপোর্ট নিয়ে আলোচনায় পার্টি কংগ্রেসের প্রতিনিধিদের একাংশের প্রশ্ন ছিল, বিভিন্ন রাজ্যে দল ও সরকারের উপরে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নজরদারি কেন ছিল না? জবাবে আজ কারাট বলেছেন, কেন্দ্রীয় ও রাজ্য নেতৃত্ব আলোচনা করেই চলে। তবে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে সালিম গোষ্ঠীর সঙ্গে চুক্তি করতে না-এগোনোর জন্য দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীকে চিঠি পাঠিয়েছিল পলিটব্যুরো। কিন্তু ওই ‘হস্তক্ষেপে’ দেরি হয়ে গিয়েছিল। সালিমদের নিয়ে রাজ্যকে পলিটব্যুরোর চিঠি পাঠানোর কথা এর আগে আলিমুদ্দিনে বসে রাজ্য কমিটির বৈঠকেও বলে গিয়েছেন কারাট। কিন্তু পার্টি কংগ্রেসের মঞ্চে তা নথিভুক্ত করানোর ভিন্ন ‘তাৎপর্য’ আছে সিপিএম রাজনীতিতে।
আপাতত কি তাঁরা মনে করছেন, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মতেই দলের সিলমোহর পড়ল? কারাট-ঘরণী তথা পলিটব্যুরো সদস্য বৃন্দা কারাটের বক্তব্য, “কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নয়, সিদ্ধান্ত ছিল কেন্দ্রীয় কমিটির।” পরমাণু চুক্তি-বিতর্ক কি এর পরে ‘ক্লোজ্ড চ্যাপ্টার’? বৃন্দার মত, “এ নিয়ে অনেক বিতর্কের কথা বলা হয়েছে, লেখা হয়েছে। বিজয়ওয়াড়ায় বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়েছিল। এখন পার্টি কংগ্রেসেও হল। এ বার ‘ক্লোজ্ড চ্যাপ্টার’ বলা হবে কি না, আপনারাই ঠিক করবেন!”
কারাট-দম্পতি চান, যবনিকা পাকাপাকিই নামুক! |
|
|
|
|
|