পঞ্চায়েত ভোটের আগে ১০০ দিনের কাজে ‘হাফ-সেঞ্চুরি’ করতে চায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার।
আগের বামফ্রন্ট সরকার যা পারেনি, তা তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকার করতে পেরেছে বলে ‘প্রচার’ করে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ভোটে ‘ঝড় তোলার’ তোড়জোড় শুরু হয়েছে তৃণমূলে। দলের নেতা ও রাজ্যের পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “বামফ্রন্ট আমলে ১০০ দিনের কাজে বছরে গড় ছিল ১৯ দিন। সেই গড় মার্চেই পৌঁছে দিয়েছি ৩২ দিনে। লক্ষ্য এই গড় ৫০ দিনে পৌঁছে দেওয়া।”
কাজটা কঠিন। সে কথা জানেন পঞ্চায়েত মন্ত্রীও। তাই একইসঙ্গে ঘনিষ্ঠমহলে তিনি বলছেন, “৪০ দিনে পৌঁছোলেই পুজো দেব। তারপর বাকি আর দশ!”
সুব্রতবাবু জানান, পঞ্চাশের লক্ষ্যে পৌঁছতে তাঁরা ইতিমধ্যেই কয়েকটি কর্মসূচি নিয়েছেন। আগে ১০০ দিনের কাজে একজনকে ৯৯ ঘনফুট মাটি কাটতে হত। তা কমিয়ে ৬৯ ঘনফুট করা হয়েছে। আগে একদিন কাজ করে ১০-১২দিন অপেক্ষার পরে আবার একদিন কাজ মিলত। এখন এক লপ্তে টানা ১৪ দিন কাজ দেওয়া হচ্ছে। মজুরিও বৃদ্ধি হয়েছে। আগে মজুরি পেতে ১৫-১৬ দিন সময় লাগত। এখন দিনের দিন মজুরি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
রাজ্যে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ভোটের আর বেশি দেরি নেই। তার আগেই ৫০ দিনের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছনো মানে গ্রামীণ অর্থনীতির ‘সার্বিক উন্নয়ন’ বলে মনে করেন পঞ্চায়েত দফতরের এক আধিকারিক। তাঁর ব্যাখ্যায়, “৫০ দিন কাজ করা মানে গ্রামের মানুষের কর্মসংস্থানের অনেকটাই যেমন সুরাহা হবে, তেমনই গ্রামের সমাজিক পরিস্থিতি ও অর্থনীতিরও উন্নতি হবে। আগের সরকারের আমলে কী হয়েছিল, তার তুলনা বর্তমান সরকারের প্রতিনিধিরা টানতে পারবেন।” তৃণমূলের এক নেতার কথায়, “১০০ দিনের কাজে হাফ সেঞ্চুরিতেই কাত করতে হবে বিরোধীদের।”
তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশের অভিমত, মুখ্যমন্ত্রী তথা দলনেত্রী মমতা তাঁদের স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, রাজ্যের দ্রুত উন্নয়নে সরকার ও জেলা প্রশাসনের কাজে ‘সমন্বয়’ থাকা প্রয়োজন। বর্তমানে চারটি জেলা বাদ দিলে বাকি ১৫টি জেলা পরিষদ বিরোধীদের হাতে। ফলে রাজ্যের সামগ্রিক উন্নয়নের কাজ ‘একই ছন্দে’ চলছে না। ইতিমধ্যেই মুর্শিদাবাদ, উত্তর ২৪ পরগনা ও নদিয়া জেলা পরিষদের শাসক বামফ্রন্ট সংখ্যালঘু হয়ে পড়ায় উন্নয়নের কাজ ‘ব্যাহত’ হচ্ছে জানিয়ে ওই তিন জেলা পরিষদের আর্থিক দায়দায়িত্ব জেলাশাসকের হাতে তুলে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন সুব্রতবাবু।
বিষয়টি নিয়ে রাজ্য-রাজনীতিতে ব্যাপক বিতর্কও শুরু হয়েছে। তৃণমূলের অন্দরের খবর, দলনেত্রী পঞ্চায়েত ভোটে দায়িত্বপ্রাপ্ত জেলা নেতাদের অনেককেই বলেছেন, ১৯টি জেলা পরিষদের প্রত্যেকটিই শাসকদলের হাতে থাকা দরকার। কথাটা ‘যৌক্তিক’ বলে মনে করেন সুব্রতবাবুও। তিনি বলেন, “রাজ্যে যে দল সরকার চালাচ্ছে, সেই একই দলের হাতে জেলা পরিষদের ক্ষমতা থাকা ভাল। কারণ পরিকল্পনা নির্ধারণ এবং তা রূপায়ণের ক্ষেত্রে সরকার ও জেলা পরিষদের মধ্যে সামঞ্জস্য থাকা জরুরি।”
পঞ্চায়েত ভোটে জোট নিয়ে কংগ্রেস-তৃণমূলে ইতিমধ্যেই টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। দুই শিবিরের নেতারাই জানেন, গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতিতে ‘ক্ষমতা’ দখল করতে রাজনৈতিক প্রভাবের থেকেও ‘স্থানীয় বিষয়’ প্রাধান্য পায়। অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গিয়েছে, দলীয় নির্দেশের তোয়াক্কা না-করে পঞ্চায়েতের নিচের তলায় কংগ্রেস-তৃণমূল এমনকী, বিরোধী-শাসক জোটও হয়ে থাকে। কিন্তু পঞ্চায়েতের সর্বোচ্চ স্তর জেলা পরিষদে পুরোদস্তুর ‘নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি’ থেকেই ভোট হয়। সেই কারণেই জেলার সামগ্রিক ও সার্বিক ‘উন্নয়ন’ দ্রুততার সঙ্গে করে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ভোটে সাফল্য পেতে মরিয়া তৃণমূল।
সেই ‘সাফল্য’ পেতে ১০০ দিনের কাজে পঞ্চাশের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছনোকেই ‘পাখির চোখে’ করেছে মমতা-সরকার। এমন ভাবে ১০০ দিনের কাজ করানো হচ্ছে, যাতে গ্রামের সার্বিক উন্নয়ন হয়। পুকুর কাটানো, জল সংরক্ষণ, গ্রামীণ রাস্তা নির্মাণ, বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার মতো রুক্ষ্ম এলাকায় ক্ষুদ্র সেচের ব্যবস্থা, বনসৃজনের কাজকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। তাতেও থেমে না-থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি রাজ্য সরকার কতটা ‘সহানূভূতিশীল’, তা-ও প্রচার করা হবে। মমতা-ঘনিষ্ঠ এক মন্ত্রী জানাচ্ছেন, সেই প্রচারে রাজ্য জুড়ে ইমামদের মাসিক সাম্মানিক দেওয়া থেকে শুরু করে চার লক্ষ সংখ্যালঘুদের বৃত্তি দান ইত্যাদি বিষয়ও থাকবে। মুসলিম অধ্যুষিত জেলাগুলিতে ‘৫০ দিন কাজ’ ও সংখ্যালঘু উন্নয়নে সরকারের প্রচেষ্টা পঞ্চায়েত ভোটে ‘জোড়া ফলা’র কাজ করবে বলেই ওই মন্ত্রীর দাবি। |