রাজ্যের পুলিশ কর্তাদের বদলি নিয়ে সমালোচনার রাস্তায় হাঁটল না সিপিএম।
কোনও কোনও মহলে এ নিয়ে বিতর্ক তোলার চেষ্টা হলেও, দময়ন্তী সেন কিংবা অন্য পুলিশ কর্তাদের বদলি নিয়ে সিপিএম কিন্তু মোটেই আক্রমণাত্মক নয়। রাজনৈতিক শিবিরের একাংশের মতে, বাম জমানাতেও পুলিশকর্তা তথা আমলাদের রাজনৈতিক কারণে বদলির অভিযোগ উঠেছে। তাই সিপিএম পুলিশের বদলি নিয়ে সমালোচনায় গিয়ে সেই সব পুরনো ঘটনা সামনে আনতে দিতে চাইছে না।
তবে দময়ন্তী সেনের বদলি নিয়ে যে বিতর্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে তা অযৌক্তিক বলেই মনে করছেন পুলিশ কর্তাদের একটি অংশ। তাঁদের মতে, ১৯৯৬ ব্যাচের ওই আইপিএস অফিসার ২০০৪ সাল থেকেই কলকাতা পুলিশে রয়েছেন। গত আট বছরে ডিসি (ডিডি, স্পেশাল), ডিসি (নর্থ), ডিসি (সেন্ট্রাল), ডিসি (ডিডি) থেকে শুরু করে যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ দমন)-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ সব পদে থেকেছেন দময়ন্তী। তাঁকে অনেক আগেই লালবাজার থেকে সরানো যেত। লালবাজারে বস্তুতপক্ষে অতিরিক্ত ইনিংস খেলছিলেন তিনি।
কিন্তু পার্ক স্ট্রিট-কাণ্ডের পরে দময়ন্তীর বদলি হওয়াতেই পুলিশের বড় অংশে কিছু প্রশ্ন উঠছে। ধর্ষণের ওই ঘটনার তদন্তের প্রাথমিক-পর্বে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দময়ন্তীর ‘মতভেদ’ ইতিমধ্যে সবার জানা। মুখ্যমন্ত্রী ‘সাজানো ঘটনা’ বলা সত্ত্বেও তদন্তে অটল থাকেন দময়ন্তী। তাঁর নেতৃত্বেই তিন জন অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা বিভাগের পুলিশ। কোনও কোনও পুলিশকর্তার প্রশ্ন, এই কারণেই কি দময়ন্তীকে রাজ্য পুলিশের কোনও গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হল না? কোনও গুরুত্বপূর্ণ পদে বসালেই কি তাঁর দক্ষতার প্রতি সুবিচার করা হত না? |
|
|
|
দময়ন্তী সেন |
বিশ্বরূপ ঘোষ |
প্রণব কুমার |
|
ডিআইজি (প্রশিক্ষণ)-এর পদটিকে কম গুরুত্বপূর্ণ বলে মানতে কিন্তু নারাজ কয়েক জন পুলিশকর্তা। এক পুলিশ কর্তার মন্তব্য, “অফিসার দক্ষ হলে যে কোনও দায়িত্বই তিনি সামলাতে পারবেন। কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে সফল হয়েছেন। নতুন পদেও তাঁর অনেক কিছু করে দেখানোর অবকাশ রয়েছে।” বদলির নির্দেশ প্রকাশিত হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বুধবার সন্ধ্যায় তাঁর উত্তরসূরী পল্লবকান্তি ঘোষকে তাঁর ‘দায়িত্ব’ বুঝিয়ে দেন।
রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনও দময়ন্তী সেনকে বদলির পিছনে কোনও অভিসন্ধি আছে বলে মানতে চাননি। ধর্ষণের মতো কোনও ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে তদন্তকারী পুলিশকর্তার বক্তব্যের ফারাক হলে সংশ্লিষ্ট অফিসারকে কি শাস্তি পেতে হবে? জবাবে রাজ্যপাল বলেন, “এই রকম কোনও মতপার্থক্য মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কারও হয়নি। উভয়েই এক কথা বলেছেন।”
তবে পুলিশ কর্তাদের একাংশ দুই বিদায়ী পুলিশ কর্তা কলকাতা পুলিশের ডিসি (সাউথ সুবারবান) বিশ্বরূপ ঘোষ এবং বাঁকুড়ার এসপি প্রণব কুমারের বদলি নিয়ে যৌক্তিকতার প্রশ্ন তুলেছেন। প্রণব কুমার তবুও দেড় বছর বাঁকুড়ার এসপি পদে ছিলেন। কিন্তু বিশ্বরূপবাবুকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে সাত মাসের মধ্যে। বিশ্বরূপ ঘোষের ক্ষেত্রে গাঙ্গুলিবাগানে সাংবাদিক-নিগ্রহের ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রীর অবস্থানের উল্টো পথে হেঁটে তদন্ত করে দোষীদের চিহ্নিত করেছিলেন বলে খবর। বিশ্বরূপবাবু গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বাম ট্রেড ইউনিয়নগুলির ডাকা ধর্মঘটের দিন সাংবাদিক নিগ্রহ নিয়ে কলকাতা পুলিশের এক কনস্টেবলের বিরুদ্ধে রিপোর্ট দেন। তৃণমূল সমর্থক ওই কনস্টেবলকে সাসপেন্ড করা হয়।
অন্য দিকে, তালড্যাংরার সিপিএমের বিধায়ক মনোরঞ্জন পাত্রকে পুলিশি হেফাজতে রাখার সময়ে ‘খাতির’ করার ঘটনায় বাঁকুড়ার এসপি-র নাম জড়িয়েছে। প্রাক্তন বিধায়ককে পুলিশ লাইনের অতিথি নিবাস’-এ রাখা হয়েছিল। এসপি অবশ্য ওই সময়ে ছুটিতে ছিলেন। এ ছাড়া, বাঁকুড়ার সরকারি হাসপাতালে মূক-বধির তরুণীকে ধর্ষণের ঘটনায় স্বাস্থ্যকর্তারা সংশয় প্রকাশ করলেও অভিযুক্তকে শাস্তি দিতে ‘সক্রিয়’ হয়েছিলেন এসপি।
বৃহস্পতিবার দময়ন্তী ব্যারাকপুরে ডিআইজি (প্রশিক্ষণ)-এর পদে তাঁর নতুন ভূমিকায় দায়িত্বভার গ্রহণের দিনেই কেরলের কোঝিকোড়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছেন, “পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী যে কোনও ঘটনাকেই প্রথমে সাজানো বলেন। পার্ক স্ট্রিটের ক্ষেত্রেও তা-ই করেছিলেন। এক জন সিনিয়র আইপিএস অফিসার তদন্ত করে সঠিক ঘটনা বার করার পরে তাঁকে বদলি করা হয়েছে। ইন্টারনেট থেকে এ দিন তেমনই জেনেছি।” অর্থাৎ, পার্ক স্ট্রিটের তদন্ত-পর্বে মুখ্যমন্ত্রীর বিতর্কিত মন্তব্যটি ফের মনে করিয়ে দিলেও বদলির ‘যৌক্তিকতা’ নিয়ে সূর্যবাবু কোনও ব্যাখ্যায় যাননি।
সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্যও মানছেন, তাঁদের জমানাতেও আমলাদের সঙ্গে দলের কিছু সমস্যা হয়েছিল। যেমন, নন্দীগ্রাম-পর্বে খোদ স্বরাষ্ট্রসচিব প্রসাদরঞ্জন রায়ের ‘পরিণতি’ই এখনও অনেকের স্মৃতিতে টাটকা। নন্দীগ্রাম-পর্বে সিপিএম-অধ্যুষিত খেজুরি থেকেই প্রথম আক্রমণ হচ্ছে, বলে নিয়মিত মন্তব্য করে তৎকালীন শাসক দলের রোষে পড়তে হয়েছিল তদানীন্তন স্বরাষ্ট্র সচিব প্রসাদরঞ্জন রায়কে। সিপিএমের রাজ্য সম্মেলনেও স্বরাষ্ট্রসচিবের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। শেষ পর্যন্ত স্বরাষ্ট্রসচিবের পদ থেকে সরিয়ে উচ্চশিক্ষা দফতরের সচিব করা হয় প্রসাদবাবুকে। এ যাত্রা দময়ন্তীর বদলির অনুষঙ্গেও বাম জমানায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আমলের এই দৃষ্টান্তটিই ফের উঠে আসছে।
পার্ক স্ট্রিটের ঘটনায় সিপিএম আক্রমণাত্মক হলেও এ ক্ষেত্রে কেন নয় তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির ওই সদস্য। তাঁর মতে, পার্ক স্ট্রিটের ঘটনাটির সঙ্গে নন্দীগ্রাম-পর্বে স্বরাষ্ট্রসচিবকে সরানোর বিষয়টি এক করে দেখা ঠিক নয়। তাঁর কথায়, “তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গেও কিছু ক্ষেত্রে দলের কারও কারও মতের ফারাক দেখা দিয়েছিল। তবে তার বেশির ভাগই ছিল দলের সঙ্গে প্রশাসনের বিরোধ। নন্দীগ্রামে স্বরাষ্ট্রসচিবের ঘটনাটা যেমন। কিন্তু পার্ক স্ট্রিটের ঘটনার সঙ্গে রাজনীতির যোগ নেই। এখানে একেবারেই সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত।” |