নন্দীগ্রাম-সহ রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নেওয়ার সরকারি প্রক্রিয়ার কড়া বিরোধিতা করল প্রধান বিরোধীদল সিপিএম। বৃহস্পতিবার সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু এবং বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র দু’জনেই আলাদা আলাদা ভাবে বিষয়টি নিয়ে বলেছেন। বিমানবাবু যখন ওই প্রক্রিয়াকে রাজ্য প্রশাসনের ‘নিরপেক্ষতা’র পথে অন্তরায় বলে মনে করেছেন, তখন সূর্যবাবু জানিয়েছেন, এই ঘটনা ‘গণতন্ত্রের উপর আক্রমণ’। তাঁরা এর বিরুদ্ধে আইনি লড়াই লড়ার হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন।
সরকারের জোট শরিক কংগ্রেস এই বিষয়ে মন্তব্য এড়িয়ে গিয়েছে। প্রদেশ কংগ্রেস সূত্রের খবর, রাজ্যনেতারা চাইছেন বিষয়টি কোনদিকে গড়ায়, তা আগে দেখে নিতে। অবস্থা বুঝে তাঁরা মুখ খুলবেন।
পূর্ব মেদিনীপুর, হুগলি, বর্ধমান সহ রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় তৃণমূল নেতা-কর্মীদের উপর থেকে মামলা তুলে নেওয়ার প্রক্রিয়া যে শুরু হয়েছে, তা স্বীকার করেছেন আইনমন্ত্রী মলয় ঘটক। ওই মামলাগুলির মধ্যে খুন বা অস্ত্র-আইনের মতো জামিন অযোগ্য মামলাও রয়েছে। মলয়বাবুর দাবি, “ওই মামলাগুলি সমস্তই সাজানো এবং মিথ্যা। তাই রাজ্য সরকার মামলা প্রত্যাহারের আইনি প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
এদিন আনন্দবাজারে খবরটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই বিরোধী শিবিরে তোলপাড় শুরু হয়। সিপিএমের পার্টি কংগ্রেস উপলক্ষে দলের সমস্ত শীর্ষনেতাই আপাতত কেরলের কোঝিকোড়ে। সেখানেই বিরোধী দলনেতা সূর্যবাবু বলেন, “গণতন্ত্রের উপরে আক্রমণের তীব্রতা বাড়ছে। এটাও তার অঙ্গ। এক দিকে আমাদের নেতা-কর্মীদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হচ্ছে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য, অন্য দিকে আমাদের উপর আক্রমণকারীদের উপর থেকে মামলা তুলে নেওয়া হচ্ছে! অথচ তাদের মধ্যে খুনের আসামি রয়েছে, গুরুতর ঘটনার অপরাধীরা আছে। নন্দীগ্রাম থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গার মামলা এর মধ্যে রয়েছে।” সূর্যবাবুর হুঁশিয়ারি, “এখন বিধানসভা বন্ধ। বিধানসভার বাইরে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আমরা লড়ব, দরকারে আইনি লড়াইয়ের পথে যাব।” তৃণমূল-মাওবাদী জোটের হাতে গত কয়েক বছরে পাঁচশোর বেশি সিপিএম কর্মী-সমর্থকের খুন হওয়ার তথ্যও সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমের সামনে তুলে ধরেছেন সূর্যবাবু।
পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার প্রথম বার ক্ষমতায় এসে বন্দিদের মুক্তি দিয়েছিল। তা হলে এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা কেন? বিরোধী দলনেতার জবাব, “আমরা রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম এবং ক্ষমতায় এসে তা পালন করেছিলাম। আমাদের লোকেদের চেয়ে বেশি ছাড়া পেয়েছিল তারা, যারা আমাদের উপরে আক্রমণের ঘটনাতে অভিযুক্ত ছিল। নকশালরা ছাড়া পেয়েছিল। তফাত হচ্ছে, এখানে দল দেখে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে।” সূর্যবাবুর আরও মন্তব্য, “এই সব অপরাধীদের (যাদের ছাড়া হবে) যদি কোনও রাজনৈতিক দলের কর্মী বলে দাবি করা হয়, তা হলে বলতে হবে, সেটা অপরাধীদের দল!”
বিমানবাবুও এক বিবৃতিতে, ‘সিপিএম এবং বামফ্রন্টের শরিক দলের নেতা-কর্মীদের খুন, খুনের চেষ্টা এবং পরিবারের সদস্যদের আক্রমণ করার ঘটনায় যে সব অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা দায়ের করা
হয়েছিল, তা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়ে অবশ্যই অপরাধীদের অপরাধ করাকে আইনসঙ্গত করার প্রচেষ্টা চলছে’। বিমানবাবুর মতে, ‘এই রকম ঘটনা ঘটলে প্রশাসন নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করতে পারবে না। ফলশ্রুতিতে গণতন্ত্র এবং মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার আক্রান্ত হবে’।
সিপিএমের জেলার নেতারা মনে করছেন, এভাবে মামলা তুলে নেওয়ার পর অভিযোগকারী পাল্টা আক্রমণের শিকার হতে পারেন। বস্তুত, মামলা তুলে নেওয়ার প্রক্রিয়ার কথা জানাজানি হওয়া মাত্রই ওইসব মামলায় একাধিক অভিযোগকারী পাল্টা আক্রমণ বা হেনস্থার আশঙ্কায় জেলা নেতাদের দ্বারস্থ হয়েছেন। যেমন হুগলি এবং উত্তর ২৪ পরগনায় দু’টি খুনের ঘটনার ক্ষেত্রে মূল অভিযোগকারিনী হচ্ছেন মৃত ব্যক্তির স্ত্রী। তাঁদের আশঙ্কা, মামলা তুলে নেওয়ার পর যার বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করা হয়েছিল, সে তার দলবল প্রতিশোধ নিতে পাল্টা আঘাত করতে পারে।
সিপিএমের একাংশ রাজ্য সরকারের ওই পদক্ষেপের পিছনে ‘রাজনৈতিক কারণ’ দেখছে। তাদের মতে, পূর্ব মেদিনীপুর, হুগলি-সহ বিভিন্ন জেলায় তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য অপরাধে মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়ার অন্যতম কারণ পঞ্চায়েত ভোট। গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত থাকলে পঞ্চায়েত ভোটে প্রার্থী হওয়া কঠিন। কিন্তু মামলা তুলে নেওয়ার পর প্রার্থী হতে অসুবিধা থাকবে না। বরং অতীতে একাধিক মামলায় অভিযুক্তও ভোটের সময়ে ‘বুক ফুলিয়ে’ ঘুরবে। |