মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ বার সংবাদপত্র-বিতর্কে ‘প্রত্যাঘাত’ করলেন । তাঁর অভিযোগ, ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতার কারণে কিছু কিছু সংবাদপত্র ‘বিকৃত’ সংবাদ পরিবেশন করছে। তাঁর কথায়, “লক্ষ্মণের গণ্ডির একটা সীমারেখা থাকে। আমাদের প্রত্যেকেরই একটা গণ্ডি আছে। আমি আমার গণ্ডি অনুসরণ করে চলব। আপনারাও (সংবাদপত্র) আপনাদের গণ্ডিটা অনুসরণ করে চলুন!”
‘মা-মাটি-মানুষে’র সরকারের মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, “সংবাদমাধ্যমকে দেশের প্রতি, রাজ্যের প্রতি, মা-মাটি-মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে হবে!”
তবে মমতা জানিয়েছেন, ‘সমালোচনা’য় তাঁর আপত্তি নেই। তাঁর বক্তব্য, “ভুল করলে সমালোচনা করুন। ধরিয়ে দিন। কিন্তু কেউ যদি মনে করেন ব্ল্যাকমেলিং করে আমার মাথা নত করাবেন, আমি তাঁদের বলছি, আমাকে তা করাতে পারবেন না!” এক ধাপ এগিয়ে তাঁর মন্তব্য, “আমায় ভাল ভাবে কোনও কথা বললে আমি বাড়ির বাসন মেজে দিয়ে আসতে পারি। কিন্তু আমায় আঘাত করলে আমি প্রত্যাঘাত করবই।”
সম্প্রতি রাজ্য সরকারের অনুদানপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারে আনন্দবাজার পত্রিকা, দ্য টেলিগ্রাফ ইত্যাদি বাদ দিয়ে কোন কোন পত্রিকা রাখা হবে, তার দু’টি তালিকা প্রকাশ করেছে সরকার। যা নিয়ে বিতর্ক এবং সমালোচনা তুঙ্গে। বিভিন্ন স্তরে প্রতিবাদও শুরু হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর এ দিনের বক্তব্যে স্পষ্ট যে, তিনি এই বিতর্কে ‘আক্রমণই রক্ষণের শ্রেষ্ঠ উপায়’ আপ্তবাক্য অনুসরণ করে চলবেন।
বৃহস্পতিবার টাউন হলে একটি নতুন বাংলা দৈনিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেই (উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্র ও রাজ্যের একাধিক সংখ্যালঘু মন্ত্রী। তবে আমন্ত্রণপত্রে নাম থাকলেও আসেননি রাজ্য বিধানসভার প্রাক্তন স্পিকার, সিপিএমের প্রবীণ সংখ্যালঘু নেতা হাসিম আব্দুল হালিম) মুখ্যমন্ত্রী সংবাদপত্র বিতর্কে তাঁর ক্ষোভ উগরে দেন। জানান, তাঁর সরকারকে ‘হেয়’ করার জন্য এটা ‘একটা পরিকল্পিত খেলা’। এবং তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, এখনও এর ‘শেষ’ হয়নি। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, “কী সব লেখা হচ্ছে! ফতোয়া! সেন্সরশিপ! আরে, এখনই এ সব শব্দ ব্যবহার করলে শেষে কী বলবেন!” |
বিক্ষোভ মিছিলে পথনাটিকা। বৃহস্পতিবার দেশকল্যাণ চৌধুরীর তোলা ছবি। |
ওই সরকারি নির্দেশিকার বিরুদ্ধে বুধবারই সরব হন মহাশ্বেতা দেবী। গত লোকসভা ভোটের সময় থেকেই ‘পরিবর্তন-পন্থী’ বলে পরিচিত মহাশ্বেতা বলেন, “কে কোন সংবাদপত্র পড়বেন, তা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মন্তব্য না-করলেই ভাল করতেন। সংবাদপত্রের নাম উল্লেখও সঠিক হয়নি। এই কাগজ পড়বেন এবং ওই কাগজ পড়বেন না বলে মুখ্যমন্ত্রী যতই নিজের অভিমত ব্যক্ত করুন, তা ফলপ্রদ হবে বলে মনে করি না। বরং মানুষের কাছে ভুল বার্তা গেল। যে মানুষ আগে যে কাগজ পড়তেন, এখনও তা-ই পড়বেন বলে বিশ্বাস করি।”
এ দিন ওই নির্দেশিকার বিরুদ্ধে পথে নেমেছিলেন বিশিষ্টজনেদের একাংশ। তার আগে মৃণাল সেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সুনন্দ সান্যাল প্রমুখ (বাকিদের মধ্যে অধিকাংশই অবশ্য মমতা-বিরোধী শিবির-ভুক্ত বলে পরিচিত) এক লিখিত বিবৃতিতে বলেছিলেন, ‘আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি, শিক্ষা-শিল্প-সংস্কৃতির নানা ক্ষেত্রে শাসকদল তথা রাজ্য সরকারের তরফে অবিচার ও পক্ষপাতিত্বের দৃষ্টান্ত ক্রমশই প্রকট হচ্ছে। তার সাম্প্রতিক প্রকাশ ঘটেছে সংবাদপত্র রাখার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ ও ফতোয়া জারি করার সরকারি ভূমিকায়। পাশাপাশি, এত দিন ধরে চলে-আসা গ্রামীণ ক্ষুদ্র সংবাদপত্র ও লিট্ল ম্যাগাজিনগুলিকে অনুদান দেওয়ার সরকারি প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে আকস্মিক ভাবে’। আরও বলা হয়েছে, ‘এর আগে সংবাদমাধ্যমের একাংশের বিরুদ্ধে সরকার পক্ষের অগণতান্ত্রিক রোষ আমরা লক্ষ করেছি। সংবাদকর্মীদের উপর শারীরিক নিগ্রহের ঘটনাও ঘটেছে। সেই অসহিষ্ণুতা ও ঔদ্ধত্যেরই পরিণতিতে ঘটেছে গ্রন্থাগারের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। আমরা এই সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় এবং অভিসন্ধিমূলক নিষেধাজ্ঞা অবিলম্বে প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি’। ওই বিশিষ্টজনেদের পক্ষে এ দিন এক ‘নাটকীয়’ মিছিল ময়দান মেট্রো স্টেশন থেকে রবীন্দ্রসদন ঘুরে অ্যাকাডেমি চত্বরে গিয়ে শেষ হয়। মিছিলকারীদের গায়ে পোস্টারে লেখা ছিল, ‘বন্ধ কর সবার মুখ, স্বৈরাচারের তাতেই সুখ’।
মঙ্গলবারই সরকারের জোটশরিক কংগ্রেসের যুবশাখার সদস্যরা অমিতাভ চক্রবর্তীর নেতৃত্বে ‘নিষিদ্ধ’ কাগজগুলি রাজ্য কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে জমা দিয়ে এসেছেন। এ দিন কংগ্রেসের মানবাধিকার শাখা বিক্ষোভ দেখিয়েছে প্রদেশ কংগ্রেস দফতরের সামনে। সংগঠনের সভানেত্রী মালা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে নির্দেশিকা প্রত্যাহারের দাবিও তুলেছে। ঘটনার নিন্দা করে ন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ জার্নালিস্টস (ইন্ডিয়া)-এর তরফে বলা হয়েছে, ‘‘সংবাদপত্র চরিত্রগত ভাবেই জনস্বার্থ বিষয়ে নজরদারি করে। ফলে সমস্ত গণতান্ত্রিক সরকারেরই সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকে শ্রদ্ধা করা উচিত। ঘৃণিত জরুরি অবস্থার অভিজ্ঞতা যেন কেউ ভুলে না যান’।
সরকারি নির্দেশিকার ‘প্রভাব’ পড়তে শুরু করেছে গ্রন্থাগারগুলিতেও। নির্দেশিকা নিয়ে বির্তকের জেরে এ দিন জলপাইগুড়ি জেলা গ্রন্থাগারের উপ-সমিতির সভা স্থগিত হয়ে যায়। গ্রন্থাগার সূত্রের খবর, জেলা গ্রন্থাগারের সাংস্কৃতিক ও ক্রয় উপ-সমিতির সভায় কয়েক জন সদস্য প্রশ্ন তোলেন, কেন গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষ পরিচালন সমিতির সঙ্গে আলোচনা না করেই একতরফা ভাবে বহুলপ্রচারিত সংবাদপত্রগুলি গ্রন্থাগারে রাখা বন্ধ করেছেন। এ নিয়ে সমিতির দুই যুগ্ম-সম্পাদকের মধ্যে তুমুল বচসা হলে সভা স্থগিত হয়ে যায়।
বিক্ষোভ-বিতর্ক যতই হোক, তিনি যে ‘পিছু হঠছেন না’, এ দিন মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যেই স্পষ্ট। পাশাপাশি তিনি জানিয়েছেন, কোনও দলীয় মুখপত্রও সরকারি গ্রন্থাগারে থাকবে না। বাম আমলে সিপিএমের মুখপত্র গ্রন্থাগারে ‘আবশ্যিক’ ছিল। সরাসরি না-বললেও সে দিকে ইঙ্গিত করে মমতা বলেন, “আমি যেমন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে সরকার চালাতে চাই না, তেমনই আমি চাই, কোনও পার্টির কাগজ গ্রন্থাগারে থাকবে না।”
মুখ্যমন্ত্রীর ২০ মিনিটের বক্তৃতার সিংহভাগ জুড়েই ছিল সংবাদমাধ্যমে তাঁর সরকারের সমালোচনার পাল্টা সমালোচনা। তাঁর কথায়, “দোষ আমাদের থাকলেও আপনাদেরও কম নেই! ৩৪ বছরে কিছু চোখে পড়ল না! এখনই সব ভুল চোখে পড়ছে! শুধু নেতিবাচক হতে হবে!” বস্তুত, ‘সমালোচক’ সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগ, সংবাদপত্রের পরিচালক বা মালিকদের ‘ব্যক্তিস্বার্থে’ ঘা পড়তেই তারা যা খুশি তাই লিখছে। এটা যে তিনি ‘বরদাস্ত’ করবেন না, তা জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “মতের সঙ্গে মিলল না বলে যা খুশি তাই করে গেলাম, এটা ঠিক নয়। আপনার নীতির ব্যাপারে যেমন আমি নাক গলাব না, তেমনই আমার সরকার কী ভাবে কাজ করবে, সেই সিদ্ধান্ত আমি নেব! আমি জনস্বার্থে কাজ করব। কোনও ব্যক্তিকে তুষ্ট করতে নয়!” |